Type Here to Get Search Results !

স্বপ্নের বাড়ি ও কান্না" ......বাংলাদেশ থেকে এস বি এ নিলয়

আজ গুনে গুনে ৩০ দিন পার হল নতুন বাড়িতে উঠেছি। জীবনটা স্বপ্নের মতই হতো যদি না অপূরনীয় দুর্ঘটনা না হতো। যে দূ্র্ঘটনা আমার সারা জীবনের কান্না। সেই প্রথম দিনে নিজের কেনা বাড়িতে ওঠার কথা এখনো আমার মনে লেগে আছে কি অদ্ভুত স্মৃতি। আমার জন্মের কয়েক বছর পর থেকে ২৫ টি বছর কেটেছে আমার মায়ের ভাড়া করা বাড়িতে। আমার জন্মের আগেই বাবা মারা যান এবং আমি যখন কিছুটা বড় হয়ে বুঝতে শিখলাম তখন সব কথা মায়ের মুখে আর দাদীর কাছে শুনেছিলাম। মা আর বৃদ্ধ দাদী ছিল আমার একমাত্র অবলম্বন। তারপর ছোটবেলা থেকেই বাবা মারা যাওয়ার পর মা বাবার ভিটে বাড়িতে খুব কষ্ট করে থেখেছেন শ্বশুরবাড়ির অন্য কিছু দুষ্ট লোক আর আমার চাচা ও চাচী গুনগুনানি প্রতিনিয়ত শুনতে হতো তাকে। বৃদ্ধা দাদী ও প্রতিবাদ করতে পারেনি ছেলে আর ‌বৌয়ের আচরণে অসহায়ত্ব প্রকাশ করা ছাড়া শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন।
মামাদের সহযোগিতায় অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা় আর তীব্র বাসনায় মা আমাকে আর বৃদ্ধা দাদী কে নিয়ে এই শহরের ভাড়া বাড়িতে উঠে তারপর সেলাইয়ের কাজ করে অতি কষ্টের আমাকে ক্রমশ বড় করে তুলে। আমি তখন প্রাইমারি লেবেল শেষ করি হঠাৎ একদিন দাদী ও আমাদের রেখে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তারপর হাইস্কুল ও কলেজের পাঠ শেষ করে চাকরি পেয়ে তাই সেই থেকে মায়ের সাথে এই সংসারের হাল ধরা। একদিন মা তার মনের লুকায়িত স্বপ্নের কথা আমাকে বললো যেনো এই শহরে আমার একটি ছোট্ট বাড়ি থাকে যে বাড়িতে সে তার পছন্দ মতো লাল টুকটুকে বৌ নিয়ে আসবে । ছোটবেলা থেকেই কোন দিন মায়ের অবাধ্য হয়ে কোন কাজ করিনি। যেমন কথা তেমনি কাজ মায়ের স্বপ্নের কথা বুকে নিয়ে কটা বছর পার করলাম মামাদের পরামর্শ আর সহযোগিতা নিয়ে ক্রমশ কাজ শুরু করে দিলাম। বাড়ি বেচা-কেনা ওয়েবসাইটে অনেকগুলোতে খোঁজ নিলাম। বিভিন্নভাবে এজেন্ট ধরলাম কিন্তু যে কটা বাড়ি পেলাম তাতে বাড়ি পছন্দ হলে হয়তো বাজেট হয়না আর বাজেট হলে বাড়ি পছন্দ হয় না। তার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন আমার বাড়িওয়ালার ছেলে তাহসিন মামা আমাকে জিজ্ঞেস করল- সিফাত তুমি নাকি বাড়ি কেনার জন্য খোঁজ করছো? আমি তাকে বললাম- হ্যাঁ মামা যদি আপনার জানাশোনা থাকে কোন ছোট-খাটো বাড়ির খোঁজ তাহলে একটু সহযোগিতা করুন। হঠাৎ তাসিন মামা বলল- তার খোঁজে ছোট্ট একটি বাড়ি আছে পুরনো কিন্তু তোমার খুব পছন্দ হবে এবং দামটা একটু কম বাজেটের মধ্যে আছে, তুমি চাইলে দেখতে পারো। তিনি আরো বললেন বাড়ির মালিক এখানে থাকেনা আমি যদি বলি তাহলে তিনি আসবেন। আমি প্রথমে ভাবলাম যে পুরনো একটা বাড়ি যদি কিছুটা সস্তায় পাওয়া যায় তাহলে এটা কিনে নেওয়া যেতে পারি তাহলে মোটামুটি ভালই হয় তখনই আমি বললাম- ঠিক আছে মামা অসুবিধা নেই আপনি ওনার সাথে কথা বলে আমাকে জানান আমি আপনার সাথে যাব। যেমন কথা তেমন কাজ তাসিন মামা আমাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে বাড়ি টি দেখাশোনা তারপরে খোঁজখবর সর্বনেশে দরদাম ঠিক এবং একসময় বাড়িটি কিনে নিলাম। মা অনেক খুশি কারণ এতো দিন পরে লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছে ছেলে। মা আর আমি ঠিক করলাম ফেব্রুয়ারি মাসের এক তারিখে বাড়িতে ওঠবো। তার আগে পুরো বাড়িটাকে টুকটাক কিছু কাজ করে নিলাম রং করার পরে মনে হচ্ছে খুবই সুন্দর একটি বাড়ি এবং আমিও খুব আনন্দিত যে তাসিন আমার কারনে এত অল্প দামের বাড়িটি পেয়ে গেলাম। বিভিন্ন ধরনের গাছ মা লাগাতে শুরু করলেন ঘরের বাইরে দরজার দুপাশ বরাবর দুটো জবা ফুলের গাছ লাগিয়েছেন। বাসা বদলানোর বিড়ম্বনা কখনো আমাকে স‌ইতে হয়নি এই প্রথম কিছু করা আজও আমার বন্ধু ভাগ্য এবং আমার মামা রিদুল ঘর গোছানো থেকে শুরু করে জিনিসপত্র আনা নেয়ার কাজে সহযোগিতা করছে।গত সাত দিন হলো রিদুল মামা আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে আমি ও রিদুল মামা দুজনে এক বছরের বড় ছোট। সারাদিন কাজ করার পর ক্লান্ত হয়ে রাত্রে খাবার খেয়ে একটু বাইরে হাঁটছিলাম আমি ও রিদুল মামা তারপর ঘরে ফেরা আর দুষ্টুমিতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেছে টের পাইনি। এদিকে মা ততক্ষণে সারাদিনের খাটুনিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে । কিছুক্ষণ পর আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝরাতে হঠাৎ শরীরে ঠান্ডা অনুভব হলো এবং ঘুম ভেঙে গেলো। গায়ে কাঁথা জড়িয়ে নিলাম এবং মোবাইল ফোনের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তখন তিনটা বাজে। ঘরের জানালা দুটোর খোলা বাতাসে পর্দা গুলো উড়ছে হঠাৎ ডান দিকে তাকিয়ে দেখি মা চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কেমন জানি এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে মা বাইরে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। মনে মনে ভাবলাম হয়তো আজ বাবার কথা মনে করছে এই ভেবে কিছুক্ষণ চুপ করে র‌ইলাম । দশ মিনিট দেখলাম তার পর মাকে ডাক দেই কোন জবাব নেই। বিছানা থেকে নেমে আমি মাকে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে মা! মা আমাকে কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। পরদিন থেকে মা কেমন জানি হয়ে গেল সারাদিন চুপচাপ থাকে বুয়া ও আমার সাথে তেমন কথা বলে না। হঠাৎ মায়ের এমন আচরণে আমার একটু মনে সন্দেহ হলো । তাহলে মায়ের কোনো অসুখ হলো নাতো যা আমাকে বলতে পারছেনা । তারপর থেকে প্রতিদিন মা মাঝরাতে জানালা দিয়ে বাইরে চুপচাপ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রায় রাতে ব্যাপারটা আমি খেয়াল করেছি কিন্তু কেন এর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তারপর একদিন ঘটনা অন্যরকম এক আসল দুর্ঘটনা় আমি সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি মা একলা ঘরে চুপচাপ শুয়ে আছে বুয়া ও বাড়িতে নেই। প্রথমে কাছে গিয়ে মাকে ডাকলাম কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে হাত ধরে টান দিয়ে বুঝলাম মা আর নেই । আমাকে একাকী ফেলে সেও পরকালে চলে গেলেন। আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। আজ আমাকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিল আমার পৃথিবীতে আর কেউ রইল না। জন্মের পর বাবাকে কখনো দেখিনি মা ই ছিল আমার বাবা এবং মা। সে ছিল আমার একমাত্র ভরসা, যে ভরসায় আমি পথ চলতাম আজ সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। এই কঠিন বিপদের সময় আমার বন্ধু ভাগ্য আমাকে সান্তনা দিয়ে আগলে রেখেছে । তারপর থেকে প্রতিদিন অফিস থেকে বের হওয়ার সময় দরজার কাছে মায়ের লাগানো জবা ফুল গাছ দুটো দেখি আর ঠিক তখনই মায়ের কথা খুব মনে পড়ে।
প্রতিদিনের মতো আজ রাতেও ঘুমানোর পর হঠাৎ মনে হলো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল এবং মনে হল কে যেন ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে। আমি দরজা খুলে দেখলাম ঘরের বাইরে মরুভূমির মতো দেখা যায় এবং মরুভূমিতে প্রচন্ড বাতাস ব‌ইছে তখন আমি বাইরে বেরিয়ে আসলাম কতক্ষণ হাঁটার পর দেখি সামনে আমার মা দাঁড়িয়ে আছে । মা আমাকে ডাকছে আর আমি তার দিকে এগিয়ে আসছি এমন সময় হঠাৎ মনে হচ্ছে মরুভূমি আমাকে পিছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করছি বাঁচাও আমাকে বাঁচাও ! ঘুম ভেঙে গেল দেখি আমি বিছানায় শরীর কাঁপছে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম আর তখন মনে হলো এতক্ষণ যা দেখলাম এটা একটা নিছক স্বপ্ন ছিল। আমি এই জঘন্য স্বপ্নের কথা বন্ধু ভাগ্যকে শেয়ার করলাম। সে আমাকে বলল তুই তোর মার কথা খুব ভাবিস তাই হয়তো স্বপ্ন দেখেছিস। চিন্তা করিস না ক'দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমিও এই ভাবেই সান্তনা নিলাম । তার ঠিক পরের দিন ঘুমানোর পর হঠাৎ দেখি আমি কোন এক জঙ্গলে বসে আছি আর সামনে দাঁড়িয়ে আমার মা । সে আমাকে ডাকছে আমি সামনের দিকে এগোতে চেষ্টা করছি আর কে যেন আমাকে পিছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে । আমি চিৎকার করে কাঁদছি আমাকে বাঁচাও আমাকে বাঁচাও বলে সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি এবার কিছুটা সন্দেহ হল, মনে ভয় ও করছিল প্রতিদিন একই স্বপ্ন মাও কি এরকম স্বপ্ন দেখতেন তাহলে যার জন্য মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো!একটা প্রচন্ড ভয় কাজ করতে লাগল একাকী বাড়িতে কাউকে শেয়ারও করতে পারছি না । তাই এবার চিন্তা করলাম আজ রাতে আর ঘুমাবো না জেগে থাকবো দেখি কি হয। কিছুক্ষণ ফ্লোরে পায়চারী করে তার পর রাত বাড়ার সাথে সাথে ছাদে বসে মোবাইলে গল্প পড়ছিলাম। আচমকা মনে হচ্ছিল কে যেন আমার চোখ বেঁধে দিয়েছে সামনে সমুদ্র এবং পিছন থেকে হঠাৎ কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সমুদ্রের জলে। প্রচন্ড জোর করে চোখ খুলে দেখি আমি বাগানের মধ্যে দুটো বালির বস্তার উপরে পড়ে আছি । আমি কিছুটা অনুমান করছি যে আমি ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেছি। ভয়ে কাঁপতে লাগলাম আর ভাবলাম আমি কি সত্যি এখন মারা যাব! এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি ভাগ্য কে ফোন দিয়ে সব বললাম। ভাগ্য তাড়াতাড়ি করে মসজিদের ইমাম সাহেব কে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসলো তারপর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পুরো ঘটনাটা তাদেরকে খুলে বললাম। ইমাম সাহেব হঠাৎ করে বিড়বিড় করে কি যেন দোয়া পড়তে শুরু করলেন মাঝে মাঝে কিছু শুনতে পেলাম আর মাঝে মাঝে আমার গায়ে শুধু ফু দিতে লাগলেন । তারপর তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে র‌ইলেন হঠাৎ কয়েক বার পুরো বাড়িটির চারিদিকে ঘুরলেন এবং আমাকে বললেন শীঘ্রই তোমাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ এ বাড়িতে অনেক ভয়ানক ভুতের পেআত্মা রয়েছে আর তাকে শেষ করতে গেলে আবারো কারো মৃত্যু ঘটতে পারে এমনকি তার নিজেরও। এবার ইমাম সাহেব আমার কাছে কিছুটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন ঐ জবা ফুলের গাছ কে লাগিয়েছে? আমি বললাম আমার মা। ইমাম সাহেব মৃদু হেসে বললেন- বাবা একে বলে মাতৃত্বের টান। তিনি মরে গিয়েও জবা গাছের রূপ ধরে তোমাকে পেতাত্মার হাত থেকে এমনকি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করছে। এই বাড়িতে অবস্থান করা প্রেতাত্মা তোমার মাকে নিয়ে গেছে পরকালে। তাই তোমাকে শীঘ্রই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। খুব ভয় করছিল বাকি রাতটুকু বন্ধু ভাগ্য আমাকে জড়িয়ে ধরে কাটিয়ে ছিল। আমি পরের দিন ভাগ্যোর সহযোগিতায় ইমাম সাহেবের কথামতো বাড়ি ছেড়ে দেই, বাড়ি ছাড়ার সময় বাড়ির গেইটে তালা দিয়ে বাইরে এসে গাড়িতে বসে শেষবারের মতো বাড়িটাকে দেখবো বলে বাড়ির ভেতরের দিকে তাকালাম হঠাৎ দেখছি মা দরজার কাছে জবা গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে হাসিখুশিতে আমাকে বিদায় জানাচ্ছে । ঠিক তখনই মায়ের পেছন থেকে ঘন কালো ধোঁয়া এসে তাকেকে অদৃশ্য করে দিল আমি আর মাকে দেখতে পেলাম না। ঠিক তখনই গাড়ি ছেড়ে দিল আর আমার চোখের জল গড়িয়ে নিচে পড়তে লাগল।

এস বি এ নিলয় শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণী ঢাকা, বাংলাদেশ

৮ই এপ্রিল ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.