চাঁদ। টগবগে তরুন যুবক। গ্রাম্য জেলের ছেলে। মানুষ থেকে কুমির হওয়ার কিংবদন্তি কাহিনীর নায়ক চাঁদ। নদের চাঁদ এক ঐতিহাসিক নাম। চাঁদ জাদুবিদ্যা শিখে মানুষ থেকে কুমিরে পরিণত হয়েছিলেন। কিংবদন্তির নদের চাঁদের ঐতিহাসিক গল্পকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে নাটক, যাত্রাপালা ও সিনেমা। তার নামানুসারে নদের চাঁদ ঘাট (খেয়াঘাট) আজও বিদ্যমান। ঐতিহাসিক এই ঘটনাটি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের মধুমতি নদী পাড়ের। এই কাহিনী এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কিংবদন্তির এই নায়কের নামানুসারে খেয়াঘাট, বাজার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
উপজেলার পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে গেছে মধুমতি নদী। উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পূর্বে এই নদীর একটি ঘাটের নাম নদের চাঁদ। চাঁদ একজন মানুষের নাম। তিনি জাদুবিদ্যা শিখে মানুষ থেকে কুমিরে পরিণত হয়েছিলেন। পরে স্ত্রীর ভুলের কারণে কুমির থেকে আর মানুষ হতে পারেন নি। মানুষ থেকে কুমির হওয়ার এই কাহিনী আজো এলাকার মানুষের মুখে মুখে। নদের চাঁদের এই কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে নাটক, যাত্রাপালা এবং সিনেমা।
বহূ আগেকার কথা (১৬১৩)। উপজেলার পাঁচুড়িয়া গ্রামের দরিদ্র পরিবারে বাস করতেন চাঁদ নামের এক যুবক। তার পিতা মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করতেন। চাঁদের তখনো জন্ম হয়নি। জন্মের আগেই চাঁদের বাবা গদাধর পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে মারা যান। একমাত্র সন্তানকে বুকে আগলে দিন কাটতো মায়ের। চাঁদ এক সময় যৌবনদীপ্ত হন। তার মা চাইতেন না চাঁদ বাবার মতো মাছ ধরতে নদীতে যাক। চাঁদের বিয়ে দিয়ে সংসারি জীবন চেয়েছিলেন তিনি। ক্ষেতখামারে কাজ করে সংসার চালাবে। কিন্তু সংসার বিবাগি চাঁদের ঘরে মন বসেনা। গভীর রাতে কাউকে কিছু না বলে চাঁদ একদিন বেরিয়ে পড়েন অজানার পথে। ১০ বছর পর আবার বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। ততদিনে তার মা বৃদ্ধা হয়ে যান।
বাড়ি আসার পর চাঁদের বিয়ে দেন তার মা। স্ত্রীর ভালোবাসা তাকে ঘরে আটকে রাখলো। সুখে আর আনন্দে দিন কাটছিলো তাদের। দীর্ঘ ১০ বছর অন্তর্ধানের রহস্য স্ত্রী সরলার কাছে খুলে বলেন চাঁদ। দীর্ঘ ১০ বছর কামরূপ কামাখ্যা (আসাম) ছিলেন চাঁদ। ওখানে এক নারীর কাছে জাদুবিদ্যা (তন্ত্রমন্ত্র) শেখেন তিনি। এই জাদুর বলে তিনি মানুষ থেকে কুমির হওয়ার কথা বলেন স্ত্রীকে। এমন অবিশ্বাাস্য কথা শুনে স্ত্রী সরলার শখ জাগে মনে। স্বামীকে কুমির রূপে দেখার বায়না ধরেন।
স্ত্রীর শখ পূরণের জন্য গভীর রাতে দুটি পাত্রের পানিতে মন্ত্র পড়ে ফুঁক দেন চাঁদ। সেই সঙ্গে স্ত্রী সরলাকে চাঁদ বলেন, একটি পাত্রের পানি গায়ে ছিটিয়ে দিলে কুমিরে পরিণত হবে। আরেকটি পাত্রের পানি গায়ে ছিটালে আবার মানুষ হয়ে যাবে চাঁদ। এরপর এক পাত্রের পানি শরীরে ছিটিয়ে কুমির হয়ে যায় চাঁদ। স্বামীকে কুমির রূপে দেখে ভয়ে দৌড়ে পালান স্ত্রী। এ সময় সরলার পায়ের ধাক্কায় অন্যপাত্রের পানি মাটিতে পড়ে যায়।
চাঁদের এ বিষয়টি শাশুড়িকে জানান সরলা। মা এসে দেখেন কুমির হয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে তার নাড়িছেড়া আদরের ধন চাঁদ। স্ত্রী সরলার দিকে তাঁকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো চাঁদ। ঘটনার তিনদিন পর কুমির চাঁদ মধুমতি নদীর পানিতে নেমে যায়। প্রতিদিন চাঁদের মা নদীর ঘাটে বসে চোখের জল ফেলেন। কিছুদিন পর কামরূপ থেকে চাঁদের সেই নারী ওস্তাদকে খবর দিয়ে আনা হলো। তিনি মধুমতি নদীর পাড়ে এসে চাঁদ বলে ডাক দিলেন। তখন কুমির (চাঁদ) মুখে ইলিশ মাছ নিয়ে উঠে এলো ডাঙায়। এ অবস্থা দেখে ওই ওস্তাদ জানিয়ে দিলেন যে, চাঁদকে আর মানুষ করা সম্ভব নয়। কারণ ইতোমধ্যে আহার করে ফেলেছে কুমির চাঁদ।
এরপর মা ছেলের নাম ধরে ডাক দিলেই চাঁদ ঘাটে চলে আসত। মায়ের হাতের খাবার খেয়ে আবার নদীতে ফিরে যেত। কিছুদিন পর নদী দিয়ে একদল বণিক জাহাজযোগে যাওয়ার সময় চরে একটি কুমির দেখতে পান। তারা কুমিরটি মেরে ফেলেন। পরে জানাজানি হলে লোকজন মৃত: কুমিরটি উদ্ধার করে সনাতন রীতি অনুযায়ী সৎকার করেন। তবে জনশ্রুতি রয়েছে চাঁদের স্ত্রী পরকীয়ায় মত্ত্ব ছিলেন। সেই সুযোগটা লুফে নেন তিনি। স্বামী কুমির হওয়ার পর জেনেবুঝেই চাঁদের স্ত্রী তার শরীরে পানি ছিটিয়ে তাকে কুমির থেকে মানুষে পরিণত করেননি। কথিত আছে, চাঁদের স্ত্রীর পরকিয়া থাকার কারণে সে ইচ্ছে করেই স্বামীকে কুমির থেকে মানুষে পরিণত করার কাজটি করেন নি।
স্ত্রীর শখ পূরণে চাঁদ-এর কুমির হওয়ার কাহিনী আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। উপজেলা সদর থেকে সামান্য দূরে মধুমতি নদী তীরের খেয়া ঘাটটি নদের চাঁদ ঘাট নামে সবার কাছে পরিচিত। এছাড়া চাঁদের নামে নদীর অপরপাড়ে নদের চাঁদের হাট, নদের চাঁদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নদের চাঁদ পিসি একাডেমী (হাইস্কুল) রয়েছে।
মহম্মদপুর উপজেলার ইতিহাস গ্রন্থের লেখক সালাহ্ উদ্দীন আহমেদ মিল্টন বলেন, নদের চাঁদ-এর গল্প মূলত লোককাহিনী। কামরুপ কামাখ্যা থেকে যাদুবিদ্যা শিখে আসনে চাঁদ। এরপর স্ত্রীর শখ পূরণে চাঁদ কুমরি হন। স্বামী কুমির হওয়ার পর জেনেবুঝেই চাঁদের স্ত্রী তার শরীরে পানি ছিটিয়ে তাকে কুমির থেকে মানুষে পরিণত করেননি। কথিত আছে, চাঁদের স্ত্রীর পরকিয়া থাকার কারণে সে ইচ্ছে করেই স্বামীকে কুমির থেকে মানুষে পরিণত করার কাজটি করেন নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রামানন্দ পাল বলেন, কিংবদন্তির নদের চাঁদের গল্প স্থানীয় মানুষের মুখে এখনও শোনা যায়। মানুষের মধ্যে চাঁদকে স্মরণীয় করে রাখতে নদের চাঁদের ঘাট এলাকায় কিংবদন্তির আদলে একটি গেট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নদের চাঁদ ঘাট পর্যন্ত রাস্তারও উন্নয়ন করা হবে।
এস আর এ হান্নান, বাংলাদেশ
৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২২