আরশি কথা

আরশি কথা

No results found
    Breaking News

    ত্রিপুরার সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে অধ্যাপক কাশীনাথ দাস ।। লীনা মোদক ।। ত্রিপুরা ।। আরশিকথা হাইলাইটস

    আরশি কথা

    ধ্যাপক কাশী নাথ দাস যিনি ছিলেন একজন অসীম ক্ষমতাশালী প্রতিভার অধিকারী। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব বাংলায় কুমিল্লা জেলায় তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর পিতার নাম গৌরাঙ্গ সুন্দর দাস এবং মাতা খুশি রানী দাস। তাঁর সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, জনকল্যাণ ও সমাজ কল্যাণের চিন্তাধারা সমাজে র  প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ।

    ১৯৬৫ সালে তিনি ত্রিপুরায় আসেন। ১৯৬৭ সালে এম বি বি কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে সাম্মানিক স্নাতক এবং ১৯৬৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভের পর  তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ত্রিপুরা সরকারের অধীনে কৈলাশহর  আর. কে. ইনস্টিটিউশনে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসাবে  নিযুক্ত হন। তারপর কুলাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সেখান থেকে এম বি বি কলেজে রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। অধ্যাপনার জীবনে কাশীনাথ দাস ছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। উনার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের ঘনিষ্ঠতা ছিল খুব বেশি। ছোট ছোট বাচ্চাদের তিনি খুব ভালোবাসতেন। পড়াশোনা ছাড়া গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদির জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ দিতেন তিনি। ২০০৬ সালে এম বি বি কলেজে রসায়ন বিভাগ থেকে তিনি অবসরে যান। তারপর  ২০০৯ সালে তিনি ভারতীয় বিদ্যাভবনে অধিকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। তবে ১৯৯৬ সালে  ''ভবনস ত্রিপুরা বিদ্যামন্দির'' স্কুলে এক্সিকিউটি ভ কমিটিতে ১১ জন মেম্বারের মধ্যে  তিনিও ছিলেন একজন। তাঁর  প্রচেষ্টায় ভারতীয় বিদ্যাভবনের অধীনে আগরতলায় দুটো  বিএড কলেজ ,একটি সাইন্স এন্ড টেকনোলজি কলেজ এবং এ ছাড়া দুটো প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ একটি ভবন্স কলা কেন্দ্র তৈরি হয়।

    তিনি রসায়ন বিভাগের সঙ্গে জড়িত থাকলেও ভাষা সাহিত্য সম্পর্কে সমান আয়ত্ত ছিল তাঁর। শুধু শিক্ষকতার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি, সব বিষয়েই তিনি সমপরিমাণে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। উনার কবিতা আবৃত্তি, অভিনয় ,ক্রিকেট ,ব্যাডমিন্টন ইত্যাদিতে অসাধারণ দক্ষতা ছিল।

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ,ছোটগল্প, উপন্যাস পড়তে ভালোবাসতেন তিনি । বিভিন্ন কবিদের কবিতার লাইন গুলো উনার মুখস্থ থাকতো। তাছাড়া সংস্কৃত ভাষার  বিষয়ে  তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। সংস্কৃত লাইন পড়ে তা আবার সুন্দরভাবে বাংলায় অনুবাদ করে দিতেন তিনি। তিনি সত্যিই একজন গুণী ব্যক্তি ছিলেন। 

    তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল গুরুগম্ভীর ।কিন্তু অন্তরটা অত্যন্ত কোমল স্বভাবের। তিনি মানুষকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। জীবনের নানান বাঁকে নানান ধরনের লোকের সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রতি ছিল স্নেহ, মায়া-মমতা । বাচ্চাদের নিজের কাছে বসিয়ে অনেক গল্প শুনাতেন। তাই বিশেষ করে বাচ্চারা উনাকে'' দাদু স্যার "বলে ডাকতো । তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক অনাথ শিশুদের বিনে পয়সায় পড়াশোনা ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ও করেছিলেন। বহু দুস্থদের সহায়তার সময়ে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। ২০২০ সালে করোনার দুঃসময়েও তিনি দরিদ্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। শীতবস্ত্র বিতরণ অনাথ আশ্রমে এবং বৃদ্ধাশ্রমে বস্ত্র দান ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় এবং ভবন্স এর ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকাদের সহযোগিতায় করোনারকালে গ্রাম গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের সেবা করা ও তাদের উপযুক্ত সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করা হয়। এক কথায় বলা যেতে পারে ,অধ্যাপক কাশীনাথ দাস একজন জনদরদী মানুষ। যে কোন মানুষের প্রয়োজনে তিনি ছিলেন বিপদের বন্ধু। সমাজসেবক, শিক্ষাবি দ ছাড়াও তাঁর পরিচিতি ছিল গরীব দরদী মানুষ হিসাবে। দরিদ্র মানুষদের সন্তানরা যাতে একটু ভালো স্কুলে পড়তে পারে তার জন্য আনন্দনগর গ্রামে ভবন্স ত্রিপুরা বিদ্যামন্দির স্কুলের একটি শাখা উদ্বোধন করেছেন ২০১৬ সালে মার্চ মাসে ,যেখানে অতি অল্প পয়সায় শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দয়াবান ব্যক্তি। ২০১৪ সালে তাঁর উদ্যোগে প্রথম ভবনস ত্রিপুরা বিদ্যামন্দিরে ভবন্স্ অলিম্পিয়াড পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া হয়, যা বর্তমানে এর সাড়া মেলে ।উনার চিন্তা ভাবনা ছিল কিভাবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে আরো এগিয়ে নেওয়া যায় । ভারতীয় বিদ্যাভবন আগরতলা কেন্দ্রের অধিকর্তা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সিনিয়র ডেভেলপমেন্ট, স্কুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রোটারি ক্লাব এবং ত্রিপুরা কেমিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন । ত্রিপুরা এবং  বহিঃ ত্রিপুরায় সেবা প্রদানকারী সংগঠন ''জনসেবা পরিষদ ''এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন কাশীনাথ দাস মহোদয়। তাঁরই সক্রিয় আয়োজনে কলকাতায় ত্রিপুরার  রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে অবস্থানের জন্য নির্মিত হয়''ত্রিপুরা বাড়ি"। এইসবের বাইরে ও কাশীনাথ স্যার নিজে গড়ে তুলেন'' সিজার্ট ''নামে তাঁর  স্বপ্নের এনজিও ।

    কলা ও সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহের কারণে ২০২১ সালে লেইক চৌমুহনীতে" ভবনস্ কলাকেন্দ্র" নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন যেখানে ছোট ছোট শিশুদের নাচ, গান, আবৃত্তি ও যোগা শেখানো  হয় ।

    তাছাড়া তিনি ছিলেন একজন ভোজন রসিক ব্যক্তি ও বটে। তিনি মানুষকে খাওয়াতে যেমন ভালোবাসতেন তেমনি নিজেও খেতে খুব পছন্দ করতেন বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন রান্না করে মানুষদের খাওয়াতেন এবং নিজে পরিবেশন করতেন। ভবন্সে থাকাকালীন বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্টাফদের কে নিজে রান্না করে খাওয়াতেন। চাকরি সূত্রে কৈলাশহর  থাকাকালীন সহকর্মীদের সঙ্গে বসে আস্ত কাঠাঁল উপর থেকে ধপাস করে মেঝেতে ফেলে ভেঙে খাবার মজার অনেক কাহিনী রয়েছে । তিনি খুব হাস্য রসিক ও ছিলেন বটে ।

    তিনি একজন প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন । তাঁর  কর্মরত অবস্থায় বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে অসংখ্য ফুল ও ফলের গাছ লাগিয়েছেন । অনেক বড় ও দামি গাছ যেমন আম, চন্দন,গামাই, দেবদারু গাছও লাগিয়েছেন বিদ্যালয়ের বাগানে । তাছাড়া অনেক সবজি ও ফসল করেছেন বিদ্যালয়ের বাগানে। তিনি যেমন গাছ লাগাতে পছন্দ করতেন তেমনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মানুষকে গাছ উপহারও দিতেন। তাঁর একটাই লক্ষ্য ছিল কিভাবে সমাজব্যবস্থাকে উন্নত করা যায় এবং সমাজের মানুষকে ও  তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তিনি তাঁর কর্মজীবনে কখনো অলস ভাবে বসে থাকেন নি।বিজ্ঞান, সাহিত্য, কলা ,সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান যেমন অর্জন করেছেন তেমনি এই সকল বিষয়ে মানুষকে জ্ঞান বিতরণ করেছেন।

    এই সর্বগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিটি শেষ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিজের প্রাণ হারিয়েছেন ।২০২১ সালে ২৪শে সেপ্টেম্বর সকাল ৯ টায় কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন । উনার মৃত্যুর সংবাদ সমাজে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে শোকের বার্তা বয়ে এনেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী রানু ম্যাডামের উদ্যোগে কাশীনাথ স্যারের নামে এখনো ভবন্সের বিদ্যালয়ে এবং মহাবিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে সর্বোচ্চ স্থানাধিকারীদের আর্থিক পুরস্কার বিতরণ করা হয় ।


    -লীনা মোদক

    শিক্ষিকা ,প্রাথমিক বিভাগ

    ভবন্স ত্রিপুরা বিদ্যামন্দির 


    আরশিকথা হাইলাইটস

    ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২৫

     

    3/related/default