Type Here to Get Search Results !

স্মৃতির পাতা ঘেটে টেনে আনলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু স্মৃতিঃ পি আর প্ল্যাসিড,জাপান


 ১৯৯৩ সালের কথা। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত খবর গ্রুপের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন চিত্রবাংলা-য় জাপান থেকে লিখেছিলাম, "সোনা ঝরা সন্ধ্যা, সুনীলের সাথে একদিন"। লেখার শিরোনামটি আমার দেয়া শিরোনাম ছিল না। তবুও মেনে নিলাম নিজের লেখার সাথে ছিল, তাই। লেখার সাথে আমার দেয়া শিরোনাম ছিল ভিন্ন। 

 যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় বাংলাদেশ থেকে টোকিওতে খুব বেশি পত্র-পত্রিকা আসতো না। বাংলা পত্র-পত্রিকার চেয়ে এর পাঠকের সংখ্যা বেশি থাকায় পত্রিকার প্রতিটি কপি হাত বদল হতো অনেক বেশি। অন্যান্য পত্র-পত্রিকার সাথে চিত্রবাংলা ম্যাগাজিনটির পাঠক বেশি ছিল বলে চিত্রবাংলাও আনা হতো বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যা।

এরশাদ সরকারের সময়কালে দেশে খবর গ্রুপের বেশ কিছু সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ছিল। এগুলো প্রচার প্রসার আর রমরমা ব্যবসায় এগিয়ে ছিল নানা কারণে। আমি ছাত্র জীবনে এর অফিসে যেতাম মাঝে মধ্যে। জাপান এসেও সময় পেলে এসব ম্যাগাজিন পড়তাম।  শুরুতে লিখতামও এসবে।

টোকিওতে একবার একটি সাহিত্য সম্মেলনে আসলেন দুই বাংলার খ্যাতিমান কয়েকজন কবি সাহিত্যিক। তার মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে যেহেতু এসব কর্মকান্ডের সাথে জড়িত তাই টোকিওতে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান বাদ দেইনি। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম। অনুষ্ঠান শেষে আসার সময় ভাবলাম যে করেই হোক দেখা করতে হবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে। তখনকার সময় আজকের মতো এত টেলিফোন ব্যবস্থা ভালো ছিল না। তাই জনে জনে খোঁজ করলাম কোথায় আছেন দুই বাংলার খ্যাতিমান লেখকবৃন্দ।

অনেক কষ্টে যোগাযোগ করলাম মূল আয়োজক করীর চৌধুরী নামে একজন সাহিত্যপ্রেমীর সাথে। তার মাধ্যমেই কথা বললাম আমার স্বপ্নের (লেখক) পুরুষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে। টেলিফোনে আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, সুনীলদা আমি কলকাতা গিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে অনেক কষ্টে দেশ পত্রিকার অফিসে গিয়েছিলাম। আপনার দেখা সেবার পাইনি। তখন আপনি রাশিয়ায় ছিলেন ভ্রমণে। এবার টোকিও এসছেন, দেখা করার খুব ইচ্ছে। তখন তিনি জানতে চাইলেন আমি কোথায় থাকি, কি করি ইত্যাদি। সব শোনার পর বললেন, উনি আমার কাজের স্থানে আসবেন। এরপর আলোচনা করে দিন তারিখ ঠিক করে নিলাম। 

আমি তখন টোকিও কাতস্যুসিকা ক্যু-র শিবামাতা স্টেশনের কাছে একটা ইন্ডিয়ান (খাবারের দোকান) রেস্টুরেন্টে বাবুর্চির কাজ করি। দিনটি সম্ভবত বুধবার ছিল। বুধবার দিন রেস্টুরেন্ট ততটা ব্যস্ত থাকে না জানি বলে আমি সেভাবেই সময় বলেছি আয়োজককে, যেনো আমার আকাঙ্ক্ষিত অতিথিদের নিয়ে আসেন। সকাল এগারটার সময় সদলবলে আয়োজক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ অন্যান্য অতিথিদের নিয়ে চলে এলেন আমার কর্মস্থলে। সাথে ছিলেন কবি আশিষ স্যানাল এবং কবি রফিক আজাদ।

রেস্টুরেন্টে এসে যখন ঢুকলেন তখন দু' একজন কাস্টমার ছিলো রেস্টুরেন্টে। তাদের খাবার তৈরি করে দিয়ে আমি বের হলে এসে দেখা করলাম আগত অতিথিদের সাথে। বিশাল দেহের অধিকারী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে আমার চোখের কোনে অশ্রু জমলো আনন্দে। নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না আমি যে তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে। তার সামনে আমি তখন অনেকটাই পুচকে। বয়স এবং স্বাস্থ্য কোনোটাই ওনার সামনে দাঁড়িয়ে তোলনা করার মতো ছিল না।

সুবিধা মতো টেবিলে বসিয়ে জানতে চাইলাম কার কি পছন্দ, কি খাবেন? তাঁরা বললেন, ইন্ডিয়ান বিয়ার, সাথে গরু আর মাটন ভূনা করে দিতে হবে। উঠে গিয়ে খাবার তৈরি করে নিয়ে এসে টেবিলে পরিবেশন করলাম। ওনাদের সাথে আমিও বসলাম। কথা ছিল দুপুরে খেয়ে চলে যাবেন। কিন্তু গেলেন না। রাত অবধি আমার সাথে আমার কর্মস্থলে বসেছিলেন। যতক্ষণ ছিলেন পুরো সময় ধরে খাবার আর বিয়ারের উপর ছিলেন তাঁরা। তাঁদের খাইয়ে আমি যেনো অনেক বড় কিছু জয় করতে পেরেছি এমন মনে হয়েছিল সেই সময়।

এতবড় মাপের একজন লেখকের সাথে বসে কথা বলছি, যেনো কথা গুছিয়ে বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। কোন কথা রেখে কোন কথা বলবো মনের ভিতর সাজাতে পারছিলাম না। বিষয়টি কবি রফিক আজাদ বুঝতে পেরে আমাকে কথা বলায় সহযোগিতা করলেন। 

কথা বলার শুরুতেই আমি বললাম, ১৯৮৬ সালে আমার কলকাতা ভ্রমণের কথা। সেই সময় কলেজ স্ট্রিট থেকে অনেকগুলো গল্প আর উপন্যাসের বই কিনে নিয়ে এসেছিলাম। তার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল কালজয়ী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই। কবিতার বইও ছিল একটি। যে বইতে ছিল তাঁর বিখ্যাত কবিতা "কেউ কথা রাখেনি" কবিতাটি।

লেখকের বই এবং লেখালেখি নিয়ে কথা বলছিলাম, তাই সম্ভবত আমার সাথে সময় দেবার কথা ভেবেছিলেন তখন তিনি। কথার এক পর্যায় আমি জানতে চাইলাম তখনকার আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে। তসলিমা নাসরিনের লেখা লজ্জা এবং তাকে আনন্দ পুরস্কার দেয়া নিয়ে। আমি এক মিনিট সময় লাগিয়ে কোনো একটা প্রশ্ন করলে একঘণ্টার বেশি সময় লাগিয়ে উত্তর দিলেন। আমার সেই বয়সে নানা কারণে তাসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গে কিউরিসিটি ছিল তাই বারবার বিভিন্ন অজানা বিষয় পরিষ্কার হতে প্রসঙ্গ তুলেছি।

 ভ্রমণ বিষয়ক লেখাও যে সাহিত্য রসে লেখা যায় সেটি লেখকের রাশিয়া ভ্রমণের উপর লেখা বইটি না পড়লে বুঝতাম না। আমি বললাম তাঁকে, তাঁর সেই বই পড়ে আর কিছু মনে করতে না পারলেও রাশিয়ার মেয়েদের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি এবং জাপানে এসে তার প্রমাণ পেয়েছি। সুনীলদা আমার কথা শুনে বেশ হাসলেন। তখনও লেখকদের মেয়ে প্রীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞানের পরিধি ছিল কম। যা এখন অনুধাবন করতে পারি নিজেই।

আমি কলকতা থেকে অনেক বই কিনে নিয়ে গিয়েছি তখন। সব বই পড়া শেষ না হলেও পরিচিতদের পড়তে দিয়ে আর ফেরত আনা হয়নি বইগুলো। বাংলাদেশে একটা কথা প্রচলিত আছে কাউকে বউ আর বই ধার দিতে নেই। সেই সময় আমার বউ ছিল না যদিও বই ছিল। যা অন্যদের ধার দিয়ে কথাটার সত্যতা বা কারণ বুঝতে পেরেছি।

সলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশে শিক্ষিত সমাজে ভালো বা মন্দ যে ভাবেই বলি, চিনে না এমন লোকের সংখ্যা কম। আমিও চিনি তাকে। ব্যক্তিগতভাবে বাসস এর নিচে কয়েকবার দেখাও হয়েছিল। যতটা মনে পড়ে রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে দেখা হয়েছিল। তখন তার কবিতা আনতে গিয়েছিলাম সেখানে। আমি তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত এবং পাঠক ছিলাম যে কারণে তাঁর লেখা কোথাও প্রকাশ হলে তা খুঁজে প্রায় সব লেখাই পড়েছি। ভালো লাগতো তাই।

তসলিমা নাসরিনের লজ্জা বইটি যেই পটভূমিতে লেখা, সেই পটভূমি আমি প্রত্যক্ষ করেছি দেশে, পড়েছিও। আমার কাছে বইটি এতটা আলোচনা করার মত মনে হয়নি তখন। তাই তাকে কলকাতা থেকে আনন্দ পুরস্কার প্রদানের বিষয়টি জানার জন্য বারবার যখন প্রশ্ন করছিলাম তখন তিনি আমাকে বললেন, আমরা তার লজ্জা বইয়ের জন্য পুরস্কৃত করিনি, কলামগুলোর জন্য পুরস্কার দিয়েছি। তখন মনে হল, আমি একজন পাঠক হিসেবে তাঁর লেখার প্রতি যতটা ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম অর্থাৎ আমাকে যদি তাঁর লেখা আকৃষ্ট করতে পারে তাহলে আনন্দ গ্রুপকেও আকৃষ্ট করা স্বাভাবিক। সুতরাং তারা পুরস্কার প্রদান করতেই পারে।

সুনীলদা কথার মাঝে একসময় আমাকে ডেকে তাঁর পাশে বসিয়ে কয়েকটা ছবি তুলিয়েছিলেন। ফিল্মের যুগের ছবি সব সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। তবে একটা ছবি আমার কাছে কিভাবে রয়ে গেল জানি না। সেটাই এখন আমার স্মৃতি।

জাপান থেকে আমি বাংলা-জাপানি ভাষায় একটা মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম, নাম ছিল বিবেক। বর্তমানে সেটি বিবেকবার্তা নামে অনলাইনে ভেসে বেড়ায়। এই ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে জাপানে বাঙালি কমিউনিটিতে একটি সাহিত্য পুরুষ্কার প্রবর্তন করেছি যা প্রথম দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে। পরবর্তীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেবার পরিকল্পনা ছিল। দুর্ভাগ্য তার আগেই তিনি প্রয়াত হলেন। আমার সেই ইচ্ছে অপূরণীই রয়ে গেল। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এখন প্রয়াত ঠিকই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কাজ কখনো প্রয়াত হবার নয়। যুগযুগ ধরে বাঙালি তাঁর করে যাওয়া এসব কাজ নিয়েই কাজ করবেন। আমার আশা ও বিশ্বাস তিনি যেখানেই থাকুন ভালো আছেন এবং ভালো থাকবেন। তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলোই তাঁকে স্মরণ করতে বাধ্য করবে প্রতি নিয়ত। 

আজ (৭ সেপ্টেম্বর) তাঁর জন্মদিবস। আজকের এই শুভদিনে আমি বিশেষভাবে স্মরণ করছি বাংলা সাহিত্যের মহাপুরুষ, শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধায়কে।


পি আর প্ল্যাসিড,জাপান 

৭ই সেপ্টেম্বর ২০২০

  


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.