Type Here to Get Search Results !

একটা কবিতার এত প্রাণশক্তি !!" ...ঢাকা থেকে মলয় বালা

'কবিতাটি আমার কলিজায় দাগ লেগেছে। আমি বুঝতে পারছি এটাই মানুষের প্রকৃত জীবন। বাস্তব জীবন সাহিত্য মানুষের রক্ত নিংড়ানো সাহিত্য, যে সাহিত্য লেখা হয়েছে গরীবের রক্ত দিয়ে। যিনি লিখেছেন এবং যিনি কণ্ঠ দিয়ে দিয়েছেন দু'জনকেই আমি একশো মার্কস দিতে চাই। আজীবন আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি সারাজীবন যা স্কুল কলেজ থেকে শিখতে পারিনি, তা আমি এই কবিতা থেকে শিখেছি। আমার এখন বেঁচে থাকতে মন চায় এই কবিতার মাঝে। কবিতাটি শোনার পর থেকে আমার আর এই শহরে থাকতে মন চায় না। মন চাচ্ছে আবার আমি গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষকদের সাথে বসবাস করি”। 'বাঙ্গিফাটা কপাল' কবিতাটি শুনে উল্লিখিত অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের আলোকিত মুখ দাবার গ্রান্ডমাস্টার ফাহাদের বাবা। সত্যিই, একটা কবিতা মানুষকে এভাবে জাগিয়ে তুলতে পারে ! কবিতার নাম ‘বাঙ্গিফাটা কপাল’। গত ৪ই এপ্রিল আকস্মিকভাবে গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সকাল থেকেই মানুষ দেশের দূর দূরান্ত থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সারাদেশ লকডাউন। কোথাও কোনো গাড়ি চলছে না। এই অবস্থার ভিতর দিয়ে মানুষ শতশত মাইল পথ পায়ে হেঁটে, ভ্যান রিকশা যোগে, কখনও বা ট্রাকে চড়ে মাখামাখি করে ঢাকা এসে পৌঁছেছে। করোনার এই মহামারিতে যেখানে মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য দেশে সেনাবাহিনী পর্যন্ত মোতায়ন করা হয়েছে। সেখানে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে দল বেঁধে ঢাকা এসেছে। তারপর সন্ধ্যায় ঘোষণা দেওয়া হলো---গামেন্টস বন্ধ। খুলবে এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে। এদিকে যারা ঢাকায় এসেছে তাদের মধ্যে অনেককেই তাদের বাসায় ঢুকতে দেয়নি বাড়িওয়ালা। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কবি অনিন্দ্য অমাত লেখেন কবিতা ‘বাঙ্গিফাটা কপাল’।
কবিতাটি আবৃত্তি করেন নাট্য নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধা জহির রায়হান। উল্লেখ্য দুজনেই একই ব্যক্তি। কবিতা, উপন্যাস লিখতে তিনি সুনির্দিষ্ট ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। তার অধিকাংশ কবিতায় নৈতিক বয়ান থাকে। 'বাঙ্গিফাটা কপাল' কবিতায় শ্রমজীবী মানুষের অত্যন্ত স্পর্শকাতর অনুভূতি চিত্রায়িত হয়েছে। ১১ই এপ্রিল রাতে কবিতাটি আবৃত্তি শিল্পী মজুমদার বিপ্লব তাঁর টাইমলাইনে কবিতা পোস্ট করেন। ব্যাস, ২৪ ঘণ্টা পেরোতেই কবিতাটি পৌঁছে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের হাতে। মাদারীপুরসহ কিছু কিছু শহরের হাট বাজারের দোকানে দোকানেও কবিতাটি বাজতে থাকে। কবিতাটি শোনার পর সাধারণ শ্রোতারা যেন নির্বাক হয়ে যায়। ফেসবুকের টাইম লাইনে অন্তত হাজার হাজার মানুষের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন। কবিতাটি শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। গল্প, উপন্যাস কিংবা সিনেমা দেখে আমরা সচরাচর কেঁদে থাকি। কিন্তু একটা কবিতা কীভাবে মানুষের চোখে পানি এনে দিতে পারে ? কী আছে এই কবিতার গল্পে, আর কী দরদমাখা কণ্ঠেই বা শিল্পী কবিতাটিকে আবৃত্তি করেছন, যা শুনে মানুষের অনুভূতিকে এভাবে নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু গান কিংবা নানান ঘটনার খন্ডচিত্র ভাইরাল হতে দেখা গেছে। কিন্তু কোনো কবিতা কি কখনো এভাবে ভাইরাল হয়েছে। একটা কবিতার কী এত প্রাণশক্তি ? যা মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়। নিজের অজান্তেই চোখে জল গড়িয়ে পড়ে...! ফাহাদের বাবা হয়তো ঠিকই বলেছেন---সারা জীবন স্কুল কলেজ থেকে যা তিনি শিখতে পারেননি, তা তিনি একটি কবিতা থেকে শিখতে পেরেছেন। প্রকৃত সাহিত্য তো সেটাই, যা মানুষের ঘাম, রক্ত আর জীবন বাস্তবতা থেকে উৎসারিত হয়।


মলয় বালা
সহযোগী অধ্যাপক প্রাচ্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

২৯শে এপ্রিল ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.