আজ ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর । বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ বিপ্লবী, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম প্রধান অগ্রদূত পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিবস । আজ এই মহা মানবের জন্মের দুশো বছর পূর্তি হলো । অর্থাৎ আজ তাঁর দুশো তম জন্মবার্ষিকী এবং ২০১ তম জন্মদিন । আজ থেকে ঠিক দুশো বছর আগে এই উপমহাদেশের পবিত্র মাটিতে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন । এই পবিত্র দিনে আমি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী আন্তর্জাতিক স্মারকগ্রন্থ কমিটির পক্ষ থেকে এবং আরশিকথা পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর শ্রীচরণে শতকোটি প্রণাম নিবেদন করছি ।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন এদেশের মাটিতে জন্মেছিলেন তখন এদেশে ইংরেজদের আগমন ঘটে গেছে । ভারতীয় সমাজে তখন শিক্ষার বড়োই অভাব । চারদিকে অশিক্ষা ,কুশিক্ষা , কুসংস্কার । নারী শিক্ষা এদেশে তখনো কল্পনার বাইরে । হিন্দু সমাজে তখন ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য । ব্রাম্মন সন্তান ছাড়া আর কারো শিক্ষার তেমন অধিকার নেই ।
এইরকমই একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল আমাদের এই বঙ্গদেশে । পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে । রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর মতো অকুতোভয়, নির্ভিক , সাহসী, সমাজ বিপ্লবী পৃথিবীর বুকে খুব কমই এসেছে । তাঁর আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ যেন কয়েক শতাব্দী এগিয়ে গেছে ।
শিক্ষার সম্প্রসারণ, সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষা , গোড়া ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী চিন্তা চেতনার অবতারণা, বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষার সূচনা, ভারতে পুরনো শিক্ষাকে বাতিল করে পুরোপুরি পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য সংগ্রাম করা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিশেষ করে বাংলা গদ্য সাহিত্যের জগতে একটা পরিশীলিত শৃঙ্খলা বা লেখ্যরূপ দান করা, মেয়েদের শিক্ষার জন্য নানারকম আক্রমণকে উপেক্ষা করে প্রায় অনেকগুলো বিদ্যালয় স্থাপন করা অল্পবয়সী হাজার হাজার বিধবার পুনর্বিবাহের আইনী অনুমোদন এবং সর্বোপরি শিশুদের শিক্ষার জন্য তিন পর্বে বর্ণপরিচয় প্রণয়ন করা সহ প্রায় পন্চাশটি অতি প্রয়োজনীয় শিক্ষামূলক গ্রন্থ প্রণয়ন করে ভারতীয় জনসমাজকে বহুদূর এগিয়ে দিয়েগেছেন ।
এটাও সকলের জানা আছে যে, ত্রিপুরার রাজ প্রতিনিধি কর্ণেল মহিম ঠাকুর যখন কোলকাতায় পড়াশোনা করছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, তখনই এশিয়াটিক সোসাইটির একটি আলোচনাসভায় কর্ণেল মহিম ঠাকুরের গলায় একটি সোনার মেডেলে বাংলা ভাষায় কিছু লেখা দেখে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খুশিতে এবং আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন আমার ত্রিপুরার রাজভাষা বাংলা । এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই বঙ্গদেশে একমাত্র ত্রিপুরাতেই প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর ধরে বাংলা ভাষা রাজভাষা বা সরকারি ভাষা হিসেবে সমাদৃত ।ইংরেজ আমলে যখন সারা দেশ ব্যাপী ইংরেজি সরকারী ভাষা হিসেবে চালু হয়ে গেল তখনো ত্রিপুরার রাজভাষা ছিল বাংলা । পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উক্তি এই ইতিহাসকে মান্যতা দিয়েছিল ।
এই মহামণীষীর দ্বিশতবর্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং তাঁর যে বিশ্বব্যাপী অসীমান্তিক ও কালোত্তীর্ণ অবদান, সেই অবদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আরশিকথা
ড. দেবব্রত দেবরায়,ত্রিপুরা
২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২০