Type Here to Get Search Results !

'খার্চী পূজা' : জাতি-জনজাতির মেলবন্ধনের মহোৎসব -- ড. আশিস কুমার বৈদ্য,ত্রিপুরা

ত্রিপুরার কূলদেবী ত্রিপুরেশ্বরী,কূলদেবতা চতুর্দশ দেবমন্ডলী।ত্রিপুরার আধ্যাত্ম্য ভাবনায় বিশেষ করে এই দুটি ধর্মীয় পরিমন্ডলাশ্রিত দেবদেবীগণের পরিচিতি ভারত সহ বিশ্বব্যাপী পরিলক্ষিত হয়।চতুর্দশ দেবমন্ডলীর পূজা একত্রে বারোমাস হয়না।মাত্র তিনজন দেবদেবী (মহেশ্বর,বিষ্ণু ও লক্ষ্মীদেবী) বারোমাস পূজা পেলেও বাকী এগারো জনের মূর্তি একটি সিন্দুকে সযত্নে রক্ষিত হয়।চতুর্দশ দেবতার পূজার সময় অর্থাৎ আষাঢ় মাসের শুক্লাষ্টমীতে সকল দেব-দেবীগণ সমবেত ভাবে পূজা পান।চতুর্দশ দেবদেবীর পূজাকে সাধারণ্যে 'খার্চী পূজা' নামে অভিহিত করা হয়।

'খার্চী' কথাটির উদ্ভব খা + অর্চী যোগে।এখানে খা বা ক্ষা'র মাসে বোঝানো হয়েছে পৃথিবী,আর অর্চি বা অর্চীর অর্থ পূজা।এই অর্থে 'খার্চী পূজা'র অর্থ পৃথিবীর পূজা।কিন্তু চতুর্দশ দেবমন্ডলীতে আরো দেবদেবীগণ থাকায় এই অর্থ সহজে গ্রহণযোগ্য নয়।জনজাতি সমাজের ত্রিপুরী শাখার ভাষায় এর আর একটি শব্দের উল্লেখ পাই,সেটি হলো 'খাতিজাক', এর অর্থ অমূল্য ধন সযত্নে রক্ষা করা।খার্চীর অর্থবোধে শেষোক্ত বিষয়টি অধিকতর গ্রহণযোগ্য একারণে যে,দেবদেবীগণ শ্রদ্ধালু ভক্তদের কাছে অমূল্য সম্পদ।তাঁদের চন্তাইরাজার তত্ত্বাবধানে সংবৎসর অতিযত্নে রক্ষা করা হয়।




 
সে যাই হোক, 'খার্চী পূজা' বলতে আমরা চতুর্দশ দেবদেবীর পূজা বা অর্চনাই বুঝি।এবছর ত্রিপুরা রাজ্যে 'খার্চী পূজা' সূচনা হয় ২৮ জুন(রবিবার)।সাতদিন চলে এই পূজা।খয়েরপুরস্থিত পুরান হাবেলী বা পুরাতন আগরতলায় যথাযথ ভক্তি-শ্রদ্ধায় এই ঐতিহ্যবাহী পূজা শুরু হয়।এখানে মহারাজা কৃষ্ণমাণিক্য ১১৭০ সনে ত্রিপুরা রাজধানী নিরাপত্তাজনিত কারণে উদয়পুর তথা রাঙামাটি থেকে সরিয়ে আনেন।মহারাজা ধন্যমাণিক্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কূলদেবী ত্রিপুরেশ্বরীকে উদয়পুরে রেখে দিলেও মহারাজা কৃষ্ণমাণিক্য চতুর্দশ দেবতাদের নিয়ে এলেন পুরান হাবেলীতে।পরবর্তীকালে মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য (১৮৩০ - ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দ) চতুর্দশ দেবমন্ডলীকে পুরাতন হাবেলীতে রেখেই রাজধানী আরো পশ্চিমে নয়া হাবেলী তথা নতুন আগরতলায় নিয়ে এলেন।সেই সময় আগরগাছের ছায়া ঘেরা ছিলো বলেই এই নগরী 'আগরতলা' নামে অভিহিত করা হয়।
 'খার্চী পূজা' করেন চন্তাইরাজা।পূজার এই কয়দিন তিনি রাজন্য শাসনকালে রাজার সমতুল মর্যাদা পেতেন বলেই চতুর্দশ দেবতার প্রধান পূজক 'চন্তাইরাজা' নামে অভিহিত হন।স্বাধীনোত্তর কালেও এই মর্যাদা অক্ষুন্ন আছে।তাঁকে পূজার কাজে সাহায্য করার জন্য থাকেন অচাই,দেওড়াই,নারান,গালিম,বারিফাং,খাফাং,ভাঙ্গিয়া,ইয়াছুক প্রমুখ নামধেয় একদল সহকারী।
চন্তাইরাজা বা প্রধান পুরোহিত গোলাপী রঙের জরি বসানো পাঞ্জাবী,সাদা বা সোনালী পায়জামা পড়ে,কোমরে ওড়না জাতীয় কোমরবন্ধ পরিধান করেন।তাঁর মাথায় থাকে রাজার মতো পাগড়ি।সহকারীগণের পোশাক সাধারণ মানের(সাধারণত গেরুয়া ধুতি পড়তে দেখা যায়)।

 

ত্রিপুরার ইতিহাস,আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য প্রভৃতি জানার জন্য যে আকর গ্রন্থটি আছে তার নাম 'রাজমালা'।ইতিবৃত্তের পাশাপাশি কাহিনী-কিংবদন্তি, অলৌকিক ঘটনা,সাহিত্য মূলক উপাদানের সমন্বয়ে শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর চক্রবর্তী রাজ চন্তাইয়ের মুখ থেকে বিবরণ শুনে রাজাজ্ঞায় রচনা করেছেন এই অমূল্য গ্রন্থ।রাজমালা সূত্রে জানা যাচ্ছে ত্রিপুরার উত্তরাংশে বরাক উপত্যকায় কিরাতরাজ্যের অধিপতি ছিলেন মহারাজা ত্রিপুর।দ্রুহ্য বংশীয় এই রাজা মূলত জনজাতি সমাজের একটি বিশেষ শাখাভুক্ত দাম্ভিক রাজা।তাঁর রাজধানীর নাম ত্রিবেগ নগরী।তিনি নিজেকে ভগবান শিবের চাইতেও অধিক শক্তিধর মনে করতেন।দেব-দ্বিজে ভক্তি ছিলোনা।প্রজা পীড়নে সিদ্ধহস্ত এই রাজা শিবের হাতে নিহত হলে তাঁর মহিষী হিরাবতী শিবের কাছে পুত্রবর প্রার্থনা করেন।শিবের বরে তাঁর একটি সর্বসুলক্ষণ,ভক্তিপরায়ন পুত্রের জন্ম হয়।ত্রিলোচন শিবের বরে জন্ম বলেই তাঁর নাম রাখা হলো ত্রিলোচন।

একদিন মহারাণী হিরাবতী স্নান করে প্রাসাদে ফেরার পথে এক ভয়ঙ্কর মহিষের ভয়ে চৌদ্দজন দেবদেবী গাছের শাখায় বসে কাঁপছেন।মহারাণীকে দেখেই আত্মায় জল এলো।দেবতারা মিনতি জানিয়ে তাঁদের রক্ষা করতে বলেন।তাঁরা রক্ষার উপায়ও বলে দিলেন।মহারাণী যদি নিজের 'রিয়া' তথা বক্ষবন্ধনীটি মহিষের গায়ে ছুড়ে দেন তাহলে মহিষ বশীভূত হবে।দেবগণের কথায় মহারাণী তাই করলেন।এবার চৌদ্দজন দেবদেবী বায়না ধরলেন - তাঁরা প্রাসাদেই বিশ্রাম করবেন আর ঐ বশীভূত মহিষের বলি থেকে প্রাপ্ত রক্তে তৃপ্ত হবেন।মহারাণী তাদের মধ্যে মহেশ্বর আছেন জেনে এই আবেদনকে আদেশ রূপে গণ্য করে সকলকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে কূলদেবদেবীর মর্যাদায় পূজা করলেন।সেই থেকে ত্রিপুরী বংশীয় রাজগণ চতুর্দশ দেবতার পূজা করে আসছেন।তাছাড়া শিবাজ্ঞাও ছিলো।মহেশ্বর হিরাবতীদেবীর উদ্দেশ্যে আদেশ করলেন ----
" চতুর্দশ দেবপূজা করিবে সকলে
আষাঢ় মাসের শুক্লাষ্টমী হইলে ।। "
(রাজমালা,ত্রিপুরখন্ড)

এই চতুর্দশ দেবমন্ডলীতে কারা আছেন ?

সংস্কৃত ভাষায় লেখা রাজমালায় পাই -
" শঙ্করঞ্চ শিবানিঞ্চ মুরারী কমলাং তথা ।
ভারতীঞ্চ কুমারঞ্চ গণেশ মেধসং তথা ।।
ধরণীং জাহ্নবীং দেবীং পয়োধিং মদনং তথা ।
হুতাশঞ্চ নগেশঞ্চ দেবস্তাঃ শুভাবহাঃ ।। "

বাংলা ভাষায় রচিত রাজমালায় লিপিবদ্ধ আছে -
" হর উমা হরি মা বাণী কুমার গনেশ
ব্রহ্মা পৃথ্বী গঙ্গা অব্ধি অগ্নি কামেশ ।।
হিমালয় অশুকরি চতুর্দশ দেবা ।
অগ্রেতে পূঁজিব সূর্য পাছে চন্দ্র সেবা ।। "

ত্রিপুরীদের একটি প্রাচীন পুঁথিতে দেবদেবীদের নামগুলো এইরকম -
মতাইকতর ( সর্ব দেবতার অধিশ্বর),মতাই কতরমা (মহাদেবী),আখাত্রা (সমুদ্রদেব),খুলুমা (জুমের দেবী), বিকিৎরা (আকাশের দেবতা),তুইমা (জলদেবী),সংগ্রাং (পাহাড়ের দেবতা),কালিয়া (পিতৃপুরুষের দেবতা),গড়িয়া (যুদ্ধের দেবতা),নকছুমতাই (গৃহদেবী),বাইছুকমা (অরন্যদেব),সিরিজেমেদু (প্রসব বেদনা উপশমের দেবী),তুমনাইরক (মৃত্যুর দেবতা) ও লাম্প্রা (পথের দেবতা)।এরা সকলেই মতাইকতর ও মতাই কতরমার নিয়ন্ত্রাধীন থাকেন।
ত্রিপুরী বংশীয় রাজা ত্রিলোচনের দুই পুত্র।দৃকপতি ও সুদক্ষিণ।সুদক্ষিণ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার দ্বারা বিতাড়িত হলে পার্বত্য ত্রিপুরার উত্তরাংশে রাজধানী করে রাজত্ব শুরু করেন।প্রথম রাজধানীর নাম খলংমা, পরবর্তী রাজধানীর নাম ছাম্বুলনগর।তিনি চতুর্দশ দেবদেবীর মূর্তি ত্রিপুরায় নিয়ে এসে পূজার ধারা অব্যাহত রাখেন।তাঁরই বংশধর যুঝারফা দশম শতক নাগাদ রাঙামাটির (বর্তমান উদয়পুর) মগরাজাকে পরাজিত করে নতুন রাজধানী গড়ে চতুর্দশ দেবতার মন্দির গড়েন।সেটি এখনো মহাদেববাড়ি মন্দিরগুচ্ছের মধ্যে বিগ্রহশূন্য অবস্থায় দন্ডায়মান।১১৭০ সালে উপর্যুপরি বৈদেশিক হানায় তিতিবিরক্ত হয়ে মহারাজা কৃষ্ণমাণিক্য রাজধানী নিয়ে এলেন খয়েরপুর অঞ্চলে,যার নাম দিলেন পুরান হাবেলী বা পুরাতন আগরতলা।রাজপ্রাসাদ গড়ে তার সামনে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের আদলে ইন্দো-মঙ্গোলিয়ান শিল্পরীতিতে,বঙ্গীয় স্থাপত্য ধারায় চতুর্দশ দেবতার মন্দির গড়েন।খনন করা হয় পুণ্যিপুকুর। গৈরিক বর্ণের এই মন্দিরে চতুর্দশ দেবদেবীর মুন্ডমূর্তি গুলি পরম ভক্তি ভরে প্রতিষ্ঠা করেন।সঙ্গে রইলেন পূর্বাপর চতুর্দশ দেবতার প্রতীক রূপে চৌদ্দটি বাঁশের খন্ড।মূর্তিগুলির মুখমন্ডল প্রায় একই রকম বলে পৃথক ভাবে কোন ধ্যানমন্ত্র নেই।তবে সকলের উদ্দেশ্যে উচ্চার্য গুপ্তমন্ত্র আছে ত্রিপুরী ভাষায়।মূর্তিগুলো ভাস্কর্য শিল্পের দৃষ্টিকোণে খুবই আকর্ষণীয় ! টিকালো নাসিকা,আয়তচক্ষু গুপ্ত ও পালযুগীও শিল্প ধারার অনুসারী।মাথায় অর্ধচন্দ্রাকার দুটি শৃঙ্গ আদিবাসীদের আদি ধর্মের ভাবব্যঞ্জনায় সুশোভন।এগুলো শক্তিমত্তারও প্রতীক রূপে পরিগণ্য হয়।কারো কারো মতে এগুলো চন্দ্রবংশীয় ত্রিপুরাধীপতিগণের রাজপ্রতীক চন্দ্রধ্বজাস্থিত চন্দ্রকলার প্রতিরূপ। 
চতুর্দশ দেবতার পূজা তথা 'খার্চী পূজা' শৈব - শাক্ত - বৈষ্ণব - গাণপত্য ও আদিবাসীগণে সর্বপ্রাণবাদী আদি ধর্মধারার সংমিশ্রণ ঘটেছে।সমন্বয় ঘটেছে বঙ্গীয় ও জনজাতির আধ্যাত্ম্য ভাবনারও।খার্চী পূজায় আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়,মন্দিরের দক্ষিণ পাশের প্রকোষ্ঠে নারায়ণ শিলা নিয়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিতও পূজা করেন লক্ষ্মীনারায়ণের।চন্ডীপাঠও হয়।

চতুর্দশ দেবতার পূজা এবার অনাড়ম্বর ভাবেই শুরু হয়ে শেষ হতে চলেছে।করোনার আবহে বিপন্ন বিশ্বে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হচ্ছে বিধায় কোন ধর্মীয় তীর্থেই জনসমাবেশ নিষিদ্ধ।ভজনালয়গুলোরও দুয়ার খোলা হয় শর্তসাপেক্ষেঅতাই এবছর 'খার্চী পূজা'র সার্বিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত রইলো সবাই।


 'খার্চী পূজা'র যে আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য,মেলার আনন্দ,সামাজিক মেলবন্ধন,অর্থকরী ভাবনা,সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য,আলোর উদ্ভাসনা এবার সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে সাময়িক ভাবে সেরূপে হলোনা।চতুর্দশ দেবতা কৃপা করলে আগামী বছর (২০২১) জাতি-জনজাতি নির্বিশেষে দেশ-বিদেশের লক্ষ জনতার সমাবেশে পরিপ্লাবিত হবে চতুর্দশ দেবতার মন্দির,রাজপ্রাসাদ,পুণ্যিপুকুর সহ সমগ্র মন্দির অঙ্গন।।  

ড. আশিস কুমার বৈদ্য
লেখক ও গবেষক
ত্রিপুরা

ছবিঃ ফাইল চিত্র
৩রা জুলাই ২০২০

   

 
 

 
     

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.