মানুষ যে যেই ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন, যে ভাষায়-ই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করুক না কেন, সৃষ্টিকর্তা বলে যে একজন রয়েছেন তা কমবেশী অনেকেই মনে করেন। শুধু মনে করার মধ্যেই সীমিত থাকলে হতো। মনে প্রাণে বিশ্বাসও করেন। পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় সাতশ’ ত্রিশ কোটি মানুষ রয়েছে। গুটিকয়েক ছাড়া সবাই এক ঈশ্বরবাদকে বিশ্বাস করে। কথা হলো সাড়া পৃথিবীর লোক সংখ্যার ২২০ কোটি খ্রিস্টান। যারা খ্রিস্টান তারা ঈশ্বর পুত্র যীশুকে বিশ্বাস করেন এবং মানেন। যাকে মুসলিমরা ঈসা আলাইহিসসালাম বলে মানেন।
যারা হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসেবে মানেন তাদের সংখ্যা পৃথিবীতে ১৬০ কোটি। বাকী যারা রয়েছেন তারা ভিন্ন মতাবলম্বী। আর যারা পৃথিবীতে পৌত্যলিক ধর্মে বিশ্বাসী বা মূর্তি পূজা করেন তাদের সংখ্যা তৃতীয় স্থানে। অর্থাৎ ১০০ কোটি হবে। হিসাব করলে বোঝা যায় ঘুরে ফিরে কমবেশী সবাই সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন, যার অস্তিত্ব কোথাও নেই বা দৃশ্যমান নয়।
ধর্ম বিশ্বাস থেকে আমাদের আরো একটি বিশ্বাস জন্মেছে যা এই পৃথিবীতে মানব জাতির ভালো মন্দ কাজের মাধ্যমে নিজেদের জীবন গঠনের কথা বলা হয়। এর পিছনেও অদৃশ্য একটি বিষয়ের উপর ভয়ের জন্ম দিয়ে থাকে। বলা হয়, এই জীবনে ভালো কাজ করলে পরজনমে স্বর্গ বা বেহেস্ত লাভ হবে। আবার মন্দ কাজ করলে নরক বা দোজখ বাস হবে। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে হাজার লক্ষ কোটি মানুষের যে সার্কেল ঘটছে তাদের মধ্যে কেউ একজনের কথাও শুনিনি, যে মৃৃত্যুর পর পুণঃ জন্ম লাভ করে বলেছেন যে, তিনি মৃত্যুর পর প্রত্যক্ষ করেছেন ওপারে স্বর্গ-নরক বলে কিছুর সন্ধান করে এসেছেন।
এসবের কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই অথচ আমরা পুরো পৃথিবীর মানবজাতি তা বিশ্বাস করছি। তবে কিছু অংশ ব্যতিক্রম। এই বিশ্বাসের মূলে বুঝতে পারি উদ্দেশ্য একটাই যা হচ্ছে শান্তি। মানব জাতির এই শান্তি কামনায় যদি বলি ধর্ম এসেছে, মনে হয় ভুল হবে না। তাই যদি হয়, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সাড়া পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যে মহামারী দেখা মিলছে এটাও কিন্তু ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যাকে অবিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই আমাদের। বর্তমান এই মহামারী থেকে মানুষের জীবন রক্ষার জন্যই কিন্তু বলা হচ্ছে মানুষকে নিরাপদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজ ঘরে অবস্থান করতে।
শুরুতে করোনা ভাইরাসের যে ক্ষমতা তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেনি বলেই অবহেলা করা হয়েছে অনেকটা বুঝে বা না বুঝে। বিশ্বাস তো পরের কথা। একটা পর্যায় এসে মানুষের জীবন হননের যে চিত্র পৃথিবীবাসী দেখতে শুরু করেছে তাতে ডাক্তার বা বিজ্ঞানীগণ তাদের পরীক্ষাগারে গবেষণায় প্রমাণ করেই বুঝতে পারছেন এর ভয়াবহতা। যে কারণে নিরাপদে থাকার কথা বারবার হুঁশিয়ারী দিয়ে বলা হচ্ছে সর্বত্র। চারিদিকের চালচিত্র দেখার পরেও কেন যে মানুষ সতর্ক হচ্ছে না বুঝতে কষ্ট হচ্ছে।
করোনা ভাইরাস পৃথিবীতে মানবজাতির কোন শান্তি বা সুখ প্রতিষ্ঠার জন্য আসেনি। এটি সম্পূর্ণ এসেছে ধংসের জন্য। এ বিষয় কেন মানুষ বিশ্বাস করছে না প্রশ্ন থেকেই যায়। এটাও তো মানুষের কল্যাণেই সতর্ক করা। আমরা ধরে নিতে পারি মানুষকে হুঁশিয়ার করতে এই মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।
বুঝলাম দেশে জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশী। আবাসস্থল বা অন্য কোন কারণে হয়তো দেশের মানুষকে ঘরে থাকার কথায় কাজ হচ্ছে না। নিরাপদে মানবজীবন রক্ষায় চেষ্টার ত্রুটি করা হচ্ছে না। কিন্তু মানুষ এখন এমন অবস্থায় চলে গেছে যে, গুজবে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে যেন বেশি। এর পিছনে আমাদের ছোট বেলা থেকে শেখানো ধর্শ শিক্ষার মাধ্যমে অদৃশ্যকে বিশ্বাস করানোই যেনো বড় কারণ।
গুজবের পাল্লা ভারী হওয়ায় আমরা এমন এক পর্যায়ে চলে গেছি যে, কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা সেটি বিচার করতে আজ ব্যর্থ। যে কারণে এখন পর্যন্ত আমরা মাইকে ফুঁ দিয়ে পানি পড়াকে বিশ্বাস করে পান করি শরীরের রোগ মুক্তির জন্য। বিশ্বাসে পরিত্রাণ মনে করে ধর্মীয় গুরুরা যখন বলেন কোন গাছের পাতা বা ঘাস খেলে রোগ মুক্তি হবে তখন বনবাদার তন্ন তন্ন করে খুঁজি সেই গাছের পাতা বা ঘাস সংগ্রহের জন্য। যার আদৌ কোন ভিত্তি নেই। আবার কতিপয় মন্ত্রী আছেন, যাদের কথা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে তাদের মান্যতা বা সম্মাণের কারণে। এটাও আমাদের জাতিগত সমস্যা। শিক্ষার অভাবে নিজেদের ভিতর যাচাই বাছাই করার যেহেতু কোন জোড়ালো শক্তি নেই তখন এমনটাই হয়।
স্বয়ং আমাদের দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি বলেন, "করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই, শতকরা আশি ভাগ মানুষ এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে” সে ক্ষেত্রে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কেন ঘরে বসে থাকবে? দোষতো ওদের নয়। দোষ হচ্ছে এদের, যারা সাধারণ মানুষদের সচেতন হতে না বলে বলছে তার উল্টোটা, তারা।
যেহেতু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ (বলতে পারি এটি মানব জাতির মধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে) এখনো কোনটি সত্য বা কোনটি মিথ্যা বুঝতে পারছে না সেখানে মানুষদের লকডাউনে নেবার আগে মন্ত্রীদের মুখকেই লক করার ব্যবস্থা করা দরকার। তবেই যদি মানুষ সরকারের বা যারা সত্যিকার অর্থে মানুষকে ভালোর জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের কথা শুনে এবং বিশ্বাস করে নিরাপদে থাকার কথাকে বিশ্বাস করতে পারবে।
সবচেয়ে কঠিন সংবাদ এবং বাস্তব সত্য এরই মধ্যে বাংলাদেশে বেশ ক’জন আলেম শ্রেণির লোক যারা অন্যদের এই করোনার বিরুদ্ধে বলে অভয় দিয়েছেন তারা এই মহামারীর সময়ে ইন্তেকাল করেছেন। এখানেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন এসে দাঁড়ালো। ধরে নিলাম তাদের কারো মৃত্যুই করোনায় আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর তাদের কথায় বিশ্বাসী বা ভক্তরা সরকারী নির্দেশ অমান্য করে দাফন করতে জমায়েত হয়েছেন। কারণ তাদের বিশ্বাস করোনা তেমন কিছুই না।
তাহলে এই বিশ্বাসের জন্য দোষ দেবেন আপনি কাদের। সরিষার ভিতরেই যে ভূ্ত !!
পি. আর. প্ল্যাসিড, জাপান
প্রবাসী সাংবাদিক
২৯শে এপ্রিল ২০২০
পি. আর. প্ল্যাসিড, জাপান
প্রবাসী সাংবাদিক
২৯শে এপ্রিল ২০২০