শেখ হাসিনা: জীবন যেন তাঁর ফিনিক্স পাখির মতোই ।। আরশিকথা বাংলাদেশ বিভাগ
আরশি কথাসেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২
0
প্রভাষ চৌধুরী, ঢাকা ব্যুরো এডিটর,আরশিকথাঃপূর্বসূরির ছাই থেকে পৌরাণিক ফিনিক্স পাখির নতুন জীবন লাভের মতোই তাঁর উত্থান। জাতি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের পর যখন এক দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল তখন তিনি পরিত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ঘটনাক্রমে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ এই হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।
গণমানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত করার আজীবন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যে মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঘাতকরা তাঁর রক্তের উত্তরাধিকারের পুরো ধারাটিই মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু, সর্বশক্তিমানের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন-বাঙালি নারীর সর্বোত্তম প্রতিমূর্তি শেখ হাসিনা জাতির কান্ডারী হতে এগিয়ে আসেন-সম্ভবত জাতির পিতার অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার জন্যই।
‘আমি আপনাদের মেয়ে, বোন বা মা ছাড়া আর কেউ নই, চাইলেই যার কাছে যাওয়া যায়। আমি দূরের কেউ নই। আমি আপনাদের খুব কাছের,’-তিনি একবার এক সাক্ষাৎকারে নিজের সর্ম্পকে বলেন। ‘আমার নামটা দেখুন-হাসিনা। এই সহজ ও সাদামাটা নামটি আপনারা গ্রামবাংলা জুড়ে অসংখ্য পরিবারে খুঁজে পাবেন- হা সি না।’ ১৯৮১ সালে বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের নতুন অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দেয়ার কঠিন মিশন নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশের কয়েক বছর পর তিনি এ মন্তব্য করেন।
১৯৪৭ সালে যখন বিশ্ব ইতিহাস সবেমাত্র প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজনের উল্লেখযোগ্য পালাবদল প্রত্যক্ষ করছে ঠিক তখনই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রত্যন্ত একটি গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। উদারতা এবং শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হওয়ার জন্য শ্রদ্ধা অর্জন ছাড়া পরিবারটি তখনো অসাধারণ কিছু ছিল না। প্রকৃতি যখন তাঁর পিতাকে একটি দেশের ভবিষ্যৎ স্থপতি এবং জাতির পিতা হিসাবে গড়ে তুলতে একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে লালন করছিল, যে কারণে প্রায়ই তাঁকে পরিবার থেকে দূরে থাকতে হত, শেখ হাসিনা তখন অন্যান্য সাধারণ শিশুর মতোই তাঁর টুঙ্গিপাড়া গ্রামের খোলা বাতাসে মধুমতি নদীর তীরে বেড়ে ওঠেন।
শেখ হাসিনা তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, তখন তিনি গ্রামের রাস্তায় সমবয়সীদের সাথে ঘুরে বেড়াতেন, প্রায়ই কাঁচা কুল খুঁজতেন, যা ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশের একটি শিশুর আদর্শ জীবনযাত্রা। তিনি কীভাবে মাছ ধরা জাল ‘ওচা’ দিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মাছ ধরতেন তা স্মরণ করতে ভালোবাসেন। কয়েক দশক পরে একদল বাচ্চার সাথে কথোপকথনের সময় শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে গাছে ওঠা, খালে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা এবং অন্যের গাছ থেকে কাঁচা আম পেরে খাওয়ার মত দুষ্টুমির কথা বলেন। ‘সেগুলো ছিল আমার জীবনের সেরা সময়,’ তিনি বলেন।
বাড়িতে বাবা-মা’র পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় হওয়ায় তিনি ছিলেন একেবারে ঘরোয়া মেয়ে, বাবা-মা এবং ছোট ভাই-বোনদের প্রতি ছিল যার প্রচণ্ড ভালবাসা।
প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিতি এবং গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা তাঁর মধ্যে মানুষের পাশাপাশি পরিবেশের প্রতি ভালবাসা, সামাজিক বন্ধন এবং ঐতিহ্যগত বুদ্ধিমত্তা বা লোকায়ত জ্ঞান বোঝার দক্ষতা তৈরি করেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পারিবারিক মূল্যবোধের সঙ্গে এই বোধজ্ঞান এবং প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা তার মূল চরিত্র গড়ে তুলেছে। গ্রামের সাথে তার অবিশ্বাস্য ও চিরন্তন যোগসূত্র সত্ত্বেও প্রশংসাকারী বা সমালোচক নির্বিশেষে যে-কেউ তার স্বাভাবিক স্মার্টনেস, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ এবং চেহারা, পোশাক ও আলাপচারিতায় তার নিজের একটি অনন্য স্টাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে নাগরিক বলেবেন।গুণাবলীর এই অনন্য সংমিশ্রণটির জন্য তিনি একজন মুচি থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের রানী পর্যন্ত প্রতিটি সামাজিক স্তরের মানুষের কাছ থেকে ভালবাসা, স্নেহ এবং শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছেন।
‘হা-সিনা কোথায়, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না!’ রানি এলিজাবেথ একবার বাকিংহাম প্যালেসে স্নেহপূর্ণ সুরে বলেছিলেন। কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের এক সংবর্ধনায় যোগ দিতে তিনি গিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে রানির শেষকৃত্যে যোগ দিতে লন্ডনে গিয়ে শেখ হাসিনা নিজেই বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মধুর স্মৃতির কথা স্মরণ করেন।
তার বেশ কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু স্মরণ করেন যে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন তখন তাঁর ব্যক্তিগত বইয়ের শেলফ উঁচু মানের সাহিত্য এবং মহৎ ব্যক্তিদের জীবনীতে ভর্তি ছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য পছন্দ করেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও সুকান্ত ভট্টাচার্যও তাঁর প্রিয় লেখক। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের বিখ্যাত পথের পাঁচালী তাঁর প্রিয় উপন্যাস। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তাকে মানব প্রকৃতি ও জীবনকে বোঝার জন্য একটি অতিরিক্ত চোখ দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে, যা তাঁর মাপের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ।
তার ঘনিষ্ঠ লোকেরা বা যারা একজন ‘পাবলিক ফিগার’ হিসাবে তাঁর ওপর নজর রাখেন তারা তার মধ্যে সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ও ইতিহাসের প্রতিও অনুরাগ খুঁজে পান। তাঁর ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে তিনি একজন বোদ্ধা হিসেবে কবি, গায়ক বা সংগীতশিল্পী ও অভিনেতাদের সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশ করে থাকেন।
বাংলাদেশকে একটি অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং সর্বাত্মক সততার সঙ্গে এটি করার প্রবল ইচ্ছাশক্তিও তাঁর রয়েছে।
পরিচিতরা বলেন, তার সঙ্গে রাজনীতির পাশাপাশি চলচ্চিত্র, টিভি সিরিয়াল, সাহিত্যের প্রবণতা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের মত ব্যাপক বিষয়ে বিতর্ক করা যায়। জন্মগত নেতৃত্বের গুণ, অমিত প্রাণশক্তি, অসাধারণ হাস্যরসবোধ, মমতাময় মন এবং মর্যাদাবোধ তাকে তিনি যেখানে ছিলেন এবং আছেন প্রতিটা ক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করেছে।
‘আমি ছোটবেলা থেকেই দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত ছিলাম,’ একবার তিনি এক নিবন্ধে লিখেছিলেন।
শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় তার বাবা এবং তাঁর সহকর্মীরা যে অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করেন তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যখন তিনি তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও পরিবারকে এবং দলকে নেপথ্যে পথনির্দেশনা দিতে দেখেন। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনীতিতে আমার প্রথম পাঠ এসেছে আমার পারিবারিক পরিবেশ থেকে।’
তবে, তাঁর বিষয়টি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে একটি সাজানো-গোছানো মঞ্চে এসে ভাগ্যবান রাজকন্যার হাজির হওয়ার মত ছিল না। এটি আসলে এমন এক মেয়ের অভিজ্ঞতা যিনি তার বাবাকে তার নিজের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করতে দেখে বেড়ে উঠেছেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেন যে তার পিতার সংগ্রাম প্রায়ই তাঁকে ও পরিবারকে তীব্র দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং পুত্র, স্বামী ও পিতা হিসাবে পরিবারের প্রতি সমস্ত প্রতিজ্ঞা, মমতা ও উদ্বেগ সত্ত্বেও তার মিশন তাকে প্রায়ই একটি সাধারণ পরিবারিক লোকের জীবনযাপন থেকে বিরত রেখেছে। তিনি শিখেছেন তার পিতা কীভাবে দুর্গত মানুষের সেবার মাধ্যমে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন।
ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনা দেখতে পান তার বাবা কীভাবে সাধারণ মানুষের-যাদের তিনি ‘আমার লোক’ বলে মনে করতেন তাদের- ন্যায্য অধিকার অর্জনের জন্য গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি যখন তাদের জন্য স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয় বিনির্মাণ করেন; তাদের জন্য স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেন এবং সে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাক্সময় করে তোলেন এবং শেষ পর্যন্ত একটি জাতি গঠনের সফল সংগ্রামে তাদের নেতৃত্ব দেন তখন তিনি তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেন।
‘আমি যখন নোটবুকের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম এবং তাঁর হাতের লেখা লাইনগুলোর ওপর হাত বুলাচ্ছিলাম তখন আমার মনে হল, আমার বাবা আমাকে বলছেন: ‘ভয় পাস নে; আমি তোর সঙ্গে আছি; এগিয়ে যা এবং দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হ।’ ‘আমার মনে হল আল্লাহ অলৌকিকভাবে আমাকে অদম্য হওয়ার জন্য একটি বার্তা পাঠিয়েছেন,’ তিনি এক লেখায় লিখেছেন।