করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজবে ভাসছে বাংলাদেশ। গুজবের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন গ্রাম্য বঁধু থেকে শুরু করে শহরের মেম সাহেব পর্যন্ত। গুজবে যোগ দিয়েছেন সরকারি আমলা থেকে খেটে খাওয়া কামলা। গুজব ছড়ানো হচ্ছে ধর্মীয় মতবাদে, দলীয় আদর্শের চেতনায়, ব্যবসায়িক চিন্তা ভাবনায়। গুজব ছড়িয়ে কেউ লুটছে মজা কেউ লুটছে ফায়দা। গুজবে কান দিয়ে মধ্যরাতে সবাই ছুটছে থানকুনি পাতার খোঁজে। প্রতিটি পাতা দুই শত টাকা দিয়ে কিনে খেয়েছে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে। গুজবে কান দিয়ে কালোজিরা, আদা, চা, ভিনগারের ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার সুযোগ করে দেওয়া হলো। গুজব ছড়ানো হলো করোনা ভাইরাস মুসলমানদের আক্রান্ত করবে না। গুজবে কান দিয়ে সরকারি নির্দেশ অমান্য করে অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করতে গিয়ে প্রাণ দিলেন একজন সহজ সরল আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তি। করোনা ভাইরাস মুসলমানদের আক্রমণ করলে কোরআন মিথ্যা হবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আমীর হামজা। মুফতি ইব্রাহিম সাহেব গুজব ছড়িয়ে দিলেন তিনি স্বপ্নের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করার টিকা আবিষ্কারের সূত্র পেয়েছেন। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা গোমূত্র পান করে করোনা রোগ থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছে। গুজব ছড়িয়ে পড়লো দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। চড়া দাম দিয়ে সবাই প্রয়োজন অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহে যোগাদিয়ে মজুতদারদের মুখে হাসি ফোটালো গুজবে বিশ্বাসী বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ ঘরের বউকে অবিশ্বাস করবে কিন্তু গুজব বিশ্বাস করবে। গুজব ছড়ানো হলো করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের গুলি করে মেরে ফেলা হবে। গুজবে বিশ্বাস করে ভয়ে মাগুরা জেলার একজন সন্দেহভাজন রোগী গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করলেন। অনেক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেলেন ভিন্ন রোগ আক্রান্ত রোগী। বলা হলো করোনা ভাইরাস ছুঁয়াছে রোগ। গুজব রটানো হলো এরোগে মৃত্যু অনিবার্য। ভয় পেয়ে বিদেশ ফেরত প্রানের স্বামীকে বিমানবন্দরে রেখে স্ত্রী চলে গেলেন বাপের বাড়ি। বিশ্ব মিডিয়া গুজব ছড়ালেন করোনা ভাইরাস চীনের তৈরি জীবাণু অস্ত্র। চীন দায়ী করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেকে। বাংলাদেশের মসজিদ মাদ্রাসা চিরতরে সরকার বন্ধ করে দিচ্ছে গুজবে কান দিয়ে হবিগঞ্জ জেলায় মিছিল করলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। খালেদা জিয়া করোনা ভাইরাস আক্রান্ত তাই সরকার মুক্তি দিচ্ছে গুজবে কান দিয়ে দলীয় প্রধানকে শেষ বারের মতো দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হলেন হাজার খানিক নেতাকর্মী। হাজার খানিক নেতাকর্মী কোনরকম স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়া গনজামায়াত হয়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করলেন। গুজব রটানো হলো দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। গুজবে শরীক হয়ে মানুষ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেভাবে ঢাকার শহর ছেড়েছে সেই একই কায়দায় ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ছুটছে। সরকার ঘোষিত লক ডাউনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে দশ দিনের ছুটিপ্রাপ্ত চাকুরীজীবিরা। বউ-বাচ্চা নিয়ে ছুটেছেন গ্রামের উদ্দেশ্য। সবাইকে সুরক্ষিত রাখার সরকারি প্রচেষ্টা ভেস্তে গেলো গুজবের স্রোতে।
গুজবের পাশাপাশি আতংক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষের মনে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে লাশের গোসল, জানাযা, কবর হবে না আতংকে অনেকে সন্দেহভাজন থাকলেও ডাক্তারের শরণাপন্ন হচ্ছেন না। বয়স্ক ব্যক্তিদের কেউ অথবা অন্য কোন রোগে মারা গেলে সবাই সন্দেহের চোখে দেখছে। হোম কোয়ারান্টাইন থাকা মানুষদের বাসার সামনে লাল পতাকা উড়িয়ে যুদ্ধের আতংক ছড়ানো হচ্ছে। আক্রান্ত ও সন্দেহভাজন ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার সামাজিকভাবে হেয়পতিপন্ন ও বয়কট আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। বিদেশ ফেরত ব্যক্তিরা আছেন প্রশাসনের আতংকে। নিয়ম ভঙ্গ করার অপরাধে তাদেরকে আর্থিক জরিমানা করা হচ্ছে। আতংকিত হয়ে দিন কাটাচ্ছেন সেই সকল পরিবার যাদের পরিবারের সদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন। ভৈরব জেলার একজন সন্দেহভাজন রোগীকে এলাকাবাসী হাসপাতাল ত্যাগ করতে বাধ্য করছেন। আইন শৃঙ্খলা অবনতির আশংকা করছেন অনেকে। আতংকিত অনেক ডাক্তার এবং নার্স তাদের চিকিৎসা সেবা প্রদান বন্ধ করেছেন। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সেবা দেওয়া বন্ধ রাখায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির আতংকে আছেন দেশব্যাপী। সচেতন করার দায়িত্ব দেওয়া সরকারি কর্মচারীদের আচরণে আতংকিত অনেকে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য অতিউৎসাহী হয়ে সাধারণ মানুষকে পিটিয়ে আতংক ছড়ানোর চেষ্টা করছেন।। যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিরীহ নিরপরাধ তিনজন বয়স্ক ব্যক্তিদের কান ধরিয়ে উঠ বস করানোর ভিডিও ধারণ করে দেশে আতংক সৃষ্টির চেষ্টা করছিলেন। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপে তা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের সংযত আচরণ করে মানুষের মনে থেকে আতংক দূর করতে হবে। আতংকিত মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে করোনা ভাইরাস মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে।
গুজব - আতংকের মধ্যে দেশের মানুষ সচেতন হচ্ছে এটা আশার কথা। দেশের সংবাদ মাধ্যম চেষ্টা করে চলছে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে অনেক তরুন এগিয়ে এসেছেন। শহর থেকে গ্রাম, পাড়া থেকে মহল্লায় দেখা যাচ্ছে মুখে মাস্ক লাগানো মানুষ। প্রতিটি মসজিদ মন্দির গীর্জায় দেখা যাচ্ছে সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়ার প্রবনতা। হাটবাজারে অনেকে নিজের পকেটের পয়সায় বসিয়েছেন হাত ধোয়ার সরঞ্জামাদি। সবচেয়ে আশার বিষয় তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে আসা। তরুণদের আগমনী বার্তায় সচেতন হবে সাধারণ মানুষ। সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সক্ষমতা বাড়বে করোনা ভাইরাস মোকাবিলার।
করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করার জন্য সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে সকল সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছেন। পরীক্ষাসমূহ স্থগিত করেছেন। গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ভাতাদি পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করেছেন। গরীব অসহায় মানুষের জীবনযাত্রা পরিচালনা করার জন্য স্বল্প মূল্যেখাদ্যদ্রব্যাদী দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। ডাক্তার নার্সদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন মেডিকেল সরঞ্জামাদী সরবরাহ করেছেন। করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য কিট তৈরির ব্যবস্থা সহ বিভাগীয় শহরে পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। দেশের সকল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রস্তুত রেখেছেন সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সেনাবাহিনী মাঠে নামিয়েছেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ আস্থা রেখেছে।
তবে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষ নানাবিধ মন্তব্য করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশের সংকটকালীন সময়ে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলোয়াড়দের আর্থিক সহযোগিতা দেশবাসীকে আনন্দ দিয়েছে।
সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করার জন্য সরকার এবং জনগণ প্রস্তুতি নিয়েছে। বীরের জাতি বাঙালী করোনা মোকাবিলায় জয় লাভ করবে বলে সবাই বিশ্বাস রাখে। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো করোনা ভাইরাস মোকাবিলার যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।
মোঃ হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী
সহকারী রেজিস্ট্রার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
৩রা এপ্রিল ২০২০