Type Here to Get Search Results !

নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা"....বাংলাদেশ থেকে মোহাম্মদ নজাবত আলীর প্রতিবেদন

আমরা যারা প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছি তখন থেকেই তিন শব্দবিশিষ্ট একটি বাক্যের সঙ্গে কম-বেশি পরিচিতি অর্জন করেছি। সেটা হলো 'শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড'। অর্থা শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। শিক্ষা-সংস্কৃতি একটি জাতির মধ্যে জাগরণ ঘটাতে পারে। এ জাগরণে জাতি উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়। তাই উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়সেসব রাষ্ট্রে উন্নয়নের ভিত্তি সুদৃঢ় যা শিক্ষা দ্বারা সুসংগঠিত হয়েছে। তাই সমাজদেশজাতি গঠন ও উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বলেছেনবিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারীঅর্ধেক তার নর। নজরুল ইসলামের এ মহান বাণীটির মর্মকথা হলোনারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি দেশের উন্নয়ন ঘটে। তাই শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। নারী-পুরুষ শিক্ষা ক্ষেত্রে সমঅধিকার ভোগ করবে এটা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষায় বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু নারী শিক্ষা নয় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। নারী এখন পিছিয়ে নেই। তাদের যাত্রা সামনের দিকে। নারী পুরুষের মতো সমঅধিকার নিশ্চিত করা না গেলে কোনো সমাজ এগোতে পারে না। শিক্ষা-দীক্ষাচাকরিব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে আজ নারী এগিয়ে যাচ্ছে
নারী আজ সরকারিবেসরকারি বিভিন্ন অফিস-আদালতে কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষেই এসব কাজের সুযোগ করে দিয়েছে শিক্ষা। আবার শিক্ষা একটি জাতির মৌলিক অধিকার। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তারা এ অধিকার ভোগ করছে। ফলে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও নারী আজ শিক্ষায় অনেক এগিয়ে। আবার শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হয়ে আজ নারী রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদাশীল পদে অধিষ্ঠিত। আমাদের সংবিধান শুধু শিক্ষায় নয়নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে ২৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেরাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে। তাই কোনো অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগাতে গেলে নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। এ কথা বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বুঝতে পেরেছিলেন বলেই উপরোক্ত মন্তব্য করেছিলেন। তাই নারীরা উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তারা স্বীয় কর্মদক্ষতার গুণে আসীন
শুধু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাড়াও তৃণমূল পর্যায় অর্থা স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থায় নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংরক্ষিত আসনে নারী নির্বাচিত হয়ে এখন স্থানীয় পর্যায়ে তারা উন্নয়নের অংশীদার। নারী আজ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত তা ছাড়া প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীতে নারীর উপস্থিতি লক্ষণীয়। উপরন্তু নারী আজ জজ-ব্যারিস্টার-বিচারকসহ রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে অধিষ্ঠিত থেকে সমাজ, রাষ্ট্র, জাতির নানাভাবে সেবা করে যাচ্ছে; যার স্বপ্ন দেখেছিলেন নারী শিক্ষা, নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

কারণ একসময় নারীসমাজের এ অবস্থা ছিল না। বেগম রোকেয়া যে সমাজে বেড়ে উঠেছেন সে সমাজ অন্ধকার ছিল। তাই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে অবদান রাখবে।                     উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে তারা পুরুষের মতো জজ,ব্যারিস্টার,ম্যাজিস্ট্রেট,ডাক্তার,   বিচারক, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক এমনকি দেশ পরিচালনাও করবেন। সাংবাদিকতা পেশায়ও নারী সাহসী ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং প্রকৃত শিক্ষা, সাহস, সততা, সৃজনশীলতা যে কোনো সাহসী কার্যক্রমের সুনাম বয়ে আনতে পারে। 
 নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন বিষয়টি এখন বহুল আলোচিত। বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক। আবার দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে নিরক্ষর, অবহেলিত, অদক্ষ রেখে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই সংবিধান নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে। নারীর শিক্ষা অর্জন ও উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সরকার শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেফলে নারী শিক্ষায় আজ নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। আমাদের সংবিধান মোতাবেক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের শিক্ষা, সমঅধিকারসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। সরকার নারী-পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, তাদের সব ধরনের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা, সামাজিক দিক থেকে নারীসমাজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেও নারী উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ করেছে। এ নীতিমালার মূল সূর হচ্ছে নারী জাতিকে শিক্ষায় সুশিক্ষিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ। তাই শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে নারীর সচেতনতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। শিক্ষার আলো থেকে তাদের বঞ্চিত করে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়আবার শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন কখনো সম্ভব নয়। তাই আমাদের সংবিধান মোতাবেক শিক্ষা গ্রহণ করে পুরুষের পাশাপাশি নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে

বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিকদার্শনিকনারীবাদী লেখিকা সিমোন দ্য বোভোয়ার নারী সম্পর্কিত একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় উক্তি করেন, 'কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় নাবরং হয়ে ওঠে নারী'। প্রাকৃতিক নিয়মে একটি শিশু জন্মের পর আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে তার নিজস্ব পরিবারে। তাই পরিবারকে বলা হয় শাশ্বত বিদ্যালয়। সে শিশুটি যখন উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষার মাধ্যমে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করে তখন হয়ে ওঠে একজন পরিপূর্ণ মানুষ। তেমনি একজন কন্যাশিশুও শিক্ষার মাধ্যমে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেকে গড়ে তোলে তখন সে হয়ে ওঠে একজন পরিপূর্ণ নারী। মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বলেছেন, 'কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুকবেগম রোকেয়ার সে কথার প্রতিফলন আজ আমরা সমাজে দেখতে পাচ্ছি। শহর থেকে গ্রামে সর্বস্তরের নারীর ভেতর জাগরণের জোয়ার শুরু হয়েছে। নারী আজ এগিয়ে যাচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের ভর্তির হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ১৯৯৪ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু হয়। সে থেকে ছাত্রীরা অতি উসাহে স্কুলগামী হতে থাকেযা এখনো অব্যাহত রয়েছে

 বর্তমান যুগে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র যেখানে আমাদের হাজারো সমস্যা, নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা ও আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। যুগের চাহিদা অনুযায়ী নারী শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নারীর আত্মমর্যাদা, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি যেমন বেড়েছে তেমনি নারী আজ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত

সমাজবিজ্ঞানীদের মতেকয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিকরাজনৈতিকসামরিকসহ সব ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়নে মাইলফলক সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে গত এক দশকে নারীর ক্ষমতায়নে অর্থবহ অগ্রগতি হয়েছে। নারী শিক্ষায় দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণের সূচকে এ অঞ্চলের প্রথম সারির ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। সরকারিবেসরকারি চাকরির পাশাপাশি কৃষিশিল্পসহ বিভিন্ন সেবার খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে

সুতরাং প্রকৃত শিক্ষার আলো প্রবেশ করাতে হবে নারীর সুকোমল অন্তর মানসপটেযাতে একজন নারী সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। তবে এ বেড়ে ওঠার পথে নারী নির্যাতনসহ সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। কারণ নারী সমাজেরই অংশ
নারীকে বাদ দিয়ে কোনো সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ যেমন এগিয়ে যাবে দেশের উন্নয়নে নারীর অবদান বাড়বে, তেমনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও নারীর ক্ষমতায়ন ঘটবে। কাজেই নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

মোহাম্মদ নজাবত আলী,শিক্ষক ও কলাম লেখক
বাংলাদেশ

ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট

৩০শে নভেম্বর ২০১৮ইং