আজ ১২ই সেপ্টেম্বর। অমর কথাশিল্পী, যশস্বী ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন। তাঁর পূণ্য জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি স্বরূপ কয়েকটি কথা নিবেদন করা যাক।
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথা শিল্পীদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন শিক্ষাব্রতী, সৃষ্টির ভুবনে খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক। তাঁর রচনাশৈলীতে মনন প্রধান তত্ত্বকথা প্রাধান্য পায় নি। কাব্যধর্মী রোমান্টিকতা, প্রকৃতি চেতনা, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, দারিদ্র্যপীড়িত সমাজের বাস্তব চিত্র তাঁর গল্প ও উপন্যাসের মূল উপাদান। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খ্যাতনামা উপন্যাসগুলোর মধ্যে আছে 'পথের পাঁচালী' (১৯২৯ সালে প্রকাশিত), এই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব 'অপরাজিত' (১৯৩২), ১৩৪২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় 'দৃষ্টিপ্রদীপ'। ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হলো 'আরণ্যক', ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে রচনা করলেন 'আদর্শ হিন্দু হোটেল'। ১৩৫১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হলো 'ইচ্ছামতী'। এগুলোর সব কয়টিই চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। পাঠক হৃদয়ে সাড়া জাগিয়েছে তাঁর সব কয়টি উপন্যাস ও গল্প। কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন কিন্তু কথা শিল্পীর পরিচয়েই তিনি কালোত্তীর্ণ ব্যক্তিত্ব রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।
তাঁর গল্প সংকলন 'মেঘমল্লার' (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ), 'মৌরিফুল' (১৩৩৯ বঙ্গাব্দ), 'যাত্রাবদল' (১৩৪১) প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় ভান্ডার। তাঁর সমকালে আরো কয়েকজন যশস্বী ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব ঘটলেও তাঁর বৈশিষ্ট্যগত ঔজ্জ্বল্যকে কেউ ম্লান করতে পারেনি। মেধা, মনন, সৃজন ক্ষমতা তাকে প্রভূত জনপ্রিয়তা দিয়েছে। সমসাময়িক বিবর্ণ সময় এর দলিল রচনা করলেও অসাধারণ প্রতিভা, কল্পলোকের সৃজনশৈলী, কঠিন বাস্তবের মধ্যেও সরস জীবনের মাধুর্য আহরণ ও পরিবেশনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শিশু কৌতুহল, প্রজ্ঞা কালের উপলব্ধি ক্ষমতা, অসাধারণ ভাষাশৈলী, পল্লী জীবন ও অরণ্য জীবনের ছবি ও প্রান্তিক মানব সমাজের চরিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, অনুভব, সাহিত্যের প্রসাদ গুণে ভরপুর। মন রসনা নৈপুণ্য, গল্পের প্লট নির্মাণের মুন্সিয়ানা তাঁকে সার্থক কথাশিল্পীর মর্যাদায় বিভূষিত করেছে। মানবদরদি ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ নিছক সাহিত্য সৃজনের তাগিদে লেখনী ধারণ করেন নি। মানুষ ও মানব সমাজের প্রতি, অরণ্য প্রকৃতির প্রতি অপার ভালোবাসায়, কল্যাণ সাধনের দায়বোধে তিনি আজীবন লেখনি চালনা করেছেন। তাঁর গল্প, উপন্যাসে অরণ্য প্রকৃতি, নদী ও জল জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। 'আরণ্যক' উপন্যাসের নায়ক মানুষ না অরণ্য প্রকৃতি? অনেকের মতে সবুজ বর্ণ মন্ডিত অরণ্যই এই উপন্যাসের নায়ক। সমাজ, গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান অপরিসীম থাকা সত্ত্বেও তিনি বিষয়টিকে কথাশিল্প রসের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠতে দেননি। যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তাঁর গল্প উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। গল্প বা উপন্যাসের চরিত্রগুলোই যা বলার সহজ ভাষায় বলেছে। সব প্রশ্নের উত্তর যুগিয়েছে। তাঁর গল্প ও উপন্যাসে শান্ত স্নিগ্ধ গৃহস্থ জীবনের ছবি দেখি। শান্ত স্নিগ্ধ মধুর আবার দারিদ্র্যপীড়িত সংসারের দৈনদশাও অলক্ষণীয় নয়। 'দেবযান' উপন্যাসে তিনি রূপাতীত লোকের সন্ধানী। প্রকৃতি ও মানুষের চিরন্তন সম্পর্কের কথা তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। 'আরণ্যক' 'পথের পাঁচালী' উপন্যাস হলেও যেন মহাকাব্য হয়ে উঠল ভাষার ব্যঞ্জনায়। কোথাও কোনো কৃত্রিমতা নেই। তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোনটি? সম্ভবত 'পথের পাঁচালী'। প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় এসেছিলেন। কিছুদিন রাজার অতিথি হয়েছিলেন। পুষ্পবন্ত প্রাসাদ ও কুঞ্জবনের অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন।
ডঃ আশিস কুমার বৈদ্য
ত্রিপুরা
১২ই সেপ্টেম্বর ২০২১
সুন্দর ও তথ্যবহুল লেখা। জেনে ঋদ্ধ হলাম। এমন একটি লেখার জন্য ড. আশিস কুমার বৈদ্য মহাশয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আর পাঠকসমাজে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ আরশি কথাকে।
উত্তরমুছুন