কলকাতার উত্তর শহরতলির এক শান্তিপূর্ণ পাড়া। নাম শ্যামাপল্লী। সারাবছর পাড়াটা চুপচাপ, গলির মোড়ে কাকভোরের চা-দোকান, দুপুরে খুদে ছেলেদের গলিপ্রেম আর সন্ধ্যায় দাদুর দল নিয়ে আড্ডা—এই নিয়মিত ছন্দে চলতে থাকে। কিন্তু আশ্বিন মাস পড়লেই যেন পুরো পাড়াটা একেবারে অন্যরকম হয়ে ওঠে। বাতাসে ঢাকের শব্দ, কাশফুলের দোলা, শিউলির গন্ধ আর সবার মনে একটাই উন্মাদনা—দুর্গাপূজা আসছে!
প্রায় তিন মাস আগে থেকেই পাড়ার মিটিং বসে। বড়োরা বাজেট নিয়ে মাথা ঘামান, আর ছোটরা রঙিন পোস্টার আঁকে। কারও দায়িত্ব আলোর ব্যবস্থা, কারও দায়িত্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আবার কেউ বা পুরোহিতের সাথে যোগাযোগের কাজে ব্যস্ত। এই সবকিছুর মধ্যেই পাড়ার সবচেয়ে উৎসাহী মানুষ নিখিলকাকু—তিনি প্রতিবারই বলেন,
“এই পুজোটা আমাদের সবার, তাই কাজও সবার।”
এই বছরও ব্যতিক্রম ঘটেনি। কুমোরটুলিতে গিয়ে মূর্তি আনার দায়িত্ব ছিল তপনের। সে প্রথমবার এমন গুরুদায়িত্ব পেল বলে ভীষণ খুশি। প্রতিদিন সে বন্ধুদের বলে বেড়াত—
“তোমরা দেখো, এবারের প্রতিমা হবে একেবারে অনন্যা। মা হাসবেন আমাদের দিকে।”
তপন যখন কুমোরটুলিতে গেল, তখন সেখানে অদ্ভুত এক ব্যস্ততা। চারিদিকে খড়, মাটি, রঙ আর শিল্পীদের হাতের জাদু। চোখের সামনে যেন দেবত্ব গড়ে উঠছে। তপন মুগ্ধ হয়ে দেখল কীভাবে মা দুর্গার মুখে ধীরে ধীরে প্রাণ আসছে। সে ঠিক করল, প্রতিমা গাড়িতে চাপিয়ে আনার সময় পাড়ার সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ঢাক বাজাবে।
অবশেষে এল মহালয়ার দিন। ভোর চারটেয় পাড়ার সব বাড়ির জানালা থেকে ভেসে আসছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ। শিউলিফুলে ভরে উঠেছিল উঠোন। রূপার থালায় সাজানো ধূপ, প্রদীপ, ফল আর ফুল দেখে মনে হচ্ছিল মা আসতে দেরি করবেন না।
বৃদ্ধা ঠাকুমারা বললেন,
“এবারের মহালয়া একেবারে পুরোনো দিনের মতো হয়েছে। শুনতে শুনতে মনে হল মা যেন নদী পার হয়ে আসছেন।”
মহালয়ার পরদিনই প্রতিমা এলো। ট্রাকে করে যখন মা এলেন, তখন ঢাক, শাঁখ আর উলুধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত। ছোটরা দৌড়ে এসে ফুল ছিটিয়ে দিল। মা এসে বসে পড়লেন শ্যামাপল্লীর মণ্ডপে। সেই মুহূর্তটা যেন জাদুর মতো—সবাইয়ের চোখ ভিজে উঠল আনন্দে।
মন্ডব এবার সাজানো হয়েছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আদলে। বাঁশ, কাপড় আর রঙিন আলোয় যেন জীবন্ত হয়ে উঠল ইতিহাস। সন্ধ্যা নামতেই ঝলমল করে উঠল পুরো পাড়া। আলোর নকশা, ফেস্টুনে আঁকা সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ আর মাতৃমূর্তির প্রতীক—সব মিলিয়ে যেন স্বপ্নরাজ্য।
ষষ্ঠীর দিন থেকেই আসল আনন্দ শুরু। সকালবেলা বোধন দেখে ভিড় জমল। মেয়েরা শঙ্খ বাজাল, পুরুষরা প্রণাম করল, আর বাচ্চারা মণ্ডপের চারপাশে ছুটোছুটি করল। সবাই নতুন জামাকাপড় পরে এসেছে। কারও শাড়ি লালপাড়, কারও ধুতি সাদা, কারও আবার একেবারে আধুনিক পোশাক। তবুও সবার চোখেমুখে একটাই উজ্জ্বলতা—মা এসেছেন!
সপ্তমীতে কোলাহল আরও বেড়ে গেল। গলিতে গলিতে খাবারের স্টল বসেছে—ফুচকা, ঘুগনি, কাটলেট, চপ। শিশুরা এক টাকা হাতে নিয়ে দৌড়চ্ছে। আর বড়রা লাইন দিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দিতে ভোর থেকেই ভিড়। ঠাকুমা থেকে নাতনি, সবাই শাড়ি পরে পায়ে আলতা দিয়ে হাজির। ধূপের গন্ধ, মন্ত্রপাঠ আর ঢাকের বাজনা—মনে হচ্ছিল স্বর্গ নেমে এসেছে। দুপুরে খিচুড়ি ভোগ খেতে সবাই বসলো। গরম খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনভাজা, চাটনি, পায়েস—সবাই একসাথে খেতে খেতে গল্প আর হাসিতে মাতোয়ারা। নবমীর দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো। ছোটরা নাচ করল, বড়রা গান গাইল। পাড়ার দিদিরা রবীন্দ্রনৃত্য উপস্থাপন করলেন। শেষ হল নাটক দিয়ে—“মহিষাসুর মর্দিনী”। দর্শকদের হাততালি আর হাসি-কান্নায় ভরে উঠল মণ্ডপ।
অবশেষে এল সেই বেদনাদায়ক দিন—দশমী। সকালে মায়ের সিঁদুরখেলা হলো। লাল শাড়ি, সিঁদুরে ভরা মুখ, হাসিতে আর অশ্রুতে মিশে এক অদ্ভুত দৃশ্য। মেয়েরা মাকে সিঁদুর পরিয়ে দিল, তারপর একে অপরকে। চারিদিকে শুধু লাল রঙের ঝলকানি। বিকেলে প্রতিমা বিসর্জন। ট্রাকে করে মা যাচ্ছেন গঙ্গার ঘাটে। ঢাক বাজছে, সবাই উলুধ্বনি করছে, তবুও বুকের ভেতরটা ভারী। ছোটরা কাঁদছে—“মা আবার এসো।” বৃদ্ধরা হাত জোড় করে প্রার্থনা করছেন—“পরের বছর আবার যেন একসাথে হই।”
গঙ্গার জলে যখন মা বিলীন হলেন, তখন আকাশে উড়ল হাজার রঙের ফানুস। মনে হচ্ছিল, মা সত্যিই আশীর্বাদ করে আকাশে মিলিয়ে গেলেন।
দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটা আমাদের সম্পর্কের উৎসব। শ্যামাপল্লীর মানুষ বছরের পর বছর একসাথে হাত লাগিয়ে প্রমাণ করে চলেছে—মা কেবল মণ্ডপের প্রতিমায় নন, তিনি আমাদের ভালোবাসা, ঐক্য আর আনন্দের প্রতীক।
এবারের পুজো শেষে নিখিলকাকু বললেন—
“দেখো, আমাদের পুজো শুধু চারদিন নয়, পুরো বছর জুড়ে টিকে থাকে। কারণ এই উৎসব আমাদের মনে ভালবাসা জাগায়, দুঃখ ভুলিয়ে দেয়, আর নতুন স্বপ্ন দেখতে শেখায়।”
সেই কথায় সবার মুখে হাসি ফুটল। কারণ তারা জানে, আবারও এক বছর অপেক্ষার পালা শুরু হলো।
- রশ্মিতা দত্ত
দশম শ্রেণী
ভবনস্ ত্রিপুরা বিদ্যমান্দির
আরশিকথা সাহিত্য
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২৫