আরশি কথা

আরশি কথা

No results found
    Breaking News

    মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৫০তম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ আরশিকথা হাইলাইটস

    আরশি কথা

    ভারতবর্ষের পুণ্যভূমিতে যুগে যুগে জন্ম নিয়েছে বহু মুনি ঋষি দেবতুুল্য মানুষ, যাঁরা গোটা পৃথিবীকে আদর্শ মানব সভ্যতার দিশা দেখিয়েছে। তাঁর মধ্যে  মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাঙালির প্রাণের কবি নবজীবনের আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা জাগানোর চির স্বাতন্ত্রচিহ্নিত। প্রতি বছর ২৯আগস্ট কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর।বহুমুখী প্রতিভার গুণেই তাঁর কাব্য অঙ্গনের পরিধিকে করেছে বহু বিস্তৃত। তাঁর কাব্য ভাবনায় একটি অন্যতম প্রধান বিষয় স্বদেশপ্রেম।কবি এমন এক সময়ে আবির্ভূত হন,যখন দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ছিলেন আন্দোলনরত। এ দেশবাসীর চেতনায় যে স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবোদ ,স্বাধীনতা ইত্যাদি ভাব ছিল জাগ্রত, সেসব ভাবই যেন কাজী নজরুলের  কবিতায় ভাষা পেয়েছে অর্থাৎ তাঁর কাব্যে ব্যক্ত হয়েছে স্বদেশপ্রেম। 'অগ্নিবীণা' ,  'বিষের বাঁশী', 'সাম্যবাদী',  'সর্বহারা', 'ফণিমনসা', 'জিঞ্জীর', 'সন্ধ্যা,  'প্রলয়শিখা' ইত্যাদি কাব্য তাঁর দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ। কবির কণ্ঠে  উচ্চারিত হয়েছিল 'বল বীর বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির'। 

    কাজী নজরুল ইসলাম একজন প্রকৃত স্বদেশপ্রেমি অগ্নিমানব ,যাঁর শিরায় শিরায় বইত দেশপ্রেমের বন্যা।ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তাঁকে যেতে হয়েছিল জেলে। অসংখ্য কবিতার মধ্যে তাঁর অকৃত্রিম স্বদেশপ্রীতির পরিচয় পরিব্যাপ্ত। তিনি ছিলেন হিন্দু- মুসলমানের মিলনমন্ত্রে বিশ্বাসী।কবিতার তরবারি দিয়ে তিনি জাত-পাত ধর্মের মিথ্যা ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। মানুষই তাঁর কাছে ঈশ্বরের প্রধান সৃষ্টি।তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে  মানবজাতির প্রকৃত জাগরণ সাধারণ কৃষক,শ্রমিক, নারী জাগরণে। মানবতা বোধই মানুষের প্রকৃত ধর্ম। কবিতা, গান রচনায় ও সুর সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অনবদ্য। তাঁর রচিত গান আমাদের বিপদের,  সংগ্রামের ও চেতনা জাগানোর পরমশক্তি। নজরুলের সংগীত 'ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণি তল'- আজও ছাত্র-যুবকদের উদ্বেলিত করে।নেতাজি সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন-  'আমরা যে দিন মার্চ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে যাব সেদিন থাকবে কাজির গান আমাদের কন্ঠে।' কাজী নজরুল ইসলাম দেশকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন বলেই তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেননি। প্রতিটি দলেই তিনি দেখেছিলেন শুধু সুবধাবাদী রাজনীতি।তাই তিনি প্রথম সকল দলাদলির ঊর্ধে উঠে  ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।নজরুলের কবিতায় আছে অসামান্য মানবপ্রীতি, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সাম্যবাদী চেতনা ও সর্বহারা মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা।গভীর মানবপ্রীতিই তাঁকে করে তুলেছে মানবতাবাদী। মানুষে মানুষে তীব্র বৈষম্যে নজরুল ব্যথাহত হৃদয়ে তাঁর সৃষ্টির নিদর্শন রেখে গেছেন।কৃত্রিম সমাজ ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে সৃষ্টি.করেছে যে ব্যবধান বজ্রকণ্ঠে তিনি বারবার প্রতিবাদ করেছেন তাঁর অমূল্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে-- 

    "গাহি সাম্যের গান

    যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান। 

    যেখানে মিশেছে হিন্দু,  বৌদ্ধ, মুসলিম, ক্রিশ্চান। "

    নজরুল জনগনের কবি,অত্যাচারিত জনগনের নীরব মৌন বেদনার তিনি সার্থক রূপকার। দরিদ্র-সাধারণ মানুষের উপর ধনীর নির্মম অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ লেখনীতে প্রকাশ করেছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। তাঁর স্বাদেশিকতা ও সংগীত শিল্পের নিপুণতার জন্যে ১৯২৯ খ্রিঃ ১৫ই ডিসেম্বর জাতির পক্ষ থেকে তাঁকে সন্বর্ধনা জানানো হয়। 

    এই জীবন্ত বিদ্রোহী কবির শেষ জীবন খুব দুঃখময়।পুত্রশোক, স্ত্রীর দুরারোগ্য পক্ষাঘাত ব্যাধি,  চিকিৎসা বাবদে অপরিমিত অর্থব্যয়, ঋণকষ্ট প্রভৃতি কারণে তাঁর জীবন পর্যুদস্ত হতে থাকে।তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ১৯৪২সালের মাঝামাঝি সময়ে এক সন্ধ্যায়  রেডিওতে প্রোগ্রাম  করতে গিয়ে তিনি অচমকা বাকহারা হয়ে যান।বাকহারা অবস্থা থেকে ক্রমেই তিনি সম্বিৎহারা অবস্থা প্রাপ্ত হন। সেই যে তিনি মূক ও নিশ্চেতন হয়ে পড়েন তারপর একটানা পয়ত্রিশ বছর বেঁচে থাকলেও তাঁর আর স্বাভাবিক জ্ঞান ফেরেনি।নজরুলের আরোগ্যের জন্য বহু চেষ্টা হয়েছে, এমনকি বিদেশে নিয়ে গিয়েও নিষ্ফল হয়েছে। বেঁচে থেকেও তিনি না বাঁচারই সামিল জীবন যাপন করে গেছেন। অবশেষে১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট বাংলাদেশের ঢাকা শহরে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায় নির্বিশেষে চিরন্তন বাঙালির সমান প্রিয় এই  কবি তাঁর দেহ রক্ষা করেন। কিন্তু আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও এক অংশের দেশবাসীর  মধ্যে সু- চেতনা ও দেশপ্রেমের অভাব  ভীষনষণভাবে চোখে পড়ে। বিভিন্ন রকম সোস্যাল মিডিয়া ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার আগ্রাসনে আমাদের চেতনা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত হওয়ার আগেই ভেঙ্গে চলেছে। তাই  কবির মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর গান সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। কবির মহান প্রয়াণ দিবসে জানাই আন্তরিক বিনম্র শ্রদ্ধা।


    গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেবনাথ

    শিক্ষক, ত্রিপুরা


    আরশিকথা হাইলাইটস


    ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট

    ২৯শে আগস্ট ২০২৫ 



     

    3/related/default