ফরজানা বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকাল ,প্রখর রোদে চোখ ঝলসে যায় , বা হাত কোমরে রেখে ,ডানহাত দিয়ে চোখ ঢাকল । সকাল প্রায় দশটা বাজে , এখনি এত তীব্র আঁচ , এপ্রিল এসে গেল । উঠোনে দড়িতে মেলা কাপড়গুলো তুলে ফেলতে হবে ,নইলে পাপড় ভাজা হয়ে যায় । তার ঘর গলির শেষ প্রান্তে , এরপর বালিয়াড়ি , এদিকে ওদিকে বিক্ষিপ্ত গুল্ম , নীল ফেনিল জলরাশি সৈকতে আছড়ে পড়ছে ,পাশের লাগোয়া কালো পাহাড়ের গর্ত থেকে রং বেরঙী কাঁকড়া গুলি বেরিয়ে এসে লুকোচুরি খেলছে । পাঁচিল ঘেরা উঠোনের দরজা বালিয়াড়ির দিকে খোলা , ফরজানা বাইরে এসে দাঁড়ালো । বেশ কিছু বড় গাছ ছড়িয়ে , ফরজানার ঘর সংলগ্ন বট গাছের ছায়ায় বসে তার একমাএ উট চোখ মুদে জাবর কাটছে ,ছাগল দুটি খুঁটিতে বাঁধা । ফরজানা গজগজ করলো , “নিজে গিয়ে ঘাস খুঁজে খেতে পারো না ?আমি একা হাতে কত সামলাবো !’’ উট টি চোখ খুলে একবার তাকিয়ে আবার চোখ মুদলো । ফরজানার সব কাজ পড়ে আছে ,আবদুল্লা দুপুরে এসে খাবে ,আবদুল্লা তার আদরের মেয়ে আসমা’র ছেলে , আসমা’র মৃত্যুর পর , ফরজানার সাথে থাকে । আবদুল্লা মাছ ধরতে গেছে সমুদ্রে ,যতক্ষণ না ফেরে ,এক ত্রাস তাড়া করে ফরজানাকে । সে আর সমুদ্রকে বিশ্বাস করে না , যদিও সমুদ্রই তাদের রুজি রুটি দেয় । পারিবারিক মাছের ব্যাবসা তাদের । তার স্বামী মহম্মদ এক সুন্দর সকালে ডিঙ্গি নিয়ে মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে যায় ,আর ফেরে নি । আল্লা তাকে কাছে টেনে নিয়েছেন । আহা ,বড় ভাল মানুষ ছিল সে । কুৎসিৎ ফরজানাকে কোনদিন অবহেলা করে নি , আমুদে মানুষ ছিল । ছোট ব্যবসা বড় হয়েছে, তবু নিজে মাছ ধরতে যেত । সমুদ্র ভাল বাসত সে , এখন সে সমুদ্র গহ্বরে শুয়ে আছে । বাবা হিসেবে সব কর্তব্য করেছে , ছেলেরা সবাই প্রতিষ্ঠিত । শুধু অভিমানী আসমা আত্মহত্যা করল ,সইতে পারল না ,স্বামী ওসমানের দ্বিতীয় নিকাহ্ । মেয়েরা স্বামীর মধ্যে বাবার গুণগুলি দেখতে চায় । বালুচি ওসমানকে ফরজানার কখনো ভাল লাগে নি ,ধূর্ত মনে হত । কিন্তু দুটো বিয়ে খুবই স্বাভাবিক , সবাই মহম্মদের মত এক বিবি নিয়ে থোড়িহি না থাকে!
প্রায় সত্তর বছর আগে ,ফরজানার আব্বাজান গুজরাট থেকে ওমানে এসেছিল ,অন্য ছোট ব্যবসায়ীদের সাথে , আর ফিরে যায় নি । ফরজানার জন্ম এই ওমানেই । গুজরাট কখনো যায় নি , এ দেশের বাসিন্দা হয়ে থেকে গেছে ,আরো চার ভাইবোনের সাথে । ওমানের মত শান্তি আরবের কোনো দেশে কি আছে ?
সবাই খুব শান্তিতে আছে , সরকার থেকে ভিলা দেয়া হয়েছে , ফরজানা ও পাবে ।
হঠাৎ তার চোখ যায় সমুদ্র তীরে , এক কমবয়সী মহিলা ,দেখে মনে হচ্ছে ভারতীয় , সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে । ঐ দিকটায় সমুদ্র গভীর , কেউ নামে না । আরে ,ওর মতলবটা কি? ফরজানা থেকে কোনাকুনি ভাবে আছে পাথুরে পাহাড়।মহিলাটি সেখানেই এগিয়ে যাচ্ছে । ফরজানার অন্তর কেঁপে ওঠল আশংকায় ,কেউ নেই সৈকতে । সাধারণত ছুটির দিনে ভীড় হয়, বিদেশীরা আসে , চান করে ,পিকনিক করে । আজ ও ফাঁকা । ফরজানা চিৎকার করে বলল, “এই মেয়ে ওদিকে যেও না ’’। কিন্তু ও আরবী ছাড়া আর কিছু জানে না , এত দূর আওয়াজ ও পৌঁছায় না । অসহায় বোধ করল ,দৌড়তে চেষ্টা করল , আর্থাইটিসের ব্যাথা , ভারী শরীর , আর বালির উপর দৌড়োনো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার । সে তার মেয়ে আসমাকে বাঁচাতে পারে নি , চোখের সামনে অঘটন ঘটতে দেবে না । ফরজানা পৌঁছোনোর আগেই এক কমবয়সী পুরুষ মহিলাকে আটকাল , কোথাও হয়তো কাছেই ছিল । ওওফ্ আল্লা! ফরজানা হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছল ,বাধা পেয়ে মহিলা ক্ষিপ্ত।চোখ মুখ ফোলা , খুব কেঁদেছে বোধহয় । পুরুষটি বোঝাতে চেষ্টা করছে তার নিজের ভাষায় । বোধকরি বাংলাদেশী হবে ।ফরজানা মেয়েটির মাথায় হাত রেখে কোমল সুরে বলল, “এ গুনাহ্ , বি্শ্বাস রাখ,আল্লা সব ঠিক করে দেবেন ’’ । মাতৃ সুলভ ছোঁয়ায় মেয়েটি ককিয়ে ওঠল । চাকরী গেছে তার , আজই ফেরত যেতে হবে কেরালায় । ধার দেনা করে বহু কষ্টে ভিসা নিয়ে এসেছিল এই দেশে । ছোট বোনেরা পড়ছে ,সে একমাত্র রোজগেরে । এজেন্সী তাকে এক বাড়িতে আয়ার কাজ ঠিক দেয় । যা মাইনে দেবার কথা,তার থেকে কমই পাচ্ছিল, কার কাছে অভিযোগ করবে?
এখন তাদের ফুল টাইম এর দরকার নেই , দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশী ছেলেটির চোখ ছলছল,করুণ হেসে বলল, “কান্দ বইন,কান্দলে মন হালকা হয় । গরীবের লিগা কেউ নাই ,না জিশাস ,না আল্লা !’’এরা কেউ কারোর ভাষা জানে না, কিণ্তু মানে বুঝতে পারছে ।ছেলেটি বলছে,“ আমারো চাকরী নাই। ভিসা আর রিনিউল হইল না,লুকাইয়া থাকি,পুলিশ ধরতে পারলে ফেরত পাঠাইব ।খুচরা কাম কইরা পেট চালাই।কুন মুখে দ্যাশ ফিরুম ? বৌ পোলাপান রে কি কমু !” ফরজানা মেয়েটাকে নিয়ে ঘরে এল,জল খেতে দিল।কোমল স্বরে বলল,“দোয়া করব তোমার জন্য। ঠিক হয়ে যাবে সব ।’’
দোয়া করতে পারে সে,আর কি করতে পারে!জানেনা কি করে সব ঠিক হবে।যদি আসমা তার কাছে থাকত !
‘যদি’,‘যদি’রা শান্তিতে থাকতে দেয় না ।আসমার-ই বয়সী এই মেয়েটি।আহা,আল্লা তাকে সাহায্য করুন।একমাত্র এক মা–ই পারে এ ভাবে ভাবতে।তা সে যে ভাষাতেই বলুক না কেন!
এটা এক জাগতিক ভাষা ।
বোধকরি সব দুঃখী মানুষরা একাত্ম হয়ে বুঝতে পারে।কোনো দোভাষীর প্রয়োজন হয়না ।
মৌসুমী ভট্টাচার্য, গল্পকার
ওমান
ছবিঋণঃ ইন্টারনেট হইতে সংগৃহীত
৫ই মে ২০১৯ইং