আরশি কথা

আরশি কথা

No results found
    Breaking News

    "ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়া মহামারির ছায়া: অ্যাসপারগিলাস ফিউমিগাটাস এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার নতুন চ্যালেঞ্জ"

    আরশি কথা

    আরশিকথা ডেস্কঃ


    একটি নতুন বৈশ্বিক স্বাস্থ্য হুমকি চুপিসারে আমাদের ফুসফুসে ঘাঁটি গেড়ে বসছে। এ হুমকি কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া নয়, বরং এক ধরণের বায়ুবাহিত ছত্রাক যার নাম অ্যাসপারগিলাস ফিউমিগেটাস (Aspergillus fumigatus)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এর বিস্তার নতুন উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। এটি এমন একটি ছত্রাক, যার অতিক্ষুদ্র কণিকা (conidia) প্রতিনিয়ত বাতাসে ঘুরছে, এবং একবার শরীরে প্রবেশ করলে তা ভেতর থেকে শরীরের টিস্যু ধ্বংস করতে সক্ষম।

    বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট:

    অ্যাসপারগিলাস ফিউমিগেটাস হল একটি ছত্রাক যা সাধারণত মৃত উদ্ভিদপিণ্ড, মাটি, কম্পোস্ট স্তূপ এবং বাড়ির ধুলোতেও পাওয়া যায়। এর স্পোরগুলো এতটাই সূক্ষ্ম যে সেগুলো সহজেই মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করতে পারে।

    ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH) এর গবেষণা অনুযায়ী, ছত্রাকটি ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা) তাপমাত্রায় দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি এটি ৫০°C (১২২°F)-এর বেশি তাপমাত্রায়ও টিকে থাকে—যা এটিকে কম্পোস্ট স্তূপ বা গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে থাকার উপযোগী করে তোলে।

    রোগ ও ঝুঁকি:

    অ্যাসপারগিলাস ছত্রাকের সংক্রমণে “অ্যাসপারগিলোসিস” নামে পরিচিত একাধিক ফর্মের ফুসফুসজনিত রোগ হয়। এর সবচেয়ে মারাত্মক রূপ ইনভেসিভ অ্যাসপারগিলোসিস (IA), যা চিকিৎসা না হলে মৃত্যুহার ৩০%–৯০% পর্যন্ত হতে পারে, বিশেষ করে যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল।

    সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বছরে ৩০–৪০ লক্ষ মানুষ বিশ্বজুড়ে অ্যাসপারগিলাস সংক্রমণে আক্রান্ত হন (তথ্য: Global Action Fund for Fungal Infections)।

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর আনুমানিক ১৫,০০০ জন IA আক্রান্ত রোগীর অস্তিত্ব রয়েছে, যদিও সংক্রমণের প্রকৃত পরিসংখ্যান আরো অনেক বেশি বলে মনে করা হয়, কারণ এটি "রিপোর্টেবল ডিজিজ" নয়। রিপোর্টেবল ডিজিজ কথার অর্থ হল একটি রোগ যা নির্ণয়ের সময় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের (সাধারণত আইন অনুসারে) রাজ্য বা স্থানীয় জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট করতে হয়। 


    CDC ( সেন্টার ফর ডিসিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন) মতে, IA-এর ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপের মধ্যে রয়েছেন:

    ১) কেমোথেরাপি গ্রহণকারী ক্যান্সার রোগী।

    ২) অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ব্যক্তি।

    ৩) দীর্ঘমেয়াদী কর্টিকোস্টেরয়েড ব্যবহারকারী।

    ৪) হেমাটোলজিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি।


    অ্যান্টিফাঙ্গালের রেজিস্ট্যান্স ও কৃষি ব্যবস্থার ভূমিকা:

    সাম্প্রতিক গবেষণায় Applied and Environmental Microbiology-তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি রাজ্যের কৃষি মাটিতে azole-resistant Aspergillus fumigatus পাওয়া গেছে। এই ছত্রাকটি এখন স্ট্যান্ডার্ড ওষুধ যেমন ভোরিকোনাজল, ইট্রাকোনাজল-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। এই অ্যান্টিফাঙ্গাল রেজিস্ট্যান্সের অন্যতম কারণ হলো কৃষিতে ব্যাপকভাবে ফাঙ্গিসাইড অর্থাৎ ছত্রাকনাশক ব্যবহার, যা ছত্রাকের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী জিনের উদ্ভব ঘটাচ্ছে। সুতরাং কৃষি ব্যবস্থায় ছত্রাকনাশক ওষুধের ব্যবহার কমিয়ে ইকো সিস্টেমকে পুনরায় স্থাপিত করার একটি ভূমিকা রয়েছে।


    জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যৎ হুমকি: ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মডেল স্টাডি অনুসারে, যদি বর্তমান হারে জীবাশ্ম জ্বালানি, অর্থাৎ কয়লা ও অন্যান্য পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য ইত্যাদি পোড়ানো অব্যাহত থাকে, তাহলে ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে অ্যাসপারগিলাস ফিউমিগেটাস এর পরিবেশগত বিস্তার ৭৫% বৃদ্ধি পেতে পারে, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে দক্ষিণ আমেরিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলোতে। তাই এটি শুধুমাত্র পরিবেশগত সমস্যা নয় বরং বলা যায় এটা একটা ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থ্য মহামারির আশঙ্কা।


    প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:

    বিশ্ব এখনো COVID-19 মহামারির অভিঘাত থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে, জনস্বাস্থ্য হুমকির জন্য প্রস্তুতি সবকিছুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ছত্রাক সংক্রমণকে এখনো অনেক দেশ গুরুত্ব সহকারে নেয় না।

    তাই নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গুলি নিলে আশা করা যায় অ্যাসপারগিলোসিস থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

    ১) অ্যাসপারগিলোসিস-কে রিপোর্টেবল ডিজিজ ঘোষণা করা হোক।

    ২) অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের গবেষণায় বৈশ্বিক অর্থায়ন বাড়ানো হোক, বিশেষ করে azole-resistant স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে।

    ৩) কৃষিতে ফাঙ্গিসাইডের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, যাতে ওষুধ-প্রতিরোধী ছত্রাকের উদ্ভব রোধ করা যায়। 

    ৪) জলবায়ু অভিযোজন ও স্বাস্থ্যনীতি সমন্বয় করে ছত্রাক সংক্রমণের ভবিষ্যৎ ঝুঁকি নিরসন করতে হবে।


    পরিশেষে আমরা বলতে পারি অ্যাসপেরাগিলাস ফিউমিটিডাস কেবল একটি জীবাণু নয়, বরং এটি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিবেশনীতি—এই তিনটির মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের বাস্তব পরীক্ষা।

    আমরা যদি এখনি যথাযথ পদক্ষেপ না নিই, তাহলে এই ছত্রাক একদিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই বরং পুরো বিশ্বে মানুষের ফুসফুস শুধু নয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভিতও ধ্বংস করে দিতে পারে।


    ডাঃ শ্যামোৎপল বিশ্বাস


    আরশিকথা হাইলাইটস

    ৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৫

     

    3/related/default