ক'দিন বাদে রাণীকে দেখে কি বলবে সম্রাট বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ রাণী এসে ওকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো । আরে গলাটা ছাড়ো আর বলো কি হয়েছে? অঝোরে কাঁদছে আর বলছে,সব শেষ, সব শেষ হয়ে গেলো!সম্রাট ,কি শেষ হলো খুলে বলো, ভালো লাগছে না! আমি বলতে পারবো না! চাঁদনি ....!কি হয়েছে চাঁদনির বলো না। আসলে চাঁদনি বলতেই সম্রাটের বুকে একটা জোর ধাক্কা লাগলো যেন । কারণ ওদের তিন বন্ধুর একজন হলো চাঁদনি । কদিন ধরে খুব খারাপ লাগছিল বলছিল ফোনে । একঝাটকায় সম্রাট রাণীকে সামনে টেনে নিয়ে বলল,তুমি বলবে নাকি কেঁদেই যাবে!রাণী এতক্ষণে হাতের মুঠোয় চেপে ধরা কাগজটা চোখ বন্ধ করে সম্রাটের দিকে ধরল....!
#সম্রাট কাগজের ভাজটা খুলে দেখে একটা চিঠি। হাতের লেখা চাঁদনির।পড়তে শুরু করলো-
আমার কল্পনায় নাকি বাস্তবের জানিনা কোনো এক অমৃতাংশুকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি । যে ভালবাসা হয়তো ২৫ বছর বয়সী পূর্ণ যৌবনাও বাসতে পারবে না। পাগলের মতো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,আমি তোমায় ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু সাথে এটাও আমার কল্পনায় আছে আমার যত কথন, আমার যত ভালোবাসা তার প্রভাব যেন তোমার সংসারে না পড়ে । কারণ তাহলে আমি, আমার ভালোবাসা আর আমার কল্পনার মানুষটিও ছোট হয়ে যাবে! যা আমি কখনোই চাই না । তাই আমি যা লিখি মেসেজে,ই মেইলে সব মুছে ফেলতে বলি তোমায়। কখনো কেউ দেখলে, কারো হাতে মোবাইলটা গেলে আমাকে খুব খারাপ ভাববে কিম্বা তোমার পরিবারে অশান্তির ঝড় উঠবে ! বিশ্বাস করো চন্দ্র এটা আমি চাই না । কিন্তু যেদিন কেউ আমার সবটা জানবে সেদিন বুঝবে হয়তো সেদিন আমি থাকি না থাকি ,ঠিকই বুঝবে আমি খারাপ কিনা? তারা থাক তাদের যথাস্থানে, আমি শুধু ভালোবেসে যাই।কি করে বোঝায় আমি পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।
# কথাগুলো পড়তে পড়তে সম্রাট ভাবছে ,এই চিঠি রাণী কেন পড়াচ্ছে । এরকম কথা কতবার চন্দ্র আর চাদনির মধ্যে হয়েছে । চাঁদনির চিঠির উত্তরে চন্দ্রও লিখেছে, শোনো কিছু মনে করোনা না প্লিজ। তোমার রাগ কমাতে আমি জানি । আমি যখন তোমার কানে গিয়ে আলত করে বলবো, আমাকে ক্ষমা করে দাও লক্ষ্মীটি । কাজ করো ,বিবেকানন্দের শিষ্য হয়ে ওঠো । কাজেই শান্তি খুঁজে নাও। তুমি মনে মনে রেগে গেলেও আমাকে ফেলতে পারবে না! তখন তোমার রাগ অনুরাগের জলে ধুয়ে যাবে । তাছাড়া এরকম কথা কতবার ফোনে হয়েছে চাঁদনি আর চন্দ্রের মধ্যে । আসলে ওদের মধ্যে বিয়ের পর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে বলতে গেলে মধ্যবয়সে । দুজনেই সংসার ফেলে ছুটে যেতে পারবে না একথা মেনে নিয়েছে অথচ কেউ কারো সাথে কথা দুদিন না বলেও থাকতে পারে না । এসবই সম্রাট জানে। তবে নতুন করে রাণী কেন ...!
# সম্রাট কাগজটি হাতে নিয়ে ভাবছিল। এবারে কান্না থামিয়ে কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে রাণী বলছে ,এই কি হলো পড়না। একটু হকচকিয়ে বলে হ্যা কোথায় জানি পড়ছিলাম? এই যে চাঁদনি লিখেছে, আমি হেরে গেছি চন্দ্র , সত্যিই হেরে গেছি।তোমার প্রতিদিন ভালো উপদেশ দেওয়া, শান্তি পাবার জন্য নানা উপায় বাতলে দেওয়া কিছু ই বুঝি কাজে লাগলো না। তুমি বলতে আমি বাচচার মতো। হয়তো তাই। কেউ হয়তো বলবে,এ অন্যায়, ব্যভিচার! এ পথ ভুল পথ! কিন্তু আমার যে আর কিছুই করার নেই!
হয়তো দীর্ঘদিনের ঘুমিয়ে থাকা না পাওয়াগুলো আজ জেগে উঠেছে!দুঃখগুলো একটু আদর পেতে চাই,বাস্তবে পাবে না জেনেও। জানো একটা মুহূর্ত চন্দ্রের কথা মনে না করে দিন যায় না!এসব আশ্চর্য কথা তোমার বোধে আক্রান্ত করবে না! তুমি তো আমার দুঃখ কষ্ট সবকিছু হেসেই উড়িয়ে দাও। জানি তোমারও কিছু করার নেই। আবার এটাও বুঝি মাঝে মাঝে হয়তো তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও আমাকে সময় দাও। অন্তত দু চার মিনিট কথা বল। কিন্তু কতবার বলেছি তোমাকে নানা উপায়ে দেখা করার জন্য। এমনকি তুমি আমার আমন্ত্রণ রক্ষা করলে না । অথচ দেখো কি অলৌকিক ভালোবাসা! তোমার সাথে আমার এক দুদিনের দেখা, তা কয়েক মিনিটের জন্য! অথচ মনে হয় কত কাছাকাছি ছিলাম, আছি! জানি ভয় পাও যদি আমার কিংবা তোমার অসম্মান হয় । তুমি দেখা করতে চাও না। তুমি আমাকে বুঝে উঠতেই পারোনি, আমি কতটা সংযত, আমি কতটা সইতে পারি। সমুদ্রের ঢেউ এর মতো ধাক্কাও সইতে পারি। বজ্রাঘাতে ভূমি যেমন ফেটে যায় কিন্তু ধীরে ধীরে সইতে পারে ঠিক তেমনই কিন্তু তুমি তা জানোনা। তাই আমাকে ভয় পাও। কখনো কখনো বলো সত্তর পেরিয়ে তুমি লাঠি নিয়ে হাঁটবে তখন তুমি দেখা করবে । তোমার সেই সত্তর পেরোনো লাঠি হাতে, চোখে মোটা চশমা দেখার সৌভাগ্য বুঝি আমার হলো না গো ! অতদিন অপেক্ষা করার মত দৈহিক এবং মানসিক ক্ষমতা আমার নেই। আসলে আমার জীবনটা একটা কাহিনী । ভেবেছিলাম যদি ভালো কিছু করে যেতে পারি তবে আমার মৃত্যুর পরে রয়ে যাবো সকলের মনে আর তা করতে না পারলে শেষ হয়ে যাবো তিল তিল করে ।বেশ বুঝতে পারছি সময় ঘনিয়ে আসছে, হাতছানি দিচ্ছে ।আমার এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছানোর আগেই আমার সমাধি হবে জানি! তখন তুমি অন্তত এসো আমার সমাধি পরে! তোমার সত্তর এর অপেক্ষায় থাকতে পারলাম বলে ক্ষমা করো,তুমি তো খুব ভালো মানুষ । তবে অন্তত তুমি সেদিন এসো। তখন নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে সব ধরা ছোঁয়ার ভয় কেটে যাবে! তুমি এসে "ম্যাডাম" বলে ডাকলেই হাজারও কণ্ঠের মাঝে আমি ঠিক চিনে নেবো তোমাকে, সমাধি ভেদ করে যেন আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়বে -তুমি আমার ডাকে সাড়া দিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করেছো ভেবে! এই আমার দুঃখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা এক টুকরো সুখানুভূতির আলোকে সপর্শ করো, মানে তুমি তোমার ম্যাডামকে সপর্শ করো! সে সপর্শ করতে সেদিন নিশ্চয় তোমার কোনো দ্বিধা কাজ করবে না! মনে থাকবে আমার এই চাওয়া?
চিঠিটা পড়তে পড়তে সম্রাটের(যাকে চাঁদনি চন্দ্র বলেই ডাকতো) দুচোখের জলে ধুয়ে গেল লেখাগুলো, যেন চাঁদনি স্নাত হলো!
হঠাৎ বলে ওঠে ,চেয়ে দেখো ভিতরে ভিতরে আমিও হয়েছি শেষ, তুমি তা বোঝনি, তাই তো নিজেকে করেছ নিঃশেষ!তবে ফিরতে তোমাকে হবেই,ফিরবেই জানি। কোনো এক বসন্তের হাত ধরে কিম্বা জীবনের কোনো এক হৈমন্তিক বাতাস গায়ে মেখে ফিরবেই, সেদিন দুজনেই ভালোবাসার ছোঁয়ায় তীর্থ হবো.... (হাতের চিঠিটি উড়ে গিয়ে সমাধির ওপর পড়লো আর চন্দ্র নত হয়ে সমাধির ওপর মাথা ঠেকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো!)
সীমা সোম বিশ্বাস
কোলকাতা
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১৪ জানুয়ারি ২০২৩