"অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা তোমাকে আজ আলিঙ্গন করেছি।আমার নরম পেলব শরীরে তোমার কঠিন ইস্পাত শরীরের স্পর্শ পেতে চেয়েছি।ভীষন ভাবে চেয়েছি,তোমার সিগারেটে পোড়া ঠোঁট দুটো চেপে আসুক আমার ঠোঁট জোড়াতে।কিন্তু একি!তুমি তো সেই তুমি নেই।সেই মাতাল করা শরীরের ঘ্রাণ আর নেই তোমাতে।আমাকে জড়িয়ে ধরা তোমার হাত দুটোকে আজ আমার বিষাক্ত সাপের দেহের মতো মনে হয়েছে।যেন ঝাপটে ধরে আমাকে মেরে ফেলতে চায়...."
এটুকু লিখেই তিশা কখন অতীতে হারিয়ে গেছে টের পায়নি।হঠাৎ পিঠে কোমল হাতের স্পর্শে ভীষন চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখলো টুপুর দাঁড়িয়ে আছে।তাকিয়ে আছে তিশার সামনের খোলা ডায়েরির কালো লেখা গুলোতে। পড়া শেষ হতেই হঠাৎ রাগে ফেটে পড়লো। তিশা কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্য হাতে ধরে থাকা ছোট টিফিন বক্সটা ফ্লোরে জোরে আছাড় মারলো।তিশা চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলো।ততোক্ষনে তেলে ঝোলে মাখানো ফ্লোরে টুপুর পাগলের মতো নিজের পা দিয়ে বাড়ি মারছে আর চিৎকার করছে,
"তুই কি করে পারলি বুবু?কি করে পারলি!তুই আমার বোন?তুই আমার বোন!ভাবতেই বমি আসছে বুবু।ভাবতেই বমি আসছে।"
টুপুর যখন রেগে যায় তখন এক কথা দুই বার উচ্চারণ করে।কিন্তু আজ কি হলো টুপুরের?কেন চিৎকার করছে! তিশা ফ্লোরের তেল ঝোল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে টুপুরকে ধরার চেষ্টা করলো। বুঝতে পেরে টুপুর ঝটকা মেরে নিজেকে সরালো। টেবিলে রাখা তিশার সদ্য লেখাটা টান দিয়ে নিয়ে তিশার মুখের উপর নাড়তে নাড়তে বললো,
"তোর শিক্ষা হয় না বুবু?এত এত প্রমান সামনে এনে দেয়ার পরও তোর শিক্ষা হয় না?আমাদের পরিবারের মুখ ধুলায় লুটানোর জন্য তুই একজনই যথেষ্ট বুবু। একজনই যথেষ্ট। মায়ের এত এত চোখের জলও তোর কাছে কিছু না?"
তিশার কাছে এবার ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিস্কার হয়ে গেলো। আর সাথে সাথে মাথায় রক্ত উঠে গেলো।এমনিতে তিশাকে সবাই ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে হিসেবে জানে। কিন্তু রেগে গেলে তখন আর কোনো হুশ থাকে না। আর রগচটা টুপুরকে ঠিক করতে তিশা সব সময় একটা কৌশলই প্রয়োগ করে। তবে আজকে টুপুরকে থামাতে তার মেকি আচরণ করতে হলো না। ঘটনা বোধগম্য হওয়ার সাথে সাথে তিশার হাতটা নিজের অজান্তেই উঠে এলো। সজোড়ে টুপুরের গালে একটা চড় দিল। সাথে সাথে টুপুরের ফর্সা গালে তিশার পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেলো। টুপুরের হতভম্ব ভাব কাটার আগেই তিশা ওকে টানতে টানতে রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমে ঢোকালো। ঢুকিয়েই ঝর্ণা ছেড়ে দিল। তারপর টুপুর দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণ করার আগেই তিশা বললো, "টুপুর আজকে যা হলো, তা আর দ্বিতীয়বার যেন না হয়। তুমি আমার যে লেখাটা দেখেছো,সেটা আমার নতুন উপন্যাসের অংশ। আশা করি তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না।"
তিশা নিজ হাতে পুরো ঘর পরিস্কার করলো। গায়ের জামাটা সবে পাল্টেছে এমন সময় কলিংবেলের শব্দ। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুললো। আরেক ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক জাহানারা বেগম। তিশা আর টুপুরের মা। তিশার ফ্ল্যাটের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। তিশা একপাশে সরে বললো,"এসো মা। ভেতরে এসে বসো।"
জাহানারা বেগম একটুক্ষন দাঁড়ালেন। কিছু একটা পড়তে চেষ্টা করলেন মেয়ের মুখে। না, তিশার মুখের কোনো ভাষা এখন আর তিনি পড়তে পারেন না। আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো বুকটা চিঁড়ে। সিঙ্গেল একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, "তিশা মা টুপুরের কাছে আর ঘরের চাবি রাখিস না। যেদিন তোর জন্য ভালোমন্দ কিছু রান্না করে পাঠাবো,সেদিন তোকে জানিয়েই পাঠাবো। নয়তো তোকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে তোর কষ্টের কারণ হতে হবে। "টুপুর কোথায়?"
তিশাও ততোক্ষনে একটা সোফায় বসেছিলো। মায়ের কথার উত্তর দেয়ার আগেই টের পেল পেছনে মৃদু শব্দ হয়েই থেমে গেলো। আসার সময় বাথরুমের দরজাটা খুলে দিয়ে এসেছিল। গলাটা উঁচু করে বললো,"টুপুর বিছানায় জামা রাখা আছে। পরে ফেলো। মাথাটা ভালো করে মুছো। মা এসেছে তোমাকে নিতে।"
তারপর আর মা মেয়ের মধ্যে মুখে কোনো কথা হলো না। যা হলো সব চোখে আর মনে। একটু পর টুপুর এসে থপ করে বড় বোনের পায়ের কাছে বসে পড়লো। দুই হাতে তিশার পা জড়িয়ে ধরে হাঁটুতে মুখ ঘষতে লাগলো।
" বুবু মাফ করে দাও। আমার মাথাটা হঠাৎই গরম হয়ে গেলো। আমি এমনটা করতে চাইনি। বুবু প্লিজ।"
তিশা দু'হাত দিয়ে ধরে টুপুরকে উঠিয়ে পাশের সোফায় বসিয়ে শুধু বললো,
"দেখো টুপুর তোমার মাথা গরম স্বভাব তো আজকের না। অনেক আগের। কিন্তু আমি ইদানিং লক্ষ করছি তোমার এই স্বভাবটা মনে হয় আরো বেড়েছে। তোমার কি মনে হয় না, এবার একজন কাউন্সিলরের appointment নেয়া প্রয়োজন?"
এতক্ষনের অনুশোচনার চোখ এক নিমিষে অগ্নিবর্ণ ধারণ করলো। চোখ তুলে তিশার দিকে তাকিয়েই মায়ের দিকে ঘুরে বললো, "মা চলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।"
জাহানারা বেগম কিছু বললেন না। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আজ তিনি ক্লান্ত। নিরবে উঠে ছোট মেয়েকে অনুসরণ করলেন। সিঁড়িতে টুপুরের জুতার খট খট আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়াটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিশা শুনলো। তারপর ধীর পায়ে আবার গিয়ে নিজের পড়ার টেবিলটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আনমনে কিছুক্ষন টেবিলে রাখা বই গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলো। শরীরটা তো ওর এক জায়গাতেই আছে কিন্তু লাগামহীন ঘোড়ার মত ছুটে চলা মনটাকে কোনোমতেই ধরতে পারছে না তিশা। ঝোল লেগে হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজটা নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো লেখা গুলোর দিকে। "সত্যিই তো! উপন্যাসের লাইন হলেও কথাগুলো তো তিশার নিজের কথা। রিপন ওর জীবন থেকে যেভাবে চলে গেল। সেই জায়গা থেকে রিপনকে নিয়ে ও কি লিখবে! তাই আজ হঠাৎ যখন লাইনগুলো মাথায় আসলো। তখন দেরি না করে লিখে ফেললো ঠিকই। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হলো কথাগুলো রিপনকে নিয়েই লেখা। অবচেতন মন একবার রিপনের দেখা পেতে চায়। শুধু দেখা পেলেই চলবে না। একবার রিপনকে জড়িয়ে ধরতে চায় এবং রিপন যে তিশাকে আর ভালোবাসে না সেটাও তিশা নিজের অনুভূতি দিয়ে বুঝতে চায়। তাই হয়তো ঐ কয়টা লাইনের আবির্ভাব। কিন্তু এতে তিশার কি দোষ! তিশা যখন কাগজ কলম নিয়ে বসে তখন কি আর ও নিজের মাঝে থাকে? এটা কি জানে না টুপুর? জানে। তবে কেন আজ এমন হলো। কিছুতেই তিশার হিসাব মিলছে না। হলুদ হয়ে যাওয়া লেখাটা দেখে দেখে আবার অন্য কাগজে ফ্রেশ করে তুললো। তারপর পাশের বীনে কাগজটা ফেলে দিয়ে লাইট বন্ধ করে খাটের মাথার কাছে জানালার পাশে বসলো। কখন সন্ধ্যা গরিয়ে রাত নেমেছে সে খেয়াল নেই তিশার। কি যে সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে! চাঁদ দেখলেই রিপনের কথা খুব মনে পড়ে।
এরকম চাঁদনী রাতে প্রায়ই ওরা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো। খুঁজে খুঁজে খোলা জায়গা বের করে দু'জন বসে বসে চাঁদ দেখতো। চাঁদ দেখার সময় ওরা ফিস ফিস করে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতো। যেন ওরা জোড়ে কথা বললেই চাঁদটা দৌড়ে পালাবে। দু'জন দুজনের হাত ধরে থাকতো। এই চাঁদ দেখা নিয়ে একবার একটা মজার ঘটনা আছে ওদের।
ঢাকা শহরে আসলে তেমন খোলামেলা জায়গা নেই। ওদের ফ্ল্যাটটা ধানমন্ডিতে। একবার কি মনে হলো রাত বাজে প্রায় ১১টা। রিপন গাড়ি ছোটালো উল্টোদিকে। জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই। তাই তিশা আর সেদিকে মন দেয়নি। বরং নতুন কেনা একটা রবীন্দ্র সঙ্গীতের সিডি গাড়িতে ছেড়ে দিল। এসি বন্ধ করে জানালার গ্লাস নামিয়ে দিল। আর বরাবরের মতো তিশা তার ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুল মেলে রাখলো রিপনের বাম উরুর উপর। গাড়ি চলছে,গান বাজছে। তিশার খোলা চুল রিপনের চোখে মুখে এসে লাগছে। আর রিপন, তিশার মনে হচ্ছে এই তো স্বর্গ।
মানুষ আসলে সুখের অসুখে ভোগে। সুখ হাতের নাগালে থাকলেও মানুষ সুখের দেখা পাওয়ার জন্য মরিচিকার পেছনে ছোটে। সুখ তো ঘরে। সুখ তো স্ত্রীর নরম ঠোঁটে। সুখ তো স্বামীর লোমশ বুকে।
চাঁদটা যখন ঠিক মাথার উপর তখন ওরা ডেমরা ছাড়িয়ে আরো খানিকটা সামনে। এদিকে আসলে মনে হয় ঢাকা শহরের বাইরে চলে এসেছে। কেমন নিরব এলাকা। রাস্তার আলো গুলোও মনে হয় ঠিকমতো আলো দিতে ভয় পায়। ওরা রাস্তার ধারে গাড়িটা পার্ক করে পাশাপাশি বসলো চাঁদ দেখতে। সবে মাত্র দুজনের মাঝে রোমান্টিকতা জমে উঠেছে এমন সময় টহল পুলিশের গাড়ি। তারপর কি কান্ড। তিশা রিপন দু'জন স্বামী স্ত্রী সেটা বোঝাতেই গিয়ে আর চাঁদ দেখা হলো না। এমন কত স্মৃতি তিশার মনের উপর ভারী পাথর হয়ে জমাট বেঁধে আছে। একবার রিপনের দেখা পেতে চায় তিশা। একবার সরাসরি রিপনের মুখোমুখি হয়ে রিপনের চোখে চোখ রেখে তিশা দেখতে চায় সত্যিই কি রিপন আর তিশাকে ভালোবাসে না!
টুপুর আর তিশা দুই বোন। এক মায়ের পেটের বোন হওয়া স্বত্বেও দুজনের স্বভাব মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। তিশা আর রিপন যখন চুটিয়ে প্রেম করছে তখন টুপুর নিজের সংসারে মনোযোগী গৃহিণী। তিশার ছোট হলেও টুপুর বিয়ে করেছে আগে। মা আর দুই বোনের সংসারে কিছু মনে করার কেউ নেই। আর আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও ওদের সংসার নিয়ে মাথা ব্যথা কম। তিশার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আত্মীয় স্বজন সব দূরে সরে গেছে। যদি বাপ মরা দুই মেয়ের দায়িত্ব নিতে হয়। অবশ্য জাহানারা বেগম কখনোই নিজের সংসারের ব্যাপারে কারো কাছে হাত পাতেননি। স্বামীর রেখে যাওয়া মূলধন কাজে লাগিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে তার সংগ্রামী জীবন। কথায় আছে পরিপূর্ণ সুখ আসলে কারো জীবনে নেই। জাহানারা বেগমের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দুই মেয়ের মাঝে ছোট মেয়ে তার জীবনের এক কষ্টের অধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই তার বিভিন্নরকম অযৌক্তিক আব্দার জাহানারা বেগম মিটিয়েছেন। ছোট বলে হয়তো প্রশয়টাও একটু বেশি ছিলো। তাই এখন এসে তার নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। কেবল মনে হয় নিজের হাতে ধরে মেয়েটাকে তিনি ধ্বংস করেছেন।
আজকে এই ছেলের সাথে তো কালকে ঐ ছেলের সাথে মেয়েটাকে দেখা যেত। পাড়ার লোকের কথায় অতিষ্ঠ হয়ে বার কয়েক গায়ে হাত তুলেছেন। কিন্তু মেয়ে উল্টো ধারালো যা কিছু সামনে পেয়েছে তাই দিয়ে নিজেকে রক্তাক্ত করেছে। অনেকবার মানসিক ডাক্তার দেখাতে চেয়েছেন জাহানারা বেগম। পারেননি। নিজেকে মাঝে মাঝে ব্যর্থ মা মনে হয়েছে।
একদিন জাহানারা বেগম বারান্দায় বসে সুঁই সুতায় কাজ করছিলেন। টুপুর পেছন থেকে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বললো, " মা আমি তুহিনকে বিয়ে করবো।"
কে তুহিন কি তার পরিচয় তা জাহানারা বেগম জানেন না। সেই মূহুর্তে তার জানতেও ইচ্ছে করেনি। কানে শুধু টুপুরের বিয়ে করার কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। টুপুরের বিয়ে হয়ে গেলে যেন তিনি মুক্ত হয়ে যান। যতটুকু খোঁজ খবর না নিলেই নয়,ততোটুকু নিয়ে তুহিন নামের ছেলেটার সাথে টুপুরের বিয়ে দিয়ে দেন।
সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে আজো জাহানারা বেগমের মনটা ভীষন ভালো লাগায় ভরে ওঠে। তুহিন ছেলেটা ভীষন ভালো ছিলো। জাহানারা বেগম তিশাকে নিয়ে যতটা কষ্ট করেছেন, তুহিন যেন অল্পদিনের মধ্যে সব ভুলিয়ে দিল। জাহানারা বেগম একটি ছেলে পেলেন।
সবকিছু খুব ভালো চলছিলো। টুপুর,তুহিন দুজনেই প্রস্তুত হচ্ছিল সন্তানের বাবা মা হওয়ার জন্য। হঠাৎ একদিন খবর এলো তুহিন আর নেই। সামনে তিশা আর রিপনের বিয়ে। সেই বিয়ের বাজার করতে টুপুর আর তুহিন গিয়েছিল এলিফ্যান্ট রোডে। শপিং শেষ করে দুজনে গাড়িতে উঠতে যাবে, রাস্তার ওপার থেকে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বুলেট এসে তুহিনের বুকে বিঁধলো। একটা বুলেট তুহিনের জীবনটা এক নিমিষে কেড়ে নিল। টুপুর বুলেট ছোঁড়া মানুষটিকে স্পট দেখেছে। আর সেটাই হয়েছে টুপুরের জীবনের কাল। টুপুরের কোনো এক কালের প্রেমিক পুরুষ এই কাজটি করেছে। চোখের সামনের এত বড় ঘটনাটা টুপুরের মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারেনি। অনেকদিন টুপুর তাই মানসিক হাসপাতালের বাসিন্দা ছিল।
মোটামুটি সুস্থ হয়ে যখন টুপুর মা আর বোনের কাছে ফেরত এলো,তখন টুপুরের স্বভাবে যোগ হয়েছে আরো কিছু আচরণ। যখন তখন যে কোনো কথায় রেগে যাওয়া। অনায়াসে টুপুরকে হিংসুটে, বদমেজাজি উপাধি দেয়াই যায়।
প্রথম প্রথম তিশার বর রিপনের সাথে টুপুর কথা বলতো না। অথচ এক সময় কত সুন্দর সম্পর্ক ছিলো দুজনের। ব্যাপারটা বুঝতে তিশা ও জাহানারা বেগমের কিছুটা সময় লেগেছিল। হঠাৎ একদিন রিপনকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তিশা ধৈর্য্য ধরে মন শক্ত করে কিছুদিন অপেক্ষা করেছিল। হয়তো কোন কাজে রিপন কোথাও আটকা পরেছে। এই বলে মনকে শান্তনা দিতে থাকলো। চায়নি ব্যাপারটা জানাজানি হোক। কিন্তু যখন প্রতি মিনিটে রিপনের ফোনে ফোন দিয়ে বন্ধ আসছিল তখন অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল তিশা। যেখানেই যাক ফোনটা তো চালু থাকবে। চার্জ না থাকলে সেটা ১ দিন ২ দিন হতে পারে, ১/২ সপ্তাহ যেন বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এমন যখন অবস্থা তখন তিশা প্রস্তুতি নিচ্ছিল থানা পুলিশ করার। এরই মধ্যে তিশার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছিল। একদিন তিশার সাথে একা দেখা করতে এসে অনেক ভনিতার পর টুপুর রিপনের মোবাইল। মোবাইল এসএমএস সাথে মোবাইলে তোলা অচেনা একটি মেয়ের সাথে অনেক গুলো ছবি নিয়ে হাজির। তিশা এসবের কোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত ছিল না। যার কারনে মুহূর্তের জন্য একটু ভরকে গিয়েছিল। কিন্তু কেন যেন বিশ্বাস হয়নি। তবে মা এবং ছোট বোনের চাপাচাপিতে থানা পুলিশ হাসপাতালকেও কাজে লাগাতে পারেনি।
তবে দিনের পর দিন রিপন ছাড়া বেঁচে থাকাও যেন দায় হয়ে পড়ছে। যেদিন টুপুরের এমন আচরণ আর মায়ের মৌনতা তিশার মনকে বিদ্রোহী করে তুললো। সেদিনই হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিল," আর না। বেঁচে থাকতে হলে নিজের মনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে।"
এতদিন পর কেন যেন মা,বোনের চাইতে রিপনকেই তিশার অনেক বেশি আপন মনে হল। যদি সত্যিই রিপন তিশার সাথে থাকতে না চায় তাহলে তিশার সাধ্য কি রিপনকে ধরে রাখার! কিন্তু সেই কথাটা তো তিশাকে জানাতে হবে। তিশা যখন আবার মনকে শক্ত করে মা, বোনকে না জানিয়ে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে রিপনকে খোঁজার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই মুহূর্তে একদিন ছুটির সকালে কলিংবেলের কর্কশ শব্দে তিশার ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম চোখে দরজা খুলে কাউকে চোখে পড়লো না। তবে দরজার নিচে একটি সাদা খাম নজরে পড়লে তিশা সেটি তুলে দ্রুত হাতে খামটি খুললো। চিঠিতে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে তিশার মাথাটা বো করে ঘুরে উঠলো। কোনো রকমে দরজার হাতল ধরে নিজের পরে যাওয়াটা রোধ করলো।
রমনা পার্কের একটি বেঞ্চিতে জাহানারা বেগম ও তিশা পাশাপাশি বসা। জাহানারা বেগম গত এক ঘন্টা যাবত কেঁদে চলেছেন। তিশা মুখ শক্ত করে বসে আছে। ওর আর কিছু বলার নেই। অজানা এক সহৃদয় ব্যক্তির চিঠিতে রিপনের কথা জানতে পেরে সেদিন সকালে তিশা কিছু না খেয়ে কোনো রকম গায়ের জামাটা পাল্টে তাদের নিজেদের সাভারের বাগানবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। প্রথমে কেয়ারটেকার ও কাজের লোকের মোবাইল ফোন গুলো জব্দ করে তারপর তালা দেয়া একটা রুম থেকে রিপনকে উদ্ধার করে তিশা। প্রায় চার মাসের না দেখা মানুষটিকে চিনতে পারছিল না তিশা। দাঁড়ি মোচে সুন্দর মুখটা ঢাকা পড়েছিল। চোখটাতে রাজ্যের শূন্যতা। কি হচ্ছে তার সাথে সেটা যেন বুঝে উঠতে পারছে না। নিজের মনের আক্রোশ যে মায়ের পেটের সহোদর বোনকেও পরোয়া করে না তার প্রমান রিপনের উপর টুপুরের অত্যাচার। বাকরুদ্ধ তিশা শুধু প্রয়োজনীয় কাজ সেরেছে। মুখে কোনো শব্দ করতে পারেনি।
অনেকক্ষন থেকে কাঁদতে থাকা জাহানারা বেগমের হাতটা তিশা চেপে ধরে। মৃদু কন্ঠে অনেক কষ্টে উচ্চারণ করে, " মাগো জানতাম ঘরের দূর্বল সন্তানটিকে বাবা মা বেশি আদর করে। তার প্রতি মায়া অনেক বেশি থাকে। তাই বলে তুমি কি করে ভুলে গেলে আমিও তোমার সন্তান! দিনের পর দিন টুপুর অন্যায় করেছে আমার সাথে, রিপনের সাথে। সেটা তুমি জেনেও কি করে প্রশয় দিলে! একবার আমাকে বলে দেখতে। ও তো অসুস্থ মা। আমরা তিনজন ওর পরিবারের লোক। নিজের স্বামীর অকাল মৃত্যুর জন্য কিছুটা হলেও টুপুর দায়ী। সেটা কি তুমি ভুলে গেছ? অসুস্থতার কারণে হয়তো মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আমাকে আর রিপনকে সুখী দেখতে পারেনি। তাই অন্যায়টা করেছে। তুমি কি অন্যায় করনি? বলো মা? চুপ করে থেকো না। দিনের পর দিন তোমার এই মেয়ের বুক ভাঙা আর্তনাদ কি তোমার বুকে শেলের মত বেঁধেনি? তোমার একবারও কি মনে হয়নি আমরা তিনজন চেষ্টা করলে টুপুরকে ঠিক করতে পারতাম?"
জাহানারা বেগম কেঁদেই চলেছেন। এইভাবে আজকের দিনটির মুখোমুখি হতে হবে হয়তো ভাবতে পারেননি। হঠাৎ জাহানারা বেগমের মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো। পাশে রাখা মোবাইলে টুপুরের ছবি ভেসে উঠলো। তিশা প্রচন্ড ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিল। ফোন বেজেই চলেছে। একবার.... দুইবার... তিনবার। দূর দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজন ফিরে ফিরে মা মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তিশাই ফোনটা ধরলো। মনকে বোঝালো টুপুর অসুস্থ। অসুস্থ মানুষের সাথে আবার অভিমান কি। কন্ঠে এক রকম জোড় ঢেলে হ্যালো উচ্চারণ করলো তিশা। সাথে সাথে যেন ওপাশে বোমা ফাটা শুরু হলো,"বুবু তুই আমার মাকে কি করেছিস? তুই এমন করতে পারিস না আমার মায়ের সাথে। আমি তোকে শেষ করে দিব বুবু। তুই আমার সামনে আনন্দে ঘুরে বেড়াবি আর সেটা আমি তাকিয়ে দেখবো এটা তুই ভাবিস না কখনো। আমার মায়ের গায়ে একটা আঁচর যদি তুই দিস আমি তোকে ছাড়বো না বুবু"।
এত অসংলগ্ন কথার মাঝে তিশা কি বলবে! আর কথা বললেই অপর পাশের মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষটি শুনবে কেন! তিশা লাইন কেটে দিল। জাহানারা বেগম করুন চোখে তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে ফোনের সব কথা তিনি শুনেছেন। তিশা ফোন রেখে মাকে শুধু বললো," মা তোমার মেয়ে এখন তোমার বাসাতেই আছে। তবে বাসা থেকে বের হতে পারবে না। কারন পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে বাড়ীর চারপাশে। শুনলে তো কি বললো। ওর সাথে আমার দেখা না হওয়াই ভালো। আমি যত দ্রুত সম্ভব তোমাদের বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তোমরা চলে যাও মা। মেয়ের চিকিৎসা করাও। ভালো থাকো তোমরা। আমার আর রিপনের জীবনে আমি আর কোনো অশান্তি চাই না। জাহানারা বেগম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন বড় মেয়ের দিকে।
আজকে তিনি উপলব্ধি করলেন সন্তান বড় হলে নিজের মগজ বেশি কাজে লাগাতে নেই। সন্তানের উপর কিছুটা নির্ভরশীল হতে হয়। অনিশ্চিত সামনের দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে তার বুকটা কেমন হঠাৎ কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো।
......................................................
সালমা তালুকদার,বাংলাদেশ
২০শে এপ্রিল ২০২০