কত বিস্মৃত সময় আগে, কত পথ - নিজের শরীরের চেয়ে দশগুন ওজন নিয়ে একদা সে এই প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে নিজেকে দেখা দিয়েছিল। কেন সেই দেখা দেওয়া, কেন দেখা দিতে না দিতেই নিশ্চুপ, নিস্তদ্ধ হয়ে যাওয়া এই প্রশ্নের উত্তর আজ হাজার বার করলেও, মাথা কুটে মরলেও তার থেকে পাওয়া যাবে না। এই প্রশ্ন, উত্তর এবং তার আবির্ভাবের হেতু সবকিছুই চাপা পড়ে আছে, গেছে তিনশ বায়ান্ন পৃষ্ঠার নিউজপ্রিন্ট কাগজের স্তুপ এবং তিনটে সেলাইয়ের মাঝে।
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে পিঁপড়েটাকে দেখে। শুঁড় দুটোর একটা থ্যাবড়া হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তবে একশ পঞ্চান্নতম পৃষ্ঠার ফ্রেম থেকে আলাদা হতে পারে নি। পিঁপড়ের চোখ দুটো তার দেখতে ভারি কৌতূহলবোধ হলো। ভেতরে কৌতূহলকে অবদমন করতে তার বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা নেই। পাশের বার্নিশ করা বেডসাইড টেবিল থেকে কালো ফ্রেম আর হ্যান্ডেলে বাঁধানো ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে পিঁপড়ের উপরে ধরলো। পিঁপড়ে এই আতশির মাঝে বায়োস্কোপের কালোত্তীর্ণ সিনেমা হয়ে ধরা দিচ্ছে। জানে না, পিঁপড়ের চোখ দেখতে কেমন হয় আর আদৌ সেই নিষ্প্রভ, মৃত চোখ দুটো সে দেখতে পাবে কিনা এ নিশ্চয়তাও সে ভেতরে পাচ্ছে না। আতশি তাকে দেখালো দুটো বিপরীত চিত্র। এক চিত্রে একপাশের একজোড়া পা এখনো সমান দূরত্বেই আছে, স্পষ্ট। যেন এখনই তারা সুড়সুড় করে ফেরোমেনের সাড়ায় সাড়া দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকবে। তার বিপরীত পা জোড়া গার্মেন্টস ভবনের নিচে যেন চাপা পড়ে গেছে। ভগ্নদশায় তারা অবলম্বন থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঝুলছে।
সে দেখা শেষ করে নিরাশ হলো খানিকটা। ভেবেছিলো পিঁপড়ের চোখ কেমন হয় সেই জ্ঞানার্জনের ইচ্ছা আজ মিটে যাবে। ছোটবেলায় পড়া তার একটা গল্প মনে হলো। কুসি মামি একবার হাঁ করেছিলেন বিরাট। তাতে পিঁপড়ে নয়, তবে মশার স্বাদ নেবার বাস্তবতা তিনি উপভোগ করেছিলেন। বলেছিলেন অবাক বিস্ময়ে- এই পুঁচকে কালো মশার ঝাঁজ এত কিভাবে হয়! পিঁপড়ে আর মশা একই গোত্রের সৎভাই। মশা অন্তিম মূহুর্ত পর্যন্ত ডানা নাড়িয়ে ওড়ে আর পিঁপড়ে অন্তিম মূহুর্তের আগে হঠাৎ করে ডানা ঝাপটাবার শক্তি লাভ করে।
পিঁপড়েটা মরে গেছে। তার ঢিপির জন্যে বয়ে নেওয়া খাবার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে 'অনাবিল' শব্দটির জায়গায়। যখন সে প্রান্তর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো দূর গন্তব্যে তখন বোধকরি সে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি জ্ঞানের জমাট সাগরের মাঝে সে একটি ক্ষুদ্র সত্তা। খানিকটা নিউটনের অনুভূতি কি তাকে পেয়ে বসেছিল? নুড়ি কুড়োনোর মতো যে তুচ্ছতা সেই তুচ্ছতা তাকে কি বিন্দুমাত্র হলেও উদ্বেলিত করে তোলে নি? হয়তোবা এসবই তার নিছক কল্পনা। পিঁপড়ের অতসব ভাববার সময় ছিলো না। সে ছিলো নিতান্তই একজন শ্রমিক। তার দায়িত্ব খাবার খোঁজা, বোঝা নেওয়া, রাণীমাতাকে পাহারা দেওয়া।
সে কোন ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো তা বোঝার আগেই সব শেষ। সব শেষ। তাও এতো অনেকদিন আগের কথা। তিনমাস, চারমাস... হবে হয়তো।
ছেলেটা হাজার হাজার কালো ছাপানো হরফের বই বন্ধ করে। পানির তেষ্টা পেয়েছে খুব। আগামীকাল তার এই মোটা বইয়ের ওপর পরীক্ষা নেবেন ভারিক্কি চালের কিছু প্রবীণ ব্যক্তি। তবে বইয়ের সাধ্যি নেই ওসব প্রবীণ ব্যক্তির প্রবীণ চিন্তাধারা নবীন করবার। বইয়ের কিছু শব্দ তার মাথার মাঝে ঝংকার তোলে। যদিও সে বুঝতে পারে না সেই শব্দগুলোর অর্থ। তবে সে ফটোকপি করে রেখেছে। তার নিউরণগুলোতে।
ছাপিয়ে দিলেই হলো!
সে হেঁটে যায় আরো একগাদা বইয়ের ভেতর। তার চারপাশে কোন নারী নেই, নেই প্রেম, নেই সমাজ, নেই কদম ফুল। বাইরে হয়তোবা বৃষ্টি হচ্ছে। তার ওসবে কোন আগ্রহ নেই। পিঁপড়ের সেই সুদূর অতীতে দম ফেটে মারা যাবার বিষয়টা কেন তার অন্তরাত্মায় টোকা দিয়েছে হঠাৎ সে বলতে পারে না। তার সামনে একটি বিশাল মই। সে মই বেয়ে ওঠার চিন্তায় বিভোর। এ চিন্তায় তার স্বপ্নগুলো বাস্তবতার গন্ডিও ছাড়তে পারে না।
সে তার মাকে ডাকে। পানির জন্যে চিৎকার ছাড়ে। টিউবলাইটের আলো তার ঘরটাকে যেরকম আলোকিত করে রেখেছে ঠিক সেরকমই তার গলনালি চিৎকারের আবহে উজ্জ্বল হয়। সে অপেক্ষা করে। সাড়া পাবার। সাড়া আসছে, আসছে এই প্রতীক্ষা করতে করতে সে আর কোন সাড়া পায় না।
অগত্যা তাকে বইয়ের বোঝা আর পাহাড় সম্বলিত ঘরটিকে খানিকসময়ের জন্যে ছাড়া লাগেই। পড়ার ঘরের সামনে দিয়ে একটি করিডোর চলে গেছে। করিডোরের উপরের সিলিং এ দুটো সেপিয়া আলোর বাতি খানিকটা আধো রহস্য দিয়ে জায়গাটা ছেয়ে দিয়েছে। ছেলেটা করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যখন ডানদিকে মোড় নেয় সেখানেই ডাইনিং টেবিল। সেখানেই জগ আর সেখানেই জল।
পানি খেয়ে যখন সে করিডোরে আবার ফেরত আসে তার কানে ভেসে আসে রান্নাঘরে চামচের টুংটাং শব্দ। তার আম্মা-ই যে সেই শব্দগুলোর পেছনের হোতা তাতে কোন সন্দেহ থাকে না তার। খানিকটা রাগও হয়। গলার জোর না শোনবার জন্যে। হেঁটে হেঁটে যখন সে পড়ার ঘরের সামনে এসে পৌঁছায় সে থমকে দাঁড়ায়।
ওদিকেই বাথরুমের নিশানা। আর ওদিকেই ক্লোতারিসের বিদেশি বেসিন। লাগানো আয়না। রিফ্লেক্ট করছে সেপিয়া লাইট। নিজেকে দেখে সে ছুট দেয় আয়নার দিকে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে হতভম্ব হয়ে থাকে। মূর্তিমান ছেলেটির মুখ দেখা যাচ্ছে না দুটো মলাটের কারণে। পেছন থেকে দুটো মলাট কবে কোন সময়ে ঘাড়ের সাথে লেগে গেছে সেটার সঠিক সময়কালও সে জানে না। হয়তোবা ক্রমে ক্রমে সেই মলাট দুটো তার ঘাড় চেপে ধরেছে। সে জানতো না। এখন জেনেছে। আর ক'দিন পর দুটো মলাট এক মলাট হয়ে যাবে। সপাটে বন্ধ হয়ে যাবে বই। আর সে নিজেও। অনেকটা সেই পিঁপড়ের মতো। জানেও না, জানবেও না। শুধু মুখটা বন্ধ হয়ে যাবে। শ্বাস নিতে পারবে না। তিন মিনিটের মাথায় শ্বাস নেবার প্রয়োজনও বোধ করবে না।
এসব ভেবে সে আতঙ্কিত বোধ করে। চিৎকার ছাড়ে আরেকবার- আম্মু!
মুহাম্মদ তৌকির হোসেন, বাংলাদেশ
ছবিঋণঃ ইন্টারনেট হইতে সংগৃহীত
৫ই মে ২০১৯ইং