ফোন রাখতেই স্মৃতিগুলো সব হুড়মুড়িয়ে ভেসে উঠল বর্ণালীর চোখে। রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে আগরতলার বনেদী স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছিল বর্ণালী আর তার যমজ বোন মিতালী। টাউন বাস করেই স্কুলে যাওয়া আসা করত দুই বোন।একই বাস স্টপ থেকে স্কুলে যেত বিদিশা আর ওর দিদি। টিফিন ভাগ করে খাওয়া থেকে শুরু করে একসাথে কাবাডি খেলা সবকিছুতেই বর্ণালী আর বিদিশা থাকত একসাথে। বর্ণালীর টিফিনে রোজই থাকত রুটি-তরকারী।আর বিদিশার টিফিনে থাকত কোনোদিন আপেল,কোনোদিন সন্দেশ,আবার কোনোদিন পুডিং বা কেক।আর হবে নাই বা কেন,বর্ণালীর বাবা ছিলেন সামান্য স্কুল মাষ্টার আর অন্যদিকে বিদিশার বাবা ছিলেন কলেজের প্রিন্সিপাল। এতে অবশ্য ওদের বন্ধুত্বে কখনও কোনো ছেদ পড়েনি। এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল ওদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো। একদিন স্কুল যাওয়ার পথে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে দুই বন্ধু। হঠাৎ হেসে উঠল বিদিশা হি হি করে। বর্ণালী তো অবাক। পাগল হয়ে গেল নাকি মেয়েটা। জিজ্ঞেস করল --- "কি রে একা একা হাসছিস যে? " হাসতে হাসতে বিদিশা উত্তর দিল -- " জানিস কাল রাতে না একটা দারুন কান্ড হয়েছে। সবাই তো ডাইনিং টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছি, আর আমার থালার পাশে একটা ডিটেকটিভ বই। আমি পড়ছি আর খাচ্ছি। পড়তে পড়তে থালায় হাত না দিয়ে ভাতের জন্য ডাইনিং টেবিলে হাতানো শুরু করলাম। মা তো এই দৃশ্য দেখে দিল একটা বকা"-- বলেই আবার হাসতে শুরু করল। বর্ণালী সেই প্রথম শুনল ডাইনিং টেবিলের কথা। কায়দা করে বিদিশার কাছ থেকে জেনে নিল কিরকম হয় ডাইনিং টেবিল,কি থাকে এতে,কি করতে হয় সবকিছু। শুনতে শুনতে বর্ণালীর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ওর নিজের বাড়ির রান্নাঘরের দৃশ্য। মাটির ঘরে কুপি জ্বালিয়ে পিড়ি পেতে খেতে বসেছে ওরা দুই বোন আর বাবা।মা ভাত বেড়ে দিচ্ছেন।
স্কুল থেকে ফিরেই বর্ণালীর মাথায় ঘুরতে লাগল একটাই চিন্তা।কিভাবে পাতা যায় নিজেদের রান্নাঘরে একটা ডাইনিং টেবিল? দুই বোন মিলে শলাপরামর্শ করে বাড়ির বাতিল জিনিসপত্রের ঘর থেকে সংগ্রহ করল একটা টেবিল। যার একটা পা ভাঙা, আর একটা পা উই পোকায় খেয়েছে। কিন্তু ওদের দুই বোনের উৎসাহের কাছে হার মানল পা ভাঙা টেবিল। এটাকেই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রান্নাঘরে নিয়ে এল দুই বোন। ভাঙা পা দুটিকে দাঁড় করানো হল ইট দিয়ে। এবার চেয়ার। কোথায় পাওয়া যাবে একটা চেয়ার? বাড়িতে একটাই চেয়ার আর সেটা ব্যবহার করেন ওদের বাবা। দুই বোন মিলে ঠিক করল চেয়ার লাগবে না, ওরা দাঁড়িয়েই খাবে।তবু তো ডাইনিং টেবিলে খাওয়া হবে। ভাঙা টেবিলে দুই বোনের দাঁড়িয়ে খাওয়া দেখে মা তো বকা শুরু করলেন। বাবা কিন্তু বললেন --" আহা বকছ কেন? ডাইনিং টেবিলে খাওয়া বিজ্ঞান সম্মত। এতে মেরুদণ্ড সোজা থাকে।আর হজমও ভালো হয়। দাঁড়া তোদের যখন এত শখ আগামী মাসে চেষ্টা করব নিতাই এর দোকান থেকে একটা ডাইনিং টেবিল আনতে। টাকাটা না হয় মাসে মাসে শোধ করে দেব। " শুনে তো আনন্দে নেচে উঠল দুই বোন।
বেল বাজার শব্দে বর্তমানে ফিরে এল বর্ণালী। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল বাবার কথা মনে করে। বাবা মারা গেছেন আজ পাঁচ বছর হল। শুধুমাত্র মেয়েদের মুখে হাসি ফোটাতেই ধার করে সেদিন তিনি কিনেছিলেন একটি ছোট্ট ডাইনিং টেবিল আর দুটি চেয়ার। সে টেবিল নিয়ে দুই বোনের সে কি উন্মাদনা। আজ বর্ণালীর নিজ বাড়িতে মডিউলার কিচেন, এইট সিটারের সবচেয়ে দামী ডাইনিং টেবিল। অথচ সবাই একসাথে বসে ডাইনিং টেবিলে খাওয়া হয় কোথায়? ছেলে খায় টিভি দেখতে দেখতে বসার ঘরে।আর পতিদেব? তিনি তো খেতে বসেও অফিসের কাজে ব্যাস্ত থাকেন। বর্ণালীর কিন্তু খুব ইচ্ছে করে সবাই মিলে ডাইনিং টেবিলে বসে সারাদিনের গল্পগুলো করতে খেতে । কিন্তু তা আর হয় কোথায়? এত বড়ো ডাইনিং টেবিলে একা একা খেতে বসতেই ইচ্ছে করেনা বর্ণালীর। তাই রান্নাঘরেই সেরে নেয় ওর নৈশাহার। দামী কাচের মসৃণ টেবিলের মসৃণতা তাই একটুও নষ্ট হয়না দিনের পর দিন।
সুস্মিতা ধর,ত্রিপুরা
ছবিঃসৌজন্যে ইন্টারনেট
৪ঠা জুলাই ২০২০