Type Here to Get Search Results !

ছোট গল্প-- " নীলিমায় নীল" ............ সসীম আচার্য , আগরতলা

নীলিমা - গতকাল এলে না কেন- সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফিরে গেছি।

নীলাদ্রি--  নীলিমা,  আর ভাল লাগে না। সারাদিন ঘরে একা থাকতে থাকতে মনটা বিষিয়ে ওঠে। দীপা গত হওয়ার পর জীবনটা যেন অর্থহীন হয়ে পরেছে। সারা সপ্তাহে শুধু রবিবারেই ছেলে দীপক কিছু সময় আমার খোঁজ খবর নিয়ে যায়। বৌমা নাতিটাকে সারাক্ষন আগলে রাখে । আমার কাছে আসতে দিতে চায় না। সবই বুঝি। আর বুঝি বলেই বড় কষ্ট বড় যন্ত্রণা । নীলিমা, জীবনের এই শেষ দিন গুলো একটা চরম শাস্তি। এই অশান্তির জীবন আর টেনে নিয়ে যেতে পারছি না। 

         কথাগুলি এক নাগারে বলে নীলাদ্রি রায় যেন একটু হাঁপিয়ে ওঠেন। মাথা নিচু করে বসে থাকেন।

       নীলিমা নীলাদ্রির হাতের উপর হাত রেখে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। তারপর ধীরে ধীরে বলে--  গতকাল তুমি আসনি কেন। এখানে এলে তো কিছুক্ষণ মনটা হাল্কা থাকে। আমি তোমার ভাবনায় রাতে ঘুমাতেও পারিনি।এই বয়সে আমি কি এত টেনশন নিতে পারি বলো?

নীলিমার কথায় নীলাদ্রি ছোট্ট হাসি দিয়ে বলে--- আমি জানি তুমি টেনশন করবে। আমারও বার বার তোমার চিন্তিত মুখ মনে পরছিল।

নীলিমা - আচ্ছা নাও সে সব কথা এখন থাক। তোমার জন্য কয়েকটা নারকেলের সন্দেশ বানিয়ে এনেছি, খেয়ে নাও। গত কালই এনেছিলাম। তুমি তো এলেনা তাই দিতে পারিনি।

নীলাদ্রি- -- নীলিমা সন্দেশ বানিয়ে এনেছ,  বা: দাও। জানো , দীপা যত দিন বেঁচেছিল তখন এটা সেটা কত কিছু বানিয়ে খাওয়াতো। পাঁচ বছর দীপা গত হল। এই পাঁচ বছর সব কিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেল। ভুলে গেছি নিজের চাহিদা গুলোর কথা। কি কি যেন খেতে ভালবাসতাম-- না, একদমই এখন মনে করতে পারছি না।

নীলিমা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে-- থাক্ ওসব আর  মনে করতে হবে না। এখন সন্দেশ গুলো খাও তো।নীলাদ্রি-- কিন্ত্তু এতোগুলো সন্দেশ তো আমি খেতে পারব না । দুটো খাব। আর দুটো তুমি খাও নীলিমা।

নীলিমা-- আমি বাড়িতে রেখে এসেছি। গিয়ে খাব।আচ্ছা তুমি এখন দুটো খাও, বাকিগুলো বাড়িতে নিয়ে সকালে খাবে।

নীলাদ্রি-- নীলিমা বাড়িতে নিতে বলছো! বৌমা যদি দেখতে পায় , তাহলে আর রক্ষে নেই। প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠবো, হয়তো আমার এখানে আসাই বন্ধ হয়ে যাবে!

নীলিমা-- কেন? এখানে আসা বন্ধ হবে কেন? একটু শক্ত হতে পারো না? নিজের পেনশনের টাকায়  নিজে খাচ্ছো বৌমাকে এত ভয় পাও কেন?

নীলাদ্রি--- হাসালে নীলিমা,  তুমিও তো স্বামীর পেশনের টাকায় স্বাবলম্বী, তুমি কি পারছ নিজের ইচ্ছে মত চলতে? তোমার পেনশনের টাকায় কি তোমার পুরো অধিকার আছে? এই বয়সেও হাত পুড়িয়ে নিজে রান্না করে খাচ্ছো। আমাকে তো তবু দুবেলা খেতে দেয় বৌমা। সকালের চা টাও পেয়ে যাই। ছেলে বৌমার হাতে এটাই বা কম কিসে! বিকেলের চা টা অবশ্য আমি বাইরে থেকেই খেয়ে নেই। বৌমা সন্ধ্যায় নাতিকে নিয়ে পড়তে বসে তো, ডিসটার্ব করা যায় না। যে টুকু পাচ্ছি, স্ত্রী বিহীন পুরুষদের জীবনে এটাই বা কম কিসে বলো! আসলে স্ত্রী অকালে মারা গেলে পুরুষদের জীবনে বেশি চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই। তোমরা মহিলারা  অবশ্য এদিক থেকে পুরুষদের থেকে অনেক এগিয়ে। যে কোন পরিস্থিতিতে তোমরা মানিয়ে নিতে পারো।

          নীলাদ্রির কথা গুলো শুনতে শুনতে নীলিমা শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। কি সান্তনা দেবে নীলাদ্রিকে? নিজেও কি খুব একটা সুখে আছে ? স্বামী মারা গেছে প্রায় দশ বছর। এখন বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে নবীনকে কত দেখে শুনে আশা করে বিয়ে করিয়েছে- কিন্তু বৌমা বড় অাত্ম কেন্দ্রীক। সারাদিন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত । নিজের স্বামী আর পুত্রই তার সংসার। শাশুড়ির প্রতি কোন কর্তব্য যেন তার মনেই আসেনা। তিন জনের রান্নার জন্য রান্নার লোক রেখে দিয়েছে , আর নিরামিষ খায় বলে নীলিমাকে এই বয়সেও দুবেলা রান্না করেই খেতে হয়। ছেলে নবীন যেন মা'র কষ্ট বুঝতে চায়না। বাজারটা অবশ্য করে দেয় । মাস বাধা ডাক্তার । ছেলেকে কত বলবে, সে তো সময় করেই উঠতে পারেনা। বৌমা তো যাবেই না। তাই আজকাল নীলিমা একা একাই ডাক্তারের কাছে যাওয়া আসা করে। 

      নীলিমা চুপ করে আছে দেখে নীলাদ্রি এবার বলে--   কি চিন্তায় ডুবে আছো নীলিমা?

নীলিমা--  উ: না তোমার কথাই ভাবছিলাম!

নীলাদ্রি--- কেন নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছ, তোমার উদাস দৃষ্টি বলছে তুমি নিজের কথাই ভাবছ। একটা কথা কি জানো, সংসারে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমাদের ছেলেপুলেরা এতো ব্যস্ত যে আমাদের সময় দেবার মত সময় ওদের কাছে নেই। আমাদের নাতিরাও পড়াশুনার চাপে দাদুদের কাছে আসবার সময়ই পায়না।

নীলিমা-- থাক নীল, শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকতে হবে না।  সময় দেবার ইচ্ছে থাকলে তো দেবে-- 

       নীলিমাকে থামায় নীলাদ্রি--- নীলিমা যাই বলো জীবনের এই দিনগুলিকে আর টানতে পারছি না। কখনো যদি পরপর কয়েকদিন না আসি তখন বুঝে নিও--

নীলিমা-- কি বুঝব তুমি নেই? --।তাহলে কাল থেকে আর এসো না। আগেই আমরা একে অপরের চোখের আড়াল হয়ে যাই তাহলে আর কারো খবর কেউ পাব না! নিজের স্বামীকে হারিয়ে গত দশ বছরে মনটাকে অনেক শক্ত করেছি,  আবার--

নীলাদ্রি-- কিন্তু নীলিমা মৃত্যুটাকে অস্বীকার করার  কোন উপায় আছে কি!

নীলিমা ---  হয়ছে এখন আর এসব আলোচনা করতে হবে না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে,  চলো তোমাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে আমিও ফিরে যাই।

নীলাদ্রি--- আমাকে এগিয়ে দিতে হবে না, আমি নিজেই চলে যেতে পারব। বরং আমি তোমাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে যাই চলো।

        এমন সময় নীলাদ্রির পাশের বাড়ির অকিলেশবাবু এগিয়ে এসে বলেন - কি নীলাদ্রি বাবু বাড়ি ফিরবেন , চলুন এক সাথে ফিরি। নীলাদ্রি -- হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন। নীলিমা আসি, তুমিও চলে যাও। নীলিমার দেওয়া সন্দেশগুলো হাতে নিয়ে নীলাদ্রি অখিলেশবাবুর সংগে চলতে শুরু করেন।

      বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই নীলাদ্রি কিছুটা এগিয়ে নীলিমার দিকে তাকিয়ে একবার হাত নাড়ে। নীলিমাও  হাত নেড়ে উত্তর দেয়। নীলাদ্রির দিকে দেখতে দেখতে  অতিতের গহ্বরে হারিয়ে যায় নীলিমা--

      এক বছর আগের কথা। এমনি এক বিকেলে এক ঘটনার মধ্য দিয়ে নীলাদ্রির সংগে নীলিমার পরিচয়। নীলাদ্রি বিকেলে মাঠে এসে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে মাঠের সবুজ ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছিল। মাঠ প্রায় ফাঁকা । ঠিক তখনি দূর থেকে নীলিমার চোখে পরে এক  বৃদ্ধ মাঠে শুয়ে আছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে কিন্তু লোকটি উঠছে না , নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পরেছে। নীলিমা এগিয়ে আসে। কাছে এসে দাদা ওঠোন বলে দুএকবার ডাকাডাকি করে, কিন্ত্তু কোন সাড়া নেই দেখে নীলিমা ভয় পেয়ে যায়-- লোকটি অসুস্থ হয়ে যায়নিতো! এবার ডাক দিয়ে বৃদ্ধের হাত ধরে টানে , আর তখনি বৃদ্ধ নড়ে চড়ে ওঠে। নীলিমা ধীরে ধীরে বলে -- দাদা বাড়ি ফিরবেন না সন্ধ্যা হয়ে এলো যে! নীলিমার ডাকে বৃদ্ধ উঠার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা, শেষে নীলিমার চেষ্টায় ওঠে বসে। লজ্জিত হয়ে বলে - আসলে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম। নীলিমা উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলে-- সন্ধ্যে হয়ে এল, দূর থেকে আপনাকে দেখে ভাবলাম আপনি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পরেছেন, তাই ডাকতে এলাম। আমি না দেখলে তো আপনি এখানে কতক্ষন শুয়ে থাকতেন কে জানে। বৃদ্ধ লজ্জিত হয়ে নীলিমাকে ধন্যবাদ জানায়। নীলিমা এবার জিজ্ঞাসা করে -- দাদা আপনার বাড়ি কোথায়, কোন দিকে যাবেন? সন্ধ্যা হয়ে গেল বাড়িতে চিন্তা করবে না?  নীলিমার কথায় বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে ছোট্ট হেসে বলে -- না  সেই দিক থেকে আমি মুক্ত। ঘরে আমার জন্য চিন্তা করার কেউ নেই। যিনি করতেন তিনি সব চিন্তার উর্ধ্বে চলে গেছেন। নীলিমা কিছু বলতে যাবার আগে বৃদ্ধ নীলিমাকে কোন দিকে যাবে জানতে চায়। নীলিমা বলেন তিনি বাদিকে যাবেন। বৃদ্ধ -- তাহলে আপনি যান আমি ডানদিকে এগোব। দুজন দুদিকে চলতে থাকে। 

         সেই সন্ধ্যায়  সামান্য কথা থেকে দুজনের পরিচয়। পরদিন বিকেলে আবার মাঠে ঢোকার মুখে দুজনের দেখা। দুজনেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ।আগের দিনের ঘটনার জন্য বৃদ্ধ নীলিমাকে আবারো ধন্যবাদ জানায় তারপর দুজনে আস্তে আস্তে গল্প করতে করতে  কিছুক্ষণ হেঁটে এক জায়গায় বসে । চলে পরিচয়ের কথা । দশ বছর আগে নীলিমা স্বামী হারিয়ে,  আর পাঁচ বছর আগে নীলাদ্রি স্ত্রীকে হারিয়ে বর্তমানে ছেলে বৌমার সংসারে  দুজনের প্রায় একই অবস্থা। দুজনেই দুজনের সমব্যাথী হয়ে ওঠে। এই ভাবে প্রতিদিনের আলাপচারিতায় গত এক বছরে সময়ের ব্যবধানে দুজনেই দুজনের মনের আয়নার ধরা দেয়।  আপনি'র সীমা লঙ্ঘন করে কখন যে তুমিতে ঠেকেছে নিজেরাও বলতে পারে না।আর মনমুখে  নীলাদ্রি শব্দটি যেন ছন্দহারা  তাই নীলিমা আজকাল "নীল" বলেই তাকে সম্বোধন করে। নীলিমার নীল সম্বোধনে নীলাদ্রিও যেন এই বয়সে একটা ভরসা , একটা হারানো মমতা খুঁজে পায় নীলিমার মধ্যে ।  যে ভরসা  বাড়িতে পায় না , সেই ভরসাই  গত এক বছরে একে অন্যের মধ্যে খুঁজে পায় তারা। একদিন মাঠে আসতে না পারলে একে অন্যকে কৈফিয়ত দিতে হয়! এই ভাবেই দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধা গত এক বছরে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের মন ও হৃদয়ের বন্ধনে জড়িয়ে পরেন। বিকেলের এই কিছু মুহুর্ত দুজনকেই নতুন করে বাঁচতে শেখায় প্রতিদিন। 

        ভাবনার অন্তরালে নীলিমা আরো কতক্ষণ ডুবে থাকতো কে জানে হঠাৎ এক মহিলার কথায় হুঁশ ফেরে-- এই যে দিদি অন্ধকার হয়ে আসছে চলুন আপনিও তো ঐ দিকে যান, চলুন আজ এক সাথে যাই। মহিলার কথায় নীলিমা  দেখে সত্যিই তো অন্ধকার হয়ে গেছে, মাঠ ফাঁকা । নীলিমা তারাতারি ওঠে মহিলার সংগে বাড়ির পথ ধরে।

          পর পর দুদিন নীল আসছে না। নীলিমা বিকেলে মাঠে গিয়ে গেটের পাশেই অপেক্ষা করে করে ফিরে আসে। মন অস্থির হয়ে পরে। এই বয়সে নারকেলের সন্দেশ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পরেনি তো নীল! নাকি ছেলের বৌ এর খারাপ ব্যবহারে খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলে নিতো!! দুদিন  পরপর মাঠে আসেনি এমন তো কখনো হয়নি! হায় ভগবান গত এক বছর দুজনে এক সংগে এত সময় কাটিয়েছে আর একদিন গিয়ে নীলের বাড়িটা কোথায় তা দেখে আসতে পারেনি নীলিমা? নিজের উপরেই প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। কালও যদি না আসে কোথায় গিয়ে খোঁজ করবে নীলের? না, মনে মনে ঠিক করে আগামীকাল সকালেই  ডান দিকের মোড়ে গিয়ে খোঁজ করবে। নীলের কথা ভাবতে ভাবতে চোখের কোন্ গুলি ভিজে ওঠে নীলিমার। নীলাদ্রির বাড়ির দিকে যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে থাকে। 

         পরদিন সকালে আর থাকতে না পেরে  হাঁটতে হাঁটতে নীলের খোঁজে এদিক ওদিক যায় নীলিমা, কিন্তু কেউ সন্ধান দিতে পারেনি , শেষে  ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। বাড়ি ফিরে মনে মনে স্থির করে আজ আর বিকেলে মাঠে যাবে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে নীলের, না হলে তার মন এমন কু ভাবছে কেন!! 

          বিকেল হতেই নীলিমা বিছানায় ছটফট করতে থাকে। তবু জোর করে বিছানায় শুয়ে থাকে। তার দুটো মনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এক মন অভিমানি হয়ে বলছে আর যেতে হবে না , আরেক মন বলছে যেতে হবে, যদি নীল আজ আসে অার তাকে না পায়? তখন নীলের কি মনের অবস্থা হবে! 

           ঘরের দেয়াল ঘড়িটা যেন আজ দ্বিগুণ শব্দে বেজে চলেছে। বিকাল চারটার পর ঘড়ির কাটা যত এগোতে থাকে ততই  নীলিমার বুকের গভীরে যেন শ্বাস আটকে যেতে থাকে। দুটো মনের দ্বন্দ্বে নীলিমার শরীর ঘামতে থাকে। সাড়ে চারটা বাজতেই নীলিমা বিছানায়  ওঠে বসে। না আজ সে শেষ বারের মত মাঠে যাবে! শরীরে শাড়ীটা কোন ক্রমে জড়িয়ে মাঠের দিকে দ্রুত হাঁটতে থাকে নীলিমা। এক মন তাকে পেছনে টানছে আরেক মন এই যন্ত্রণার শেষ দেখতে চায় আজই। দূর থেকেই তার চোখ  নীলকে খুঁজতে খুঁজতে এগোয়। মাঠের কাছাকাছি এসে গেটের দিকে চোখ পরতেই নীলিমার চোখ স্থির হয়ে যায়! একি! কাকে দেখছে সে? গেটের মুখেই দাঁড়িয়ে নীলাদ্রি, নীলিমার নীল তার দিকেই তাকিয়ে মিট্ মিট্ করে হাসছে।নীলিমা সামনে এসে দাঁড়ায় । কিছুক্ষণ দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে ।  দুজনেই বাক্ রুদ্ধ। নীলিমার চোখে শ্রাবনের ধারা নেমে আসে। নীলকে কিছু বলে না। পাশ কাটিয়ে মাঠের ভেতরে চলে যায়। নীল তার পেছন পেছন এগিয়ে আসে। একটু দাঁড়াও বলে দুবার ডাকে। কিন্তু নীলিমা হাঁটতে থাকে। এবার দুষ্টুমি করে নীলাদ্রি বলে-- নীলু আমার বয়স আজ আশি ছুঁল আমি কি তোমার সংগে হেঁটে পারব? নীলিমা ঘুরে দাঁড়ায় এবার, এগিয়ে এসে নীলের হাত ধরে তাকে মাঠে বসায় , তারপর ধীরে  বলে - সত্যি বলছ আজ তোমার বয়স আশি হল নীল! নীল-- হ্যাঁ ,  আজ অামি আশিতে পা রাখলাম । নীলিমা - তুমি আজ আমাকে একটি নতুন নামে ডাকলে নীল!  নীল-- হ্যাঁ , অাজ থেকে আমি তোমার নীল আর তুমি আমার নীলু ! নীলাদ্রির মুখে নীলু ডাক শুনে নীলিমা আবেগে আপ্লুত হয়ে পরে। চোখের জল মুছতে মুছতে বলে -- দশ বছর আগে মৃত্যুর কিছু মুহুর্ত আগেও  আমার হারিয়ে যাওয়া স্বামী আমাকে নীলু বলে সম্বোধন করে কি যেন বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি - থেমে গিয়েছিল----!

          একটু থেমে নীলিমা নীলাদ্রির হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে   ধীরে ধীরে  বলে - তোমার  জন্মদিনে আজ কি দেব  তোমায় বলো?

নীল-- এই বয়সে তোমাকে পেয়েছি। আমার হারিয়ে যাওয়া দীপা যেন আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে , এটাই তো অাশি বছর বয়সে তোমার কাছে পাওয়া আমার সেরা উপহার ! জানো নীলু,  তোমার সান্নিধ্য আমার বয়স যেন অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে । আবার যেন নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে!

          নীলিমা-- এবার বলো তো গত দুদিন আসনি কেন? তোমাকে সন্দেশ দিয়ে এই দুদিন কত দুশ্চিন্তায় থেকেছি জানো? ভাবছিলাম, এই বয়সে  নারকেলের  সন্দেশ খেয়ে তোমার শরীর খারাপ করল কি না! গত এক বছরে তোমার বাড়িটাও আমায় চেনালে না যে গিয়ে খোঁজ করব। দুদিন ধরে আসছো না, তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম আজই শেষ বার তোমার জন্য মাঠে আসব। আজ যদি তোমাকে না পেতাম , তাহলে আর---।  নীল  তাকে থামিয়ে বলে -- এই বুড়োর প্রতি এতো নির্দয় হয়ো না নীলু। তুমি পাশে আছো , সারাদিনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে এটাই একমাত্র স্বান্তনা! নীলিমা--- তুমি দুদিন না এসে আমাকে কত মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছ জানো? কিছুক্ষণ চুপ থেকে নীল বলে --- নীলু কাল থেকে বোধয় প্রতিদিন মাঠে আসতে পারবো না। নীলিমা-- কেন? নীল--  বৌমা বলেছে , সে বিকেলে দাদুভাইকে নিয়ে তার প্রাইভেট শিক্ষকের বাড়িতে যাবে সপ্তাহে চারদিন , এই চারদিন আমি যেন বাড়িতে থাকি। নীলিমা  নীলের কথা শুনে রেগে গিয়ে বলে-- তার মানে চারদিন তুমি বাড়ি পাহারা দেবে? নীল-  হ্যাঁ , তাই তো বল্ল বৌমা!

        এবার নীলিমা অার নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা। উঠে দাঁড়ায় । শক্ত হাতে নীলের হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলে-- আজ অার তোমাকে ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে হবে না। চলো যেদিকে চোখ যায় আমরা চলে যাব। জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমরা কারো হুকুমের অধীনে থাকব না। সুন্দর পৃথিবীটা এখনো আমাদের জীবন থেকে শুকিয়ে যায়নি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে  আমাদের মত করে বাঁচব। আমাদের জীবনটাকে বেসুরো হতে দেব না, চলো--- নীল নীলিমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু নীলিমা তাকে থামিয়ে দিয়ে তার হাত শক্ত করে ধরে সামনের পথ দিয়ে হাঁটতে থাকে। এক ঝলক প্রশান্তির হাসিতে একে অন্যের হাত  ধরে এগোতে থাকে তারা। ততক্ষণে সন্ধ্যার আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে তারার দল নিজেদের মেলে ধরেছে! রাস্তার লাইট গুলো আজ যেন মনের খুশিতে ঝলমল করছে! সন্ধ্যাকাশের শুকতারাটি আজ যেন দ্বিগুণ  উজ্জ্বল হয়ে তাদের  পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে। ফুরফুরে হাওয়ায় নীলুর একগুচ্ছ চুল মাথার দুপাশে দোল খাচ্ছে । চলতে চলতে নীলু নীলের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান ধরে- "চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে----"    ।

               ----------------------------


সসীম আচার্য , আগরতলা 


২৬শে সেপ্টেম্বর ২০২১

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.