আত্মকথন-৬ (যে কারণে আমি জাপান থেকে গেলাম)......... জাপান থেকে পি আর প্ল্যাসিড
আরশি কথাসেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
0
বাড়ি থেকে সাইকেল নিয়ে দু’জন রওনা দেবার সময় যে আনন্দ কাজ করেছিল মনে, এখন বাজার থেকে বেরিয়ে রাস্তার করুন অবস্থা দেখে সেই আনন্দর পুরোটাই নিরানন্দে রুপ নিয়েছে। রাস্তার যা অবস্থা। লাল মাটি শুকিয়ে এত শক্ত হয়েছে যে, মনে হল পাথরের মতো শক্ত। শুধু শক্ত হলে কথা ছিল না। সমস্যা হল পুরো রাস্তা অসমতল, উঁচু নিচু। বৃষ্টির পর মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করার পর কাঁদা মাটির যে রুপ নেয় সেটা স্থায়ী হয়ে আছে। কোনভাবে সাইকেল চালিয়ে এগুতে সাহস পাচ্ছিলাম না আমরা।
শুরু করলাম সাইকেল ঠেলে হেঁটে চলা, অনেকটা কষ্টেরই মনে হচ্ছিলো এই পথচলা। নাগরী বাজার থেকে পাঞ্জোরা পর্যন্ত এটুকু পথ যেতেই মনে হলো একটু জিরিয়ে নিই। কিন্ত জিরোনোর জায়গা এখানে কোথায়? আমি হাঁটছি আর হোস্টেল লাইফের কথা মনে করছি। আবুল হাসনাত, পার্থ দত্ত আর আমি তিনজন এই পথে দিনের বেলা কি সন্ধ্যে বেলা অনেক হেঁটেছি। সেই স্মৃতিই কেবল চোখে ভাসছিল। কষ্টের কারণে কাকাতো ভাইকে আর সেই সময়কার কথা শেয়ার করতে পারছিলাম না।
সামনে যাবার পর বড় রাস্তা থেকে বামদিকে ঢুকে একসময় কিছুটা সমতল রাস্থা পেলাম। এলাকাটি অনেকটাই জনশূন্য মনে হচ্ছিল। বহুদূর পর্যন্ত পথ হেঁটে কোন লোকজনের দেখা পেলাম না। ছোটবেলা ময়মনসিংহ গারো এলাকায় গিয়েছিলাম (সম্ভবত ১৯৭৪ সনের কথা) বেড়াতে। মাঝে মধ্যে মন খারাপ হলে বিকেল বেলা হাঁটতে চলে যেতাম পাহাড়ী এলাকায়। এখানে হাঁটতে হাঁটতে সেই রাস্তার সাদৃশ্য পেলাম মনে হলো। ভাগ্য ভালো, রাস্তার মোড়েই এক লোককে পেয়ে গেলাম। কাকাতো ভাইটি তাকে জিজ্ঞেস করলো, তনয়দের বাড়ি কোন দিকে। সেই লোক তনয়ের পরিবারের সবার নাম বলে শিউর হলো আমরা যেই তনয়কে খুঁজছি এই সেই তনয় কি না। ভাইটি বলল, আপনি ঠিক ধরতে পেরেছেন, এই সেই তনয় যাকে আমরা খুঁজছি। তখন লোকটি রাস্তার বর্ণনা দিয়ে আমাদের বলল, আরো প্রায় দশ মিনিটের পথ হাঁটলে শেষ বাড়িটাই তাদের।
লাল মাটির এলাকা। রাস্তার ধারে বাঁশ ঝাড়, বাইট গাছের জঙ্গল, মাটির ঢিঁবি পেড়িয়ে যখন গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলাম তখন আর আমার পা চলছিল না। এই পা না চলার কারণ যতটা না ক্লান্তির কারণে তার চেয়ে বেশি ছিল ভিতরে আমাদের ভয়, এই কারণে। মনে মনে একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ফিরে যাবো। আবার নিজে নিজেই ভাবলাম, এতটা পথ এসে আমরা হেরে যেতে চাইছি কেন? আর যাই হোক বেইজ্জতি হতে পারবো না মনে করে বাড়িতে গিয়ে কথা বলার কৌশল ঠিক করলাম। কেন গিয়েছি সেই বাড়িতে সেটার কারণ তো শক্ত হতে হবে। নাহলে যদি বাড়িতে বসারও সুযোগ না দেয় তাহলে তো এক ধরনের অপমানই হতে হবে বলা যায়। সেই অপমানটুকুও সহ্য হবে না মনে করে রমলার আত্মীয়র রেফারেন্স দেবো মনে করে একটু শান্ত করলাম নিজের মনকে। সাহসও যোগালাম মনে মনে। কাকাতো ভাইকে বললাম, চল, যা আছে কপালে। সময় সময় আমার সেই কাকাতো ভাইটি আমার চেয়ে সাহস প্রদর্শণ করতে শয়তানি করে শয়তান হয়ে উঠে বেশ। তাই ওর শয়তানি বুদ্ধিও যোগ করলাম আমার বুদ্ধির সাথে।
আমাদের গ্রামে বাড়ির আশে পাশের বাড়ি হলে কথা ছিল ভিন্ন। এত দূরে এসে প্রেম করতে গিয়ে যদি ধরা খাই, তাহলে খবর আছে। তাই আবার দুর্বল চিত্তের প্রমাণ দিলাম ভাইটিকে যখন বললাম, চল ফিরে যাই। তখন ও বলল এটুকু সাহস নেই, অথচ প্রেম করতে চাস? বললাম, এতদূরে এসে প্রেম করা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। ততক্ষণে রমলাদের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। রাস্তা থেকে ওদের বাড়ি কিছুটা উঁচু। বাড়িতে ঢুকতেই বাড়ির মুখে কিছু গাছ। গাছগুলো এমনভাবে বেড়ে উঠেছে যে, বাড়ির ভিতরের পরিবেশ দেখার বাধা হয়ে আছে।
রমলাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে বিশাল বড় বিল। পুরো বিল জুড়ে ধান বোনা রয়েছে। তখনও ধান আসেনি গাছে। এক কথায় যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। চোখ জুড়িয়ে যাবার মতো দৃশ্য। তার মধ্যে শীতল বাতাস। বাতাসে ধান ক্ষেতের উপর ঢেউয়ের নাচন দেখছিলাম। শরীর জুড়িয়ে গেলো সেই ঢেউ খেলানো বাতাসে। এমন পরিবেশে আমরা তখন দাঁড়ানো যে, চোখ মন শরীর সবই জুড়িয়ে যাচ্ছিল।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দশ মিনিট দু’জনে শার্টের বোতাম খুলে বাতাস লাগালাম শরীরে। এরপর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত পাঁকা করলাম, যাবো ওদের বাড়িতে, যা হয় হবে। এরপর বাড়ির ভিটায় পা দিয়ে সাইকেলের ঘন্টা বাজালাম। বাড়ির বড়দের কেউ বের হয়ে আসার আগে দেখি উঠোনের পশ্চিম পাশে বড় পেয়ারা গাছ। সেই গাছে উঠে বসে আছে রমলা আর তার ভাই তনয়। ওরা আমাদের দেখার পর পরি মরি করে নামতে চেষ্টা করছিল পেয়ারা গাছ থেকে। আমি কাকাতো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। হাসি চাপাতে কষ্ট হলেও ভাইটি তার ক্লাস ফ্রেন্ডকে পেয়ে বলল, কিরে? এই দুপুর বেলা গাছে উঠে আছিস কেন?
উঠোনে ধান শুকাতে দিয়েছে। কয়েকটি মুরগী মনের সুখে ধান খাচ্ছিল। রান্না ঘর থেকে সম্ভবত রমলার মা মুরগীগুলোকে তাড়ানোর জন্য উচ্চৈস্বরে ধমকিয়ে হুস হাস করছিলেন। এই মুরগী যা বলে ঘর থেকে বড় লম্বা বাঁশের লগ্যি নাড়ালেন। এদিকে রমলা কোনভাবে গাছ থেকে ঝুলতে ঝুলতে নেমে রান্না ঘরের দিকে দিল দৌঁড়। এক দৌড়ে গিয়ে রান্না ঘরে ঢুকলো। আমরা যতক্ষণ সময় ওদের বাড়িতে ছিলাম ততক্ষণ সময়ের মধ্যে আর তাকে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখিনি।-----------
(চলবে)