প্রতিদিনকার মতই শঙ্কর অফিসের যাবতীয় বিরক্তি নিয়ে বাড়ি ফিরল । কলিং বেল বাজতেই অনিতা এসে দরজা খুলে দিল । অনিতা শঙ্করের স্ত্রী । অফিস ফেরত স্বামীর জন্য খাবার বানাতে ব্যস্ত ছিল কিচেনে । দৈনিক অশান্তির ভয়ে এখন আর তেমন ঘাবড়ায় না অনিতা । নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়ে গেছে শঙ্করের এই অশান্তি । দরজা খুলেই অনিতার মৃদু হাসিমুখ আরও যেন জ্বালা ধরিয়ে দেয় শঙ্করের মনে । হাঁড়িচাচা মুখ নিয়ে কাঁধের ব্যাগ রেখে কোন কথা না বলে বাথরুমে চলে গেলো । আগাম ঝামেলার ইঙ্গিত বুঝে অনিতা চা জলখাবের ব্যবস্থা করতে কিচেনে ছুটে গেলো । ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো শঙ্কর । সামনে টেবিলে রাখা একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে তাতেই মনোনিবেশ করে নিজেকে একা করলো সে । অনিতা টেবিলে চা জলখাবার রেখে চুপচাপ কিচেনে চলে গেলো । একবার আড়চোখে অনিতার চলে যাওয়া দেখে টেবিলে রাখা জলখাবারের দিকে তাকালো শঙ্কর । তারপর চায়ের কাপ তুলে নিল । চায়ে চুমুক দিয়েই চেঁচিয়ে উঠে বলল “ এটা কি চা হয়েছে না গরম জল ?... বাড়িতে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে দেখছি !!! “ ... অনিতা ছুটে এসে বলল “ কেন ...কি হয়েছে ? “
অনিতাকে সামনে দেখে ঝাঁঝিয়ে উঠে শঙ্কর ভাববাচ্যে বলল “ কি হয়েছে সেটা নিজে পরখ করলেই তো হয় “ ... অনিতা কিচেনে গিয়ে অবশিষ্ট রাখা চা চেখে কিচেন থেকেই বলল “ কেন ... ঠিকই তো আছে ... আসলে অশান্তি করার জন্য একটা ছুতো লাগে তোমার “ ... ব্যস আর যায় কোথায় ... তেলেবেগুনে জ্বলে শঙ্কর বলল “ তার মানে !!! কি বলতে চাইছ ... সারাদিন অফিসের ঝামেলা সেরে বাড়িতেও কি একটু শান্তি পাবনা ? ... ঠিকমতো এক কাপ চাও বানাতে পারনা ... বাবামা কিছুই শেখায়নি নাকি ? “ ...
বিরক্তির সুরে অনিতা সামনে এসে বলল “ তোমায় কতদিন বলেছি যে বাবা মা তুলে কিছু বলবেনা ? ... চা খেতে খারাপ লাগলে আবার বানিয়ে দিচ্ছি “ ... শঙ্কর আরও চেঁচিয়ে বলল “ হু ... বলবেনা আবার ... কিছুই পেলাম না তার ওপর আবার এই মাকাল ফলকে গলায় ঝুলিয়ে দিলো “ ... এইবার অনিতা ঝাঁঝিয়ে বলে উঠলো “ কি বললে ? ... কিছু দেয়নি বিয়েতে !! ...সবই তো দিল ... বাইক , গয়নাগাটি , সোফা খাট আলমারি ! ... এরপরও আরও চাই !!! “ ...
শঙ্কর তাচ্ছিল্য ভরা হাসিতে বলে উঠলো “ এইগুলি তো সবাই দেয় ... পাশের বাড়ির অনন্তকে শ্বশুরবাড়ি থেকে কি দিয়েছে একবার দেখে আসতে বল তোমার বাবা মাকে “ ... তোমাকে বিয়ে করে তো জীবনের আনন্দটাই মাটি হয়ে গেলো ... “
অনিতা এবার কান্না ভেজা গলায় বলে উঠলো “ জীবনের আনন্দটা কি শুধু শ্বশুরবাড়ি থেকে জিনিষ পাওয়াতেই !!! ... এর বাইরে কি আর কিছুই দেখনি ... একটা মেয়েকে তার বাবামা কত আদরযত্নে সমস্ত ঝড়ঝাপটা থেকে বাঁচিয়ে বড় করে ... তারপর তার সেই আদরের ধনকে বুকচাপা কষ্টে অন্যের ঘরে পাঠায় সেই ঘরের সুখসমৃদ্ধি বৃদ্ধি করতে ... আর কত সহজে তোমাদের মত পুরুষেরা তাকে আদান প্রদানের মাধ্যম ভাবো ... এতটুকুও কি মায়া মমতা নেই তোমাদের ? ... “ ... এই বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে অনিতা । শঙ্কর অনিতার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে । অনিতা কাঁদতে কাঁদতে ঘরের এককোণে দেয়ালে টাঙ্গানো তার বাবামায়ের ছবির সামনে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে “ কেন আমাদের এত আদর ভালবাসা দিয়ে বড় কর তোমরা ... এই কঠিন রুড়তার কথায় , তাচ্ছিল্যে কেন বড় করনা ...মেয়েদের এই পাথরচাঁপা কান্নায় পৃথিবী আরও কতদিন ভিজবে ?? ...”
আরও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অনিতা ...। শঙ্কর মাথা নিচু করে কিছু ভাবতে ভাবতে সোফায় বসে পড়লো ... স্থির হয়ে সামনে তাকিয়ে কিছু ভাবে সে ... ( হঠাৎ শঙ্করে্র কানে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে ) ... “ কি ভাবছ শঙ্কর ... কোথায়ও কি কষ্ট হচ্ছে ? ... ( শঙ্কর চমকে উঠে বলে ) “ ন ... ন ... না তো !! ( আবার ভেসে আসে ) “ তাহলে কি পুরুষত্বে আঘাত !!! ( শঙ্কর অসহায়ের মত ফ্যাল ফ্যাল করে সামনে তাকিয়ে থাকে ) ( স্বর বলছে ) “ ক্ষণিকের আনন্দে কেন করছ এই পাপ ... একবারও কি ভাবনায় আসেনা এই কথা ... কোন শিক্ষায় বড় হলে বলতো ???... তোমাদের শিক্ষা কি এইভাবেই মাতৃজাতিকে অসম্মান করে মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচতে শেখায় !!!!” ... ( এইবার শঙ্করের চোখ দিয়ে অজান্তে জল গড়িয়ে পড়ে ... সে আশ্চর্য হয়ে সেই জল কে হাতে নিয়ে দেখে ) ( কণ্ঠস্বর বলে উঠলো ) “ এই দেখ শঙ্কর ... যা শিখে বড় হয়েছ তাই তোমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ... একে ঝরতে দিওনা শঙ্কর ... (এবার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো সেই স্বর ) ... ঝরতে দিওনা শঙ্কর ... দিওনা শঙ্কর ... দিওনা শঙ্কর “ ... (শঙ্কর কানে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠে বলে) “ না আ আ আ আ “ ...
তারপর স্থির হয়ে ধীরে ধীরে সামনে তাকায় ... সেইভাবেই অনিতার দিকে ঘুরে তাকায় ... অনিতা বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে থাকে ... শঙ্করের চোখে এক অন্য আনন্দের ভাষা ... অনিতার অবাক করা অনুভবে এক অসাধারণ হাসি ...........।। (এই হাসির স্থায়িত্বেই হয়তো একদিন লেখা হবে সভ্যতা বিকাশের অমৃত কথা )
” নারীমর্যাদা দানের শিক্ষার আনন্দে জীবন উপভোগ করুন ...
পণপ্রথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে কাপুরুষতা থেকে নিজেকে মুক্ত করুন “ ।।
লেখকঃ সৃজন বাউল,ত্রিপুরা
ছবিঋণঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
ছবিঋণঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত