অনেক ছোট বেলায় মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি যেতাম স্কুল ছুটি হলে। কখনো বাবা যেতে দিতেন কখনো না। মা খুব যত্ন করে, কাঁপা কাঁপা হাতে দাদুকে লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি লিখতেন এসে নিয়ে যাবার জন্য। তখন অনেক ছোট বলে মায়ের ফিলিং,আবেগ বা মানসিক অবস্থার কোন কিছুই বুঝতে পারতাম না।
আসলে মেয়েরা যখন নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে পা রাখে তখন মায়ের অবস্থান অনুভব করতে পারে -" মা " কি। মা দাদু দিদার, ছোট ভাই বোনদের কথা মনে করে এখনো মন খারাপ করে। সেই সময় মা যখন দাদুর সঙ্গে মামার বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হতো সেকি খুশী, আনন্দে চোখ গুলো চকচকে হয়ে যেতো। আমাদের নতুন জামা জুতো পড়িয়ে কত তাড়াতাড়ি বেড় হবে, আমরা ভাই বোন ও আনন্দে আত্মহারা মামার বাড়ি যাবো। অনেক দূরের রাস্তা, মা সবার জন্য হালকা একটু তেল লাগিয়ে রুটি ভেজে সঙ্গে আলুভাজা বা কখনো শুকনো মিষ্টি বা গুড় নিয়ে নিতেন। পথে দাদু কলা বিস্কিট কিনতেন।
ট্রেন থেকে নেমে বা বাস থেকে নেমে নৌকায় অনেক পথ পাড়ি দিয়ে মামা বাড়ি যেতে হতো। নৌকায় উঠে আমাদের সে কি আনন্দ।নৌকার বাইরের দিকে বসে জলের ঢেউ, বালি হাঁসের দল বেঁধে মাছ খাওয়া, উড়ে যাওয়া ইত্যাদি দেখতে দেখতে মাঝির ভাটিয়ালী, পল্লীগীতি গান শুনতে শুনতে পথ চলা। মা তন্ময় হয়ে ওদের গান শুনতেন।
দাদু ছিলেন স্কুলের হেডমাস্টার।তাই চেনা জানা কেউ নৌকায় থাকলে মাস্টারের নাতি নাতনি বলে আমরা ভাই বোন অনেক আদর ভালোবাসা পেতাম।মা শুধু সামনে তাকিয়ে থাকতেন আর খুশীতে ছটফট করতেন কখন বাড়িতে পৌঁছাতে পারবে। চারিদিকে এত জল,এত জল কোন কুল কিনারা দেখা যেতো না। আসলে শীতকালে এগুলো ধানের জমি।বর্ষায় জলে ডূবে যায়। গ্রামের লোকজন বলে হাওড়।বড় হাওড় পাড় হলেই মামা বাড়ি এসে যাবে।
মাঝে মাঝে শাপলা দেখে আমাদের কি আনন্দ। শাপলার নীচে যে ফল সেটাকে পানি ফল বা ত্রিকোণ বলে জল সিঙ্গারা বলে। খেতে খুব স্বাদ। শাপলা ফুলের বীজ গুলো শুকিয়ে খোসা ছাড়িয়ে খই ভাজা হয়ে থাকে, সেগুলোকে ভেটের খই বলতো। সরিষার দানার মতো দেখতে তাই খইগুলো খুব ছোট। এগুলো দিয়ে দিদা আবার মোয়া বানাতেন। আজকাল সেগুলো অবলুপ্ত। মামা বাড়ির সাথে কত যে মধুর স্মৃতি। কোথাও কোন জেলে কোমরে ডেকচি বেঁধে তিন কোনা পেলুন (জাল)নিয়ে নানা রকম ছোট মাছ ধরছে আর ডেকচিতে কাপড়ের নিচে রাখছে।
কোন ঘাটে নৌকা বেঁধে রেখে পাড়ে কেউ হয়তো রান্না করতে ব্যাস্ত। দাদু বলেন ওরা ঘুরে ঘুরে জিনিস বিক্রি করেন আর নৌকাতেই থাকেন। বর্ষাকালে বেদেনীর দল চুড়ি, মালা, প্রসাধনী সামগ্রী নিয়ে নৌকা করে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। নৌকাতেই তাদের মাসের পর মাস কেটে যায়। গ্রামের মানুষের দাঁতের পোকা বেড় করে, মাজার বিষ ঝাড়ে,এক ধরনের ডাক্তারের কাজ করে,ঝাড় ফোক, তাবিজ, মালিশের তেল বিক্রি এসব কাজ করে থাকে বেদেনীরা। মামার বাড়ি পাড়াতে এগুলো করতে দেখেছি, নিজের ছোট বাচ্চা অনেক সময় নৌকায় পুরুষের কাছে নয়তো পিঠে কাপড় বেঁধে। খুবই সাধারণ সহজ সরল জীবন যাপন করে তারা।
কালো জল,সাদা জল পেড়িয়ে বিকেল বেলায় যখন পশ্চিম আকাশে সূর্যীমামা ডুবু ডুবু করছে তখন গিয়ে নৌকা মামা বাড়ির ঘাটে লেগেছে। গ্রামের অনেক মানুষ এসেছে মাকে দেখবে বলে। মাস্টারের ঝি (মেয়ে) অনেক দিন পর শহর থেকে নায়র করতে এসেছে , তাই তাদের আদরের মেয়েকে ওরা দেখতে এসেছে। আমরা আসবো বলে মামী,মাসী কত কিছু বানিয়েছে- ঘরের দুধ দিয়ে ক্ষীর পুলি, সন্দেহ, বাদাম চিড়ের লাড্ডু। সবাই মাকে ঘিরে বসে কত কিছু বলছে, জিজ্ঞেস করছে। কেউ বলছে শুকিয়ে গেছে, কেউ বলছে কালো হয়ে গেছে আরও কতো কি।মা বড়দের প্রণাম করছে, আমরাও বড়দের প্রণাম করে হাত মুখ ধুতে চলে গেলাম। দাদু গরুদের আদর করতে চলে গেলেন। সবাই মুড়ি মুড়কি মিষ্টি খেয়ে চলে গেল। মা সবার সঙ্গে বসে নানা গল্পে মেতে গেলেন। আমার ইচ্ছে থাকতো কতক্ষণে মাসীর পুতুল গুলো দেখবো, শাড়ি পড়াবো। কবে মাসী পুতুল বিয়ে দেবে ,কি মজা হবে!! কোথাও যেতে হলে ঘাটে নৌকা বাঁধা থাকতো, সবাই মিলে নৌকা চড়ে অন্য কোন আত্মীয়ের বাড়ি বা বাজারে যেতে হতো। মামার সাথে নৌকার দাঁড় ধরে বসে থাকতাম, চেষ্টা করতাম দাঁড় বাইতে। মেজ মাসী আমাদের সাঁতার কাটতে শিখিয়েছেন ।মামা বাড়ি গেলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা দেখা যেতো।কত সুন্দর করে নৌকা সাজিয়ে একসাথে অনেক লোক নৌকায় দাঁড় টেনে,বৈঠা চালিয়ে চলে যেতো গান গাইতে গাইতে।সে এক মজার ব্যাপার।
ছোট বেলায় মামা বাড়ি যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় আমাদের যাওয়া হতো না তাই আমার মনে মামা বাড়ির স্মৃতি খুবই প্রখর ও মধুর। কিছু দিন থাকার পর যখন ফিরে আসার সময় হয়ে আসে মায়ের খুব মন খারাপ। দিদা খুব যত্ন করে মাকে, আমাদেরকে অনেক কিছু খাওয়াতেন। তখন মনে হতো মা যেন আমাদের মতো ছোট। চলে আসার সময় কত কিছু যে দিদা মাসী পোটলা বেঁধে বেঁধে ব্যাগে ভরে দিতেন। ঘরের তৈরি ঘি, তিল,বাদাম, সরিষা, নাড়ু সন্দেশ, মোয়া তো আছেই। দাদু নতুন জামা,রঙ পেন্সিল, খাতা এগুলো আমাদের দিতেন। দাদু আবার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন, সেখান থেকে সাবু দানার মতো মিষ্টি ঔষধ গুলো নিয়ে নিতাম।
আমাদের খুব আনন্দ বাড়িতে চলে আসবো বলে কিন্তু মা মোটেও খুশি নন। আগের দিন থেকেই কান্নাকাটি। তখন বুঝতে পারতাম না মায়ের মনের অবস্থা, শুধু বলতাম মা কাঁদছ কেন? আবার নৌকা করে ফিরে আসার সময় পুরো গ্রামের মানুষ তাদের আদরের মেয়েকে বিদায় জানাতে ঘাটে জড়ো হয়েছে। কেউ বলছে আবার কবে আসবে, কেউ বলছে খুব মনে পড়বে,গিয়েই চিঠি লিখতে ইত্যাদি। বড় মামা চোখ মুছতে মুছতে হাত নাড়ছে, নদীর পাড়ে পাড়ে যতটা আসা সম্ভব হেঁটে চলেছে, মা রুমাল চাপা দিয়ে কেঁদে চলেছে। এই মেঘনার জলে আমার মায়ের চোখের জল মিশে আছে।
আজ প্রায় তিরিশ বছর পর যখন আমি আমার অসুস্থ মামাকে দেখার জন্য আবার মামা বাড়ি যাচ্ছি ছোট বেলার স্মৃতি গুলো যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। দাদু দিদা কেউ আর আজ পৃথিবীতে নেই।মাসীদের বিয়ে হয়ে গেছে।বড় মামী ও নেই, মামা শয্যাশায়ি। তাই মামাকে শেষ দেখার ইচ্ছা। পাসপোর্টের ভিসা লাগানো মাত্রই বাংলাদেশ মামার বাড়ি।
নৌকার বাইরে বসে জলের ছিটা এসে চোখ মুখ শান্ত করে দিচ্ছে। এক দল কচুরিপানা গাছের ফাঁকে ডাহুক তার বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বকের ঝাঁক উড়ে উড়ে পাড়ের কিনারে মাছ ধরার কৌশলে মত্ত। আজ মা আমার সঙ্গে নেই, আমি একা যাচ্ছি কারণ মায়ের পাসপোর্ট হয়নি। হঠাৎ করে আমার শচীন বর্মনের কাল জয়ী বিখ্যাত গানটি মনে পড়ল- "কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া, আমার ভাই ধনরে কইও নায়র নিতো আইয়া " । গ্রাম্য পল্লী বধুর বাপের বাড়ি যাবার মনের যে হাহাকার তা চুড়ান্ত পর্যায়ে প্রকাশ পেয়েছে এই গানটিতে।আজ বুঝতে পারছি মায়ের নায়র যাবার আকুলতা। আমার চোখ ভিজে আসছে সেই পল্লীবধু ও আমার গ্রাম্য সহজ সরল মায়ের কিশোরী অবস্থার কথা ভেবে। মা যে লুকিয়ে চিঠি লিখতেন দাদুকে নায়র নিয়ে যাবার জন্য। তাই এখন মনে হচ্ছে মেঘনার বাড়ন্ত জলে শত সহস্র পল্লী বধুর বাপের বাড়ি নায়র যাবার, ভাইয়ের কথা মনে করে চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে না জানি কত। নায়র শেষে আমার মায়ের মতো কত শত গ্রাম্য কিশোরীর চোখের জল মিশে আছে এই জলে। তাই এই মেঘনা আজ জল থৈ থৈ করছে......।
শেলী পাল
আগরতলা
আরশিকথা অতিথি কলাম
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
৩রা অক্টোবর ২০২৫

