আত্মকথন-৫ (যে কারণে আমি জাপান থেকে গেলাম) ......পি আর প্ল্যাসিড, জাপান
আরশি কথাসেপ্টেম্বর ১৬, ২০২০
0
একটা সময় মনে হতে শুরু হলো, সবকিছু বাদ দিয়ে রাজাবাজার সাধনপাড়াতেই যেনো পড়ে থাকি আমি দিন-রাত। পরিচিতদের কেউ কেউ যারা আমাকে নিয়মিত সেই এলাকাতে পড়ে থাকতে দেখে তারা বলতে থাকলো, এটাই নাকি আমার স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেছে। এখানে আসলেই আমাকে পাওয়া যায়। সাড়াদিন যেখানে যা-ই কিছু করি না কেনো, রাজাবাজার আমাকে দিনের মধ্যে একবার হলেও যেতে হবে। এমনটাই পাগল বা অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম আমি তখন।
মেয়েদের হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রমলা না থাকলেও ওদের কেউ না কেউ এগিয়ে এসে আমাকে সময় দিত। কখনও কখনও পাশের ফ্ল্যাটের পরিচিত সেই ভদ্রলোক আমাকে দেখে তাঁর বাসায় গিয়ে বসে গল্প করতে বলতেন। আমাকে উনার বাসার ভিতর গিয়ে বসে গল্প করতে বললেও আমি সেটার পক্ষে ছিলাম না। গেইটের বাইরে দাঁড়িয়েই যেনো কথা বলায় ছিল অন্য রকম মজা বা আনন্দ। আমি তাঁর ঘরে না যাবার কারণ ছিল, ভদ্রলোক ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠজন। আমি যে, হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সাথে আড্ডা দেই এ কথা উনি বড় ভাই-ভাবীকে বলে দিতেন, তা জানার পর থেকে পুরোই এভয়েড করতে থাকি তাঁকে।
গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে অন্য মেয়েদের সাথে কথা বলার কারণ ছিল, রমলা হোস্টেলে না থাকলে ওর জন্য অপেক্ষা করে সময় কাঁটাতাম ওখানে। একসময় সেই অপেক্ষার অবসান ঘটতো রমলার আগমনে। এসেই জানতে চাইতো, কখন এসেছি? আর, আমার পাল্টা প্রশ্ন হতো, কোথায় গিয়েছিল সে? কেউ কোনো উত্তর না দিলেও দু’জন দু’জনের চোখে চোখ রেখে হাসি দিতাম। সেই হাসিতেই যেনো সন্তুষ্ট থাকতাম দু’জনে। রমলার হাসি ছিল দেখার মতো। ওর হাসিতেই যেনো মন জুড়াতো আমার। যাক, বেশি বললে হয়তো কেউ কিছু বলবে না, আবার বলতেও পারে আমাকে এতদিন পর, তাই অফ যাই রমলার হাসির প্রশংসা করা থেকে।
নিয়মিত রমলার হোস্টেলে গিয়ে দেখা করে কথা বললেও তখন পর্যন্ত ওর কাছে স্বীকার করিনি আমি ওকে ভালোবাসি। বিষয়টি ছিল নিজের সাথে অনেকটা লুকোচুরি খেলার মতো। পরিচয় হবার পর পরবর্তী কোনো এক ছুটিতে গ্রামে গেলাম বেড়াতে। (ইস্টার সানডের ছুটি ছিল সেটি।) ইস্টার সানডের পরের দিনের কথা। আমার এক কাকাতো ভাইকে বললাম, চল এক জায়গায় বেড়িয়ে আসি। ওকে বলার কারণ ছিল, ওদের একটা বাইসাইকেল ছিল। সেই বাইসাইকেল নিয়ে দুজনে যাবার পরিকল্পনা করছিলাম মনে মনে। ওর বয়স ছির আমার থেকে অনেক কম। আমি ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি গেলে যাদের সাথে বেশি মেলা-মেশা করতাম তাদের মধ্যে সে ছিল একজন। ওকে অনুরোধ করে বলার পর কোথায় যাবো, কেনো যাবো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ওর ছিল নানা প্রশ্ন।
আমি যে কাকাতো ভাইয়ের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিবো, তখনও আমি রমলা সম্পর্কে কোনো কিছুই জানি না। ওকে দেখেইতো আমার চোখ জুড়ায় না, তথ্য নেবো কখন। সেদিনই খোঁজের খোঁজ জানলাম ওর বাড়ি নাগরী মিশনের একদম দক্ষিণ প্রান্তে। ওর এক ছোট ভাই আছে, নাম তনয়। বলার সাথে সাথে কাকাতো ভাইটি বললো, তনয় ওর ক্লাস ফ্রেন্ড। হাসতে হাসতে বলল, চল যাই। তখন গ্রামের বাড়িতে আমার জন্য বাইসাইকেল সংগ্রহটা ছিল অনেক কিছু। ওকে বলে, নিয়ে যেতে রাজি করার পর দু’জনে রেডি হয়ে এক সাইকেল নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা হলাম। কাকাতো ভাইটি তখন আমি যে স্কুলে পড়েছি সেই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের নাম, নাগরী সেন্ট নিকোলাস হাই স্কুল।
আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি অনেক দূরের পথ। সকাল সকাল রওনা দিলাম দুজনে এক সাইকেল নিয়ে। একবার আমি চালাই ও বসে সাইকেলের পিছনে, আবার ও চালায় আমি বসি সাইকেলের পিছনে। এভাবে নাগরী পর্যন্ত গিয়ে দুজনেই হাপিয়ে উঠলে ও বলল, চল ফিরে যাই। আমি ওর কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে বললাম, এতদূর পথ এসে ফিরে যাবো, তা কী হয় নাকি?
আমি নাগরী এলাকা তখন খুব ভালো চিনি। কারণ আমার স্কুল ছিল এখানেই। পাশেই সেই হোস্টেল যেখানে থেকে আমি এস এস সি পরীক্ষা পর্যন্ত হাই স্কুলের ছাত্র জীবন কাটিয়েছি। তাই বললাম, চল, বাজারে গিয়ে কিছু খেয়ে নাস্তা করে নেই। নাস্তার কথা বলার পর ভাইটি খুশি হয়ে জানতে চাইলো, আমরা যে ওদের বাড়ি যাচ্ছি, রমলাকে কি বলা আছে কিনা? আমি “না বলিনি” বলায় সে বলল, শত হলেও এই বয়সের একটি মেয়ের কাছে যাবি, বাড়িতে অন্যরা কি না কি মাইন্ড করে। বলে, সে-ই আবার বলল, দেখা যাক, চল যাই আগে। আমি ম্যানেজ করবো নে। যা আছে কপালে। বলে প্রাণ খোলা হাসি দিয়ে বলল, আরে চল। ওর হাসিতে আমি প্রাণ খুঁজে পাই।
এবার আমি ওর সাহস দেখে বললাম, আরে এই বয়সেইতো মেয়েদের বাড়িতে ছেলেরা যায়। বাড়িতে গিয়েই ওর ভাইকে ডেকে বলবি, ব্যাটা তোর বোনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছি, যা আছে কপালে। দৌঁড়ানিতো আর দিবে না।
নাগরী বাজারের যেখানে বসে নাস্তা করছিলাম সেখান থেকে আরো প্রায় আধা ঘন্টার পথ রমলাদের বাড়ি। সাইকেল চালিয়ে শরীরে ঘাম ঝড়ছিল। মুখ খুলে শ্বাঃস নিচ্ছি আর রসিকতা করছি দুভাই মিলে। পাশাপাশি কল্পনা করছি ওদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছার পর কি পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে। নীরব এক ভয় তো মনে কাজ করছিল তখন, সেটি বলার অপেক্ষা থাকে না।
নাস্তা করার সময় আমার পরিচিত আরো বেশ কয়েকজনের সাথে দেখা হয়ে গেল সেখানে। ওদের সাথে কথা বলে বিদায় করলাম। শরীরের ঘাম শোকানোর সাথে ক্লান্তি দূর হতে থাকলো ক্রমেই। একসময় লম্বা দম নিয়ে বললাম, চল এবার যাই। বলেই দু’জন আবার রওনা দিলাম রমলাদের বাড়ির উদ্দেশে।-----------
(চলবে)