পত্রালাপে তিনি ত্রিপুরার বাইরে এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও যোগাযোগ রক্ষা করে যেতেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণাণ পণ্ডিতজিকে খুব ভালোবাসতেন। একবার রামনবমী উৎসবে যোগ দেবার জন্য দিল্লী থেকে স্বয়ং কমলাপতি ত্রিপাঠি তাঁকে আমন্ত্রনপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেই উৎসবের সভাপতি ছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।কতটা সম্মানসূচক শব্দে যে ঐ পত্র লেখা ছিলো তা না পড়লে বলে বোঝানো যাবেনা। এছাড়া প্রেসিডেন্ট কেনেডির সাথেও তাঁর প্রায়শই পত্রালাপ হতো।ত্রিপুরার কৃতি সন্তান পণ্ডিত প্রবর গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা এমনই একজন বর্ণময় এবং বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন, রাজসভা পণ্ডিত হয়েও ছিলেন গণ আন্দোলনের শরিক। আবার রাজন্য সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও তাঁর আকুলতা ছিলো স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য। আর সেইজন্যই আমরা দেখি যে, তিনি যেমন একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে ত্রিপুরায় আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তেমনি ত্রিপুরার গণ আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি বীরেন দত্ত, ঠাকুর প্রভাত চন্দ্র রায়, দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত, বংশী ঠাকুর প্রমুখদের নেতৃত্বে ১৯৩৮ সালে গড়ে ওঠা জনমঙ্গল সমিতিতেও নিজেকে যুক্ত করে মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন।তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি বুদ্ধি ও বক্তব্যের কাছে বড় বড় পণ্ডিতদেরও মাথা নত হয়ে যেতো শ্রদ্ধায়। মনে হতো কোন এক উচ্চদর্শন চিন্তায় তিনি সবসময় মগ্ন থাকতেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি অপরিসীম। তিনি নিজে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। অথচ যেকোনো রাজনৈতিক দল সম্মান জানিয়ে তাঁকে ডাকলে তিনি সেখানে যেতেন এবং তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী বক্তব্য রাখতেন অকাট্য যুক্তিতে। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টিও পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মাকে তাদের সভায় ডাকতেন আবার কংগ্রেস তো তাঁকে সব সময়েই ডাকতেন। এই নিরহঙ্কার পণ্ডিত মানুষটির বাংলা, ইংরেজি এবং সংস্কৃত ভাষায় ছিলো অগাধ পাণ্ডিত্য। এছাড়া প্রাচ্য পাশ্চাত্য দর্শনেও তাঁর ছিলো অসাধারণ পাণ্ডিত্য।
তাঁকে অনেকেই ত্রিপুরার দাদাঠাকুর বলে আখ্যায়িত করেন।।বার্নাড শ" ছিলেন তাঁর আদর্শ।তৎকালীন মন্ত্রীসভার সদস্যরা কিংবা খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা তাঁকে একা পথ চলতে দেখলেই গাড়িতে করে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করতেন।কিন্তু তিনি পথের পথিক হয়েই চলতে পছন্দ করতেন।তাকে রিক্সায়ও উঠতে দেখা যায়নি।পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মার মত সুবক্তা খুব কম দেখা যায়।একবার কলকাতার মনুমেন্ট ময়দানে একটি বিরাট জনসভা হয়েছিল এবং ত্রিপুরার প্রতিনিধিত্ব করতে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল।সেদিন তাঁর বক্তব্য ও বাচনভঙ্গিতে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়েছিলেন।কলকাতার সব পত্রিকায় তাঁর বক্তব্য উচ্চ প্রসংসিত হয়েছিল।গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা'র গন্তব্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ এর বাড়ি থেকে শুরু করে যেকোন হত দরিদ্রের বাড়ি হতে পারে।তাঁর উপস্থিতিতে সবাই মন থেকে খুশী হতেন।১৯৩৯ সালের ১৫ই এপ্রিল দেশবিদেশের প্রখ্যাত গুণীজনদের সমাবেশে ঋদ্ধ 'বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন'-এ ত্রিপুরা থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন রাজ্যের কিংবদন্তি দার্শনিক পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা।কিংবদন্তি সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার একটি মূল্যবান লেখনীতে জ্ঞানপুরুষ পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা'র ভূয়সী প্রশংসা করেন।মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদের অসাধারণ ধীশক্তির কথা অনুমান করে রাজার দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে।মূলতঃ স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্র ধরেই সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র বসু কিংবা আবুল কালাম আজাদের মতো দেশবরেণ্য নেতাদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা।
ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং সর্বকালের সেরা দার্শনিক
ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের সঙ্গে পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ এর ছিলো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক।
পাশাপাশি তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি এর সাথে নানা বিষয়ে চিঠিপত্রের
মাধ্যমে যোগাযোগ ছিলো রাজ্যের গর্ব পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ এর।
১৯৫২ সালে দেশের প্রণম্য ব্যক্তিত্ব শ্যামাপ্রসাদ
মুখার্জি'র উপস্থিতিতে বিশেষ মঞ্চে অন্যতম বক্তা হিসেবে পন্ডিত
গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা সুখ্যাতি অর্জন করেন।ত্রিপুরার সংবাদ
জগতে,সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মার অবদানের কথা শ্রদ্ধার
সঙ্গে স্মরণীয়।আগরতলায় সেকালে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থানে সাহিত্যের সাপ্তাহিক
আড্ডা বসতো। সেইসব আসরে তথা সাহিত্য-বাসরে গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা নিয়মিত যোগদান
করেছেন। নিজের লেখা প্রবন্ধ পাঠ করে শুনিয়েছেন।১৯৪৪
খ্রিস্টাব্দে পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মার ‘নবজাগরণ’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। যৌথ
সম্পাদনায় ছিলেন পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা ও নরুল ইসলাম। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
ওনারাই সম্পাদনা করেছেন। মোটরস্ট্যান্ডের ‘ছাপিয়া প্রেস’ থেকে ছাপা হতো এই পত্রিকাটি। রাজমন্ত্রী রানা বুধজং বাহাদুর ছিলেন এই পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক। অসাধারণ স্মরণশক্তি
তথা ধীশক্তির অধিকারী গঙ্গাপ্রসাদ ভট্টাচার্য শর্মা ছিলেন যেন জীবন্ত গ্রন্থাকার।
তাঁর কাছ থেকে অনেকেই বহুকিছু জেনে নিতেন। উইলিয়াম সেক্সপীয়ার, শেলী, বায়রন থেকে
বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্র-নজরুল সবার লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। পড়ে শুনিয়েছেন। নজরুল
ইসলাম তখন WHIP বা চাবুক নামে একটি ইংরেজি পত্রিকারও সম্পাদক। এই
পত্রিকাতেও পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা’র ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধ ও সংবাদ প্রকাশিত
হতো। জাগরণ ও সারথী পত্রিকাতে লিখতেন বাংলাভাষায় নানা অনুভব ঋদ্ধ প্রবন্ধ। ‘রবি’
পত্রিকাতেও লিখেছেন।১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি আগরতলায় এসে
উমাকান্ত মাঠে বক্তৃতা দিলেন। একই বছর দুর্গাচৌমুহনীতে কমিউনিস্ট নেতা বীরেন দত্ত
ভাষণ রাখলেন। উভয়স্থানেই অন্যতম বক্তা ছিলেন পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা। সভার সংবাদ
ও পত্রিকাগুলিও পাঠিয়ে দিলেন। নির্ভীক, নিরপেক্ষ সাংবাদিক সত্ত্বার জন্য পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মার খ্যাতি ছিলো। তখন পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরী গড়ার প্রতিযোগিতা
চলছিলো। এমনই সুসময় ছিলো সেকালটা। বই পড়ার অভ্যেস ছিলো বহু সাহিত্যরস পিপাসু মনের।
মগড়া থেকে এসে রাজেন্দ্র দে বর্তমান ওরিয়েন্ট চৌমুহনীতে জায়গা নিলেন। সেখানেই
গড়লেন ‘তরুণ লাইব্রেরী’। দেখাদেখি গড়া হলো প্রভাতী লাইব্রেরীও। দুটি ক্ষেত্রেই
গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা’র পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো। শচীন্দ্রলাল সিংহ, প্যারামিঞা, প্রফুল্ল
সেনগুপ্ত প্রমুখ বিদ্বজনদের বাসভবনে সাহিত্যের আসর বসতো। সবখানেই মধ্যমণি ছোটবড়
সকলের ‘গঙ্গাদা’। সেইসব আড্ডায় রবীন সেনগুপ্ত, রমাপ্রসাদ দত্ত, সুবিমল রায়,
অধ্যাপক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সহ অনেকেই যোগ দিয়েছেন। স্বাধীনোত্তর কালে
ত্রিপুরার সাহিত্য, সংস্কৃতি, যাত্রা, নাটকে জোয়ার আসে। নানা মুখপত্র ও প্রতিষ্ঠান
গড়ে উঠে। পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা’র সমুদার সহযোগিতা পেয়েছে বিশেষ করে আগরতলার
নানা প্রতিষ্ঠান ও মুখপত্র। তাঁর বাগবৈদগ্ধ্য, চিন্তাচেতনার মৌলিকত্ব, ভাষা ও
ভাবের গাম্ভীর্য, সূক্ষ্মবিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা সকলকেই মুগ্ধ করেছে। এইসব গুণাবলী
ভাষাতত্বে সুপন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা’র নানা প্রবন্ধে প্রতিভাত হয়েছে। তাঁর
উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলি হলো—‘পূর্ণাঙ্গ মনুষ্যত্বের সিদ্ধান্ত সাধক স্বামী
বিবেকানন্দ’, ‘নেতাজী সুভাষ’, ‘গণতন্ত্রের ফলিত ব্যর্থতা’ প্রভৃতি। ১৯৪৫
খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২ বছর পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা’কে
মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর আগরতলা পুরপরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত
করে দায়িত্ব দেন। এই দুই বছর তিনি সাফল্যের সঙ্গে পুরপরিষদ পরিচালনা করেন এবং
যথাসাধ্য প্রয়াসের দ্বারা আগরতলাবাসীর নাগরিক জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য দানে প্রশংসা
লাভ করেন। তিনি তৎকালে ত্রিপুরা সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি বিভাগে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা
ছিলেন।পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা"এই একটি নাম আজ
শুধু ইতিহাস নয়। রাজ্যের সর্ব অংশের মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসায়
আজও সমান ভাবে উজ্জ্বল। কেন তিনি আমাদের গর্ব-সম্মান-অহংকার-আমাদের ঐতিহ্য তা বলতে গেলে একটি
বড় গ্রন্থপাঠ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।১৯৮৩ সালের ২০ জুন এই মহান জ্ঞান তপস্বীর প্রয়াণ ঘটে।‘ A man lives not in years but in deeds কথাটি সর্বাংশে সত্যি।মানুষ
তার কৃতিত্বের জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকেন।রাজন্য যুগের রাজা মহারাজা থেকে শুরু করে
ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির পর ত্রিপুরা সরকারের খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গও পন্ডিত গঙ্গা প্রসাদ শর্মার পাণ্ডিত্যের প্রসাদে নন্দিত হয়েছে।ত্রিপুরার ইতিহাসের পাতায়
তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।গ্রন্থনা ও সম্পাদনাঃ শান্তনু শর্মা
প্রধান সম্পাদক
আরশিকথা
## পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা সম্পর্কিত এইসকল মূল্যবান তথ্যদান করার জন্য শর্মা পরিবারের তরফে ত্রিপুরা রাজ্যের প্রথিতযশা এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক,শিক্ষাবিদ,লেখক এবং সাংবাদিকগণের প্রতি অবনত মস্তকে কৃতজ্ঞ থাকলাম।
২০শে জুন ২০২০