বিলাতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে ইংরেজ জাতির যে গুনটির প্রতি গান্ধীজির সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হন তা হচ্ছে তাদের পরিচ্ছন্নতা বোধ । রাস্তাঘাটে ময়দানে কোথাও এক বাজে কাগজ খুঁজে পাওয়া যাবে না । ঘরদোর সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । তুলনায় তার দেশবাসী যেন নোংরার মধ্যেই থাকতে বেশি ভালোবাসে । কিন্তু এই অপরিচ্ছন্নতা থেকেই যত রোগের সৃষ্টি । দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন গান্ধীজি রাজনীতি করছেন তখন শ্বেতাঙ্গরা অভিযোগ বলল যেভারতীয়রা অত্যন্ত নোংরা স্বভাবের এবং নোংরা পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে। গান্ধীজী এই সত্যতা অস্বীকার করলেন না। তিনি স্বজাতীয় দের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে উপদেশ দিলেন। কিন্তু স্বদেশীরা তার এই উপদেশ মানল না । উপরন্তু অভিযোগ তিনি রাজনীতি করছেন করুন, কিন্তু ভারতীয় দের জীবন যাপন নিয়ে মাথা না ঘামান । ভারতে এসে দেখলেন দেশের মানুষের প্রকৃতি একই ধরনের । তখন দেশে প্লেগ এর প্রাদুর্ভাব চলছে। অন্য বহু জীবাণুর মত প্লেগের জীবাণু ও নোংরার মধ্যে দিয়ে বিস্তার লাভ করে। গান্ধীজী নিজেই লেগে পড়লেন পরিষ্কার করার কাজে। নামলেন রাজকোট শহরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে । ঘুরে ফিরে দেখলেন যারা অচ্ছূত তাঁরাই সবচেয়ে সাফ সুতরো থাকে । তাদের কুঠির গুলো সামান্য হলেও একেবারে ঝকঝকে তকতকে। তুলনায় যারা অবস্থাপন্ন উচ্চজাতি তারা একে বারেই নোংরার মধ্যে থাকে ।বড় বড় বাড়ী , কিন্তু দোতলায় কোনো নর্দমার ব্যবস্থা নেই ।সেই সব ঘরে মেয়রদের আসতে দেয় না । বাড়িতে যা পায়খানা, প্রস্রাব খানা আছে তা নরককুন্ড ।মেথর না এলে সেগুলো দিনের পর দিন নোংরা পরে থাকে ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতেই ১৯০১ সনের শেষের দিকে কলকাতায় এলেন কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে । কাজের মানুষ তিনি শুধু মাত্র প্রতিনিধি হয়ে খুশী নন, অধিবেশনের জন্য কিছু কাজ করতে চান ।ভূপেন্দ্রনাথ বসু অভ্যর্থনার সমিতির সভাপতি জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন । জানকীনাথ তাঁকে চিঠি পত্র দেখার কাজ দেন । এদিকে রিপন কলেজে ছাত্রবাসে থাকার ব্যবস্থা হয় । সেখানে উঠলেন গান্ধীজী । ছাত্র বাসের পায়খানা বাথরুম চূড়ান্ত নোংরা, ব্যবহারের অযোগ্য। সেই অপরিচ্ছন্ন পায়খানা বাথরুম গুলিকে সাফসুতরো করার কাজে লেগে গেলেন গান্ধীজী । বিলিতি ব্যারিস্টার কিনা মেথরের কাজ করছে । কিন্তু গান্ধীজী বলেন নোংরার মধ্যে থাকার চেয়ে নিজে নোংরা পরিস্কার করা মঙ্গলজনক ।
গান্ধীজী গোপালকৃষ্ণ গোখলে কে নিজের রাজনৈতিক গুরু বলে মেনে নিয়ে ছিলেন । গোখলে জি দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তার সত্যাগ্রহ আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছিলেন । দেশে ফিরে গান্ধীজী গোদরেজ সার্ভেন্টস অফ ইন্ডিয়া সোসাইটিতে যোগ দিলেন । কিন্তু সোসাইটি ভবনে গিয়ে দেখলেন পায়খানা বাথরুম অত্যন্ত নোংরা । তিনি নিজেই পায়খানা বাথরুম পরিষ্কার করতে গেলেন । সার্ভেন্ট অফ ইন্ডিয়া চলত মিল মালিকদের অর্থে । পায়খানা নোংরা হলে পরিষ্কার করবে ঝাড়ুদার । ঝাড়ুদার না আসলে ? নোংরার মধ্যে থাকতে হবে । গান্ধীজীর এই ধরনের উদ্ভট কাজ সার্ভেন্ট অফ সোসাইটি ভদ্রলোকদের পছন্দ নয় ।তারা গোখলেকে বললেন , আপনার ভক্তকে বলুন সোসাইটির সদস্য হয়ে ঝাড়ুদারের কাজ করা যাবে না । আমাদের কাজ দেশের সেবা করা । ঝাড়ুদার গিরি করলে সোসাইটির সদস্য থাকা যাবে না ।
গোখলের পরামর্শে সোসাইটি ভবন ছেড়ে দিলেন । গান্ধীর প্রস্তাবিত যাবতীয় কাজকর্ম সোসাইটি সাহায্য পাওয়া যেত । হরিদ্বারে কুম্ভ মেলা হচ্ছে , গান্ধীজী স্থির করলেন সেখানে সেবা কাজ করবেন।মেলা প্রাঙ্গণে বেশ কয়েকদিন ধরে বহু লোকের সমাগম হয়। মেলায় যাত্রীদের মলমূত্র স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে । গান্ধীজী তার ফিনিক্স স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে কুম্ভ মেলা সাফাই করতে লেগে গেলেন । সার্ভেন্ট অফ ইন্ডিয়া সোসাইটির ডাক্তাররা লাগলো সেবা কাজে। পরবর্তীকালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার জন্য এই ধরনের কাজ আর করে উঠতে পারেননি। কিন্তু তার আশ্রম গুলো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সর্বদা দৃষ্টিনন্দন ছিল। আর ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত পরিছন্নতা বজায় রাখতেন । তাঁর আট হাত ধুতি থাকতো দুধের মত সাদা ।
এখন গান্ধীজীর ছবি নোট ছাপানো হয় কিন্তু গান্ধীজীর বহু সদগুণের মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও ছিল তীব্র দৃষ্টি । অথচ পরিচ্ছন্নতায় সভ্যতার মাপকাঠি । কোন জাতি কত সভ্য তার পরিমাপ জল ও সাবান ব্যবহার এর মধ্যেই । যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করা ভারতীয়দের পরিচায়ক ঘটনা । ধর্মশালা গুলোতে দেখা যায় মলমূত্র ত্যাগ করে কেউ জল ঢালে না। এই বিষয়ে বললে উত্তর আসে আমি কি মেথর ? দূর পথগামী রেলে দেখা যায় পায়খানা বাথরুমে জল ফুরিয়ে গেলে নতুন করে জল দেওয়ার ব্যবস্থা ঠিকমতো কার্যকর হয় না । ফলে পায়খানা বাথরুম নরককুণ্ড হয়ে থাকে দুরপথ গামী রেল যাত্রায় । অথচ বাথরুমে জল থাকা বেশি প্রয়োজনীয়। শহরের রাস্তায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বাথরুম না থাকার জন্য পথচারীদের বিশেষ করে মহিলাদের প্রভু তো কষ্ট হয় । শহরে সিনেমা থিয়েটার হল থাকার চেয়ে পায়খানা বাথরুম থাকা অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। এখনো গ্রামের মধ্যে বহু বিদ্যালয় আছে যাদের কোন পায়খানা ও বাথরুমের ব্যবস্থা নেই । এই রকম বহু বিদ্যালয়ে বালিকারা শিক্ষা গ্রহণ করে। ভারতবর্ষের মাঝখান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে । সেই জন্য ট্রপিক্যাল কান্ট্রি বা ক্রান্তিয় দেশ বলে ।ক্রান্তিয় দেশে বহুধরনের রোগ হয় যা শীতকালীন দেশে হয় না । আমাদের দেশে সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ হচ্ছে আমাশয় ।আমাশয় থেকে হয় না এমন রোগ খুবই কম আছে । আমাশয় মানুষের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দেয় । মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে ব্যাপকভাবে । আমাশার জীবাণু অ্যামিবা বিস্তারের প্রধান কারণ অপরিচ্ছন্নতা। শৌচ কার্য করে ঠিকমতো পরিচ্ছন্ন না হওয়া । শৌচ কার্য করে ভালোভাবে 3-4 বার হাত দেওয়া উচিত সাবান দিয়ে । কিন্তু এই ধরনের কার্য আমরা করিনা শৌচ কার্যের পরে । ফলে নানা রোগব্যাধির সঙ্গে লড়াই করতে করতে আমাদের ও সম্পদ নষ্ট হয় ।হয় প্রান হানি ।
এই অর্থ , ও সম্পদ ও প্রানের রক্ষা হয় , যদি আমরা আমাদের স্বভাবের পরিবর্তন করি আর দিবারাত্র স্মরণ করি সেই মানুষের ছবি, যিনি বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার হয়েও ঝাঁটা বালতি হাতে রিপন কলেজের ছাত্রাবাসে নোংরা পায়খানা ও প্রেসাব খানা পরিষ্কার করতে নিরলসভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন ।
পুলক ঘোষ চৌধুরী
অখিল ভারতীয় কনভেনর
রাম মন্দির সুরক্ষা মঞ্চ
বারাসাত,উত্তর ২৪ পরগণা
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১৭ই মে ২০২০