Type Here to Get Search Results !

পুরো বাসাটি যেন দাবাময়!



ট্রপি, পদক ও পুরষ্কারে ঠাঁসা কাঠের তৈরি বড় শো-কেসটি। ভেতরে আর একটি পুরষ্কারও রাখার জায়গা নেই। তাই শো-কেসের উপরে রাখা হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাবায় চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ হওয়া একাধিক পুরস্কার।

পড়ার টেবিলে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বই নেই। দেশি-বিদেশি গ্রান্ড মাস্টার ও সেরা দাবাড়ুদের লেখা কয়েকটি বই চোখে পড়লো টেবিলের এক কোণে। এছাড়া রয়েছে দাবার কোর্ট ও ল্যাপটপ। ল্যাপটপের মনিটরে দেখা গেলো দাবার বিভিন্ন অ্যাপস।

ড্রয়িংরুমের টি-টেবিলের ওপরও দাবার কোর্ট। বাসার সদস্যের মাঝেও দাবা বিষয়ক আলোচনা। পুরো বাসাটি যেন দাবাময়!                               

বাড্ডার ডিআইডি প্রজেক্টের ৯ নম্বর সড়কের ২৮ নম্বর বাড়ি। এ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বাবা, মা, বোন ও ভাইয়ের সঙ্গে থাকে দেশের সর্বকনিষ্ঠ ফিদে মাস্টার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাবায় স্বর্ণপদক প্রাপ্ত মোহাম্মদ ফাহাদ রহমান।

কলিং বেল বাজতেই দরজা খুললেন শেখ নজরুল ইসলাম। এক চিলতে হাসির ঝিলিক তার চোখে-মুখে। বাবার সঙ্গে এগিয়ে এলো দাবার বিষ্ময় বালক ফাহাদও। মুচকি হেসে অভ্যর্থনা জানালো। সহজ-সরল ছোট্ট এ ছেলেটির মায়াভরা মুখখানি দেখলে মনটা ভরে গেলো।

ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার প্রতন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠা সেই ফাহাদ জুনিয়র দাবায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। একের পর এক স্বর্ণ, ব্রোঞ্জ, রৌপ্য পদক ছিনিয়ে আনছে বিদেশ থেকে। তার অর্জনের ঝুলিতে অর্ধশতাধিক পুরস্কার।

বয়স মাত্র ১৩ বছর। গুলশান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে ফাহাদ। বাবা শেখ নজরুল ইসলাম তারই স্কুলের শিক্ষক। তিন ভাই-বোনের মধ্যে ফাহাদ সবার ছোট। বাবার কাছ থেকেই দাবায় হাতেখড়ি। শুরুর দিকে সংসারের সদস্যদের মুখে অন্ন তুলে দিতে টিউশনির পেছনে ছুটতে হয়েছে নজরুল ইসলাম। অভাব অটন যেন জোঁকের মতো লেগেই ছিল। তারপরও ছেলের দাবা খেলার দিকে সময় দিতে কখনোই ভুল করেননি তিনি।

মা মোসা. হামিদা খাতুন সংসারের কাজের পাশাপাশি দাবা খেলায় সময় দেন ছেলেকে। ছেলে একের পর এক চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘ সন্তানের সাফল্যে সব বাবা-মা’ই গর্ববোধ করে। এতে আমিও খুশি। তবে, লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

শেখ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ফরিদপুর থাকলে ছেলেকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। সংসারে অভাব ছিল। সারাদিন টিনশনির পেছনে ছুটলেও ফাহাদকে রাতে সময় দিয়েছি। যখনই সুযোগ পেয়েছি দাবার কোর্ট নিয়ে বসে গেছি। কষ্টের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ছেলেকে বিশ্বের সব চেয়ে পাওয়ারফুল গ্রান্ড মাস্টার করতে আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

একান্ত আলোচনায় ফাহাদ বলে, ‘আমার এখন একমাত্র স্বপ্ন গ্রান্ড মাস্টার হওয়া। সে কারণেই ৮/১০ ঘণ্টা দাবা খেলায় সময় ব্যস্ত থাকি। সবার দোয়া থাকলে অবশ্যই আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।’   


ফাহাদের বড় ভাই মো. ফাতহী রহমান বলেন, ‘ছোট ভাইয়ের এই সাফল্যে আমি অনেক খুশি। আমি এবং আমাদের পরিবার ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। ওকে আমি দেখতে চাই দাবা খেলার সর্বোচ্চ শিখরে।’

ফাহাদ এ পর্যন্ত ৫টি স্বর্ণ, ৩টি রোপ্য ও ৩টি ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক দাবায় ৪টি স্বর্ণ পদক তার সাফল্যের ঝুলিতে। ট্রপি, পদকসহ অর্থশতাধিক পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-২০০৮ সালে শিশু একাডেমি দাবা চ্যাম্পিয়নে স্বর্ণ পদক, ২০০৯-১০ সালে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড স্কুল দাবা চ্যাম্পিয়ন, ২০১১ সালে হবিগঞ্জ ওপেন চেজ টুর্নামেন্টে( চোখ বেঁধে খেলা), ঢাকা জেলা দাবা চ্যাম্পিয়ন।

এছাড়া ২০১১/২০১৪/২০১৫/২০১৬ সালে বাংলাদেশ সাব-জুনিয়র দাবায় চ্যাম্পিয়ন। ২০১৫-১৬ সালে জাতীয় জুনিয়র দাবায় চ্যাম্পিয়ন(অনুর্ধ্ব-১০), ২০১২ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ইয়ুথ চেজ ও ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান স্কুল দাবায় ডাবল চ্যাম্পিয়ন।

২০১৩ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আশিয়ান বসয়ভিত্তিক দাবায় চ্যাম্পিয়ন( অনুর্ধ্ব-১০)। এ সময় সে বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ ফিদে মাস্টার উপাধি পায়। ২০১৪ সালে র‌্যাপিড ওপেন দাবায় বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন, ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক র‌্যাপিড ওপেন দাবা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন, একই বছর মালয়েশিয়ায় অনুর্ধ্ব-১২ দাবা ফেস্টিভ্যালে র‌্যাপিড ওপেনে চ্যাম্পিয়ন।  
  
সর্বশেষ ২০১৬ সালে জাতীয় জুনিয়র দাবায় (অনুর্ধ্ব-২০) অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফাহাদ রহমান। অষ্টম ও শেষ রাউন্ডের খেলায় ফাহাদ ঢাকার স্বর্ণাবো চৌধুরীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় সে।

বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে শ্রীলঙ্কা, ভারত, থাইল্যান্ড, দুবাই, কাতার, রাশিয়া ও মালয়েশিয়ায় নিজের মেধার প্রমাণ দিয়েছেন ফাহাদ রহমান।

প্রতিবেদকঃ প্রভাস চৌধুরী, 
বিশিষ্ট সাংবাদিক, বাংলাদেশ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.