Type Here to Get Search Results !

‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে’ : ডঃ শ্যামৎপল বিশ্বাস, ত্রিপুরা

এক সুর-সম্রাজ্ঞীর  বিষয়ে বলার মত অতটা ক্ষমতা নেই, সাহস করি এইজন্যে না হলে নিজেকে রিক্ত মনে হয়। কোন দৃষ্টিকোণ থেকে লিখবো ভেবে পাই না তবু কয়েকটি আঙ্গিক উল্লেখ করা একান্তই প্রয়োজন মনে করি। লতা মঙ্গেশকরের জীবনে বেশ উত্থান পতন ঘটেছিল সেটা তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা জানতে পারি। আমি খুব অল্প কয়েকটি টুকরো স্মৃতি প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে চাইছি। 

লতা মঙ্গেশকরের স্বল্প-পরিচিত অভিনয় ক্যারিয়ার এবং তাঁর মতামতঃ-


2006 সালের একটি সাক্ষাৎকারে, লতাজী বলেছিলেন, " আমি একজন অভিনেত্রী হিসাবে কাজ শুরু করি, কিন্তু আমি কখনই অভিনয় পছন্দ করিনি "।


যদিও বেশিরভাগ লোক তাঁর মনমাতানো  কণ্ঠস্বর এবং যেভাবে লক্ষাধিক মানুষ বিমোহিত হয়েছিল সে সম্পর্কে জানে, খুব কম লোকই তাঁর অভিনয়ের ছোট রোলগুলি সম্পর্কে জানত। তাঁর বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, লতা মঙ্গেশকর পিতা পন্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকরের মারাঠি মিউজিক্যাল ড্রামাগুলিতে শিশু শিল্পী হিসাবে কাজ করেছিলেন। 


যতীন্দ্র মিশ্র রচিত 

"লতা: সুর গাথা" বইতে লেখক লতাজির থিয়েটারে থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। লতাজী একটি পৌরাণিক আখ্যান আধারিত "সুভদ্রা" নাটকে অভিনয় করেছিলেন। এরপর লতাজী তার বাবার গুরুকুল চলচ্চিত্রে কৃষ্ণের ভূমিকায়ও অভিনয় করেন।  

   দীনানাথ মঙ্গেশকর 1942 সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

      লতা মঙ্গেশকর 1945 সালে মাস্টার বিনায়কের হিন্দি ভাষার সিনেমা "বঢ়ি মা" -তে তার ছোট বোন আশার সাথে একটি ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন। তবে তিনি কখনোই কোনো চলচ্চিত্রে লীড রোলে মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেননি।

   

      সাক্ষাৎকারটিতে লতাজী বলেছিলেন, "আমি একজন অভিনেত্রী হিসাবে কাজ শুরু করেছি, কিন্তু আমার অভিনয় পছন্দ নয়। মাস্টার বিনায়কের সঙ্গে কাজ করতাম। আমি সিনেমায়ও কাজ করেছি, কিন্তু আমার সেটা ভালো লাগেনি।" 

পাশাপাশি তিনি আরও বলেছেন যে মেক-আপ করা এবং বিভিন্ন পোশাক পরাও তিনি অপছন্দ করেন।


মাস্টার বিনায়ক 1948 সালে মারা যান এবং তার থিয়েটার কোম্পানি "প্রফুল্ল পিকচার্স " অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। 

  কিছুদিন পরে, লতাজী গীতিকার নাজিম পানিপতির গান "দিল মেরা তোড়া, মুঝে কহিঁ কা না ছোড়া" ছবি মজবুর (1948) এর সাথে তাঁর বড় ব্রেকিং পান। গানটি সেমি হিট হয়েছিল। এর পরে, লতাজী মধুবালা অভিনীত মহল (1949) এর জন্য "আয়েগা আয়েগা আনেওয়ালা" গান করার সুযোগ পান। এভাবেই ভারতের নাইটিঙ্গেলের যাত্রা শুরু হয়।

গানের তালিম ও পরম্পরাগত নিপুণতাঃ


ঘটনাস্থল মহারাষ্ট্রের এক গৃহস্থের অন্দরমহল, সেই বাড়িতেই ছাত্রছাত্রীদের সংগীতের পাঠ দিতেন থিয়েটার জগতের প্রথিতযশা এক শিল্পী। মাষ্টারমশাই হিসেবে ভীষণ কড়া ছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীরা তাঁকে যেমন শ্রদ্ধা করত, তেমন ভয়ও পেত। একদিন, কোনও কারণে মাষ্টারমশাই তাঁর সংগীতের পাঠশালায় কিছুক্ষণের জন্য অনুপস্থিত ছিলেন। ছাত্রছাত্রীরা অধীর আগ্রহে গুরুর আসার অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা নিজেদের মতো করেই গুরুর শেখানো রাগ অনুশীলন করছিলেন। ঠিক সেই সময়েই গুটি গুটি পায়ে ঘরের ভিতর ঢুকল একরত্তি একটি মেয়ে। ছাত্রের অনুশীলন শুনে ভুরু কুঁচকে গেল তার। বুঝল, ভুল হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর ভুল সংশোধন করে দিল সে! তার সংশোধন ছিল নির্ভুল!


সেদিনের সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন গুরুজি স্বয়ং। আড়াল থেকে সবটুকু দেখেছিলেন এবং শুনেছিলেন তিনি। ওইটুকু মেয়ের পারদর্শিতা তাঁকে যত না মুগ্ধ করেছিল, তার থেকেও অনেক বেশি বিস্মিত হয়েছিলেন। একইসঙ্গে, এই ঘটনা তাঁর মন অনাবিল আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল। কারণ, একরত্তি সেই মেয়ে যে তাঁর আপন সন্তান। কথায় বলে, জহুরির কখনও খাঁটি রত্ন চিনতে ভুল হয় না। ছোট্ট মেয়ের প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি সংগীতজ্ঞ মানুষটিও। তিনি আর কেউ নন, তাঁর নাম পন্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকর। তিনি ভারতের সুরসাম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের পিতা। আর যে ছোট্ট মেয়ের কথা বলেছি, সেই মেয়েই আমাদের সকলের প্রিয়, সকলের শ্রদ্ধেয় প্রয়াত শিল্পী লতা মঙ্গেশকর।


পন্ডিত দীনানাথ পরে জানতে পেরেছিলেন, তিনি যখন ছাত্র-ছাত্রীদের সংগীত শেখাতে বিভোর থাকতেন, ঠিক সেই সময় তাঁর মেয়ে লতা আড়াল থেকে সেই প্রশিক্ষণে কান পেতে থাকত। সেটাই ছিল লতা মঙ্গেশকরের সংগীত শিক্ষার প্রথম পাঠ। এ যেন একলব্যের অস্ত্রশিক্ষা! বিরল প্রতিভা না হলে এভাবে শিক্ষালাভ অত্যন্ত দুষ্কর। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে দীননাথ যখনই সরস্বতীর বন্দনায় বসতেন, লতাকে নিজের কাছে রাখতেন। অনেক সময় গান শুনতে শুনতে ছোট্ট লতা তাঁর কোলেই ঘুমিয়ে পড়ত। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল এক কিংবদন্তীর শিক্ষালাভ।


যাঁর বাবা স্বয়ং শাস্ত্রীয় সংগীতের একজন মহাগুরু, তাঁর গুণী মেয়েও যে জন্মদাতা গুরুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল হবেন, সেটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু, জীবন যদি এতই সহজ হত, তাহলে তো অনেক কিছুই ভীষণ সাদামাটা হয়ে যেত। লতা নিজেও চেয়েছিলেন, শাস্ত্রীয় সংগীতে পিতার উচ্চতায় পৌঁছতে। কিন্তু, তার আগেই ভাগ্য তাঁকে কঠিন বাস্তবের মাটিতে এনে দাঁড় করায়। খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সকলের বড়। পিতার অবর্তমানে তাঁর উপরেই সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে। যে সংগীত এতদিন ছিল তাঁর সাধনা, সেই পথেই উপার্জনের সূত্র খুঁজে পান লতা। গান গেয়ে পরিবারের সকলের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার গুরুভার নিজের কাঁধে তুলে নেন কিশোরী লতা। শুরু হয় নতুন লড়াই। ভারতের মাটিতে শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস।


লন্ডনের আইকনিক রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে লাইভ পারফর্ম করা প্রথম ভারতীয় শিল্পী হওয়ার গৌরব অর্জনঃ


কনসার্টটি সঞ্চালনা করেছিলেন অভিনেতা প্রয়াত দিলীপ কুমার, যাকে লতাজী "ইউসুফ ভাই" বলে সম্বোধন করতেন।


"যেমন ফুলের সুগন্ধের কোনো রঙ নেই, ঠিক যেমন প্রবাহিত জল বা বাতাসের কোনো সীমানা নেই, তেমনি সূর্যের রশ্মির কোনো ধর্মীয় বিভাজন নেই, লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠস্বর প্রকৃতির এমনই এক অলৌকিক ঘটনা।"      

          দিলীপকুমার বা ইউসুফ খান উর্দুতে তার বিখ্যাত সূচনায় সম্বোধনমূলক বক্তৃতায় এভাবেই  শ্রোতাদের মাঝখানে মঞ্চে করতালি দিয়ে স্বাগত জানান।


এই শো টি কয়েক দশক ধরে লতা মঙ্গেশকরের সবচেয়ে বড় বলিউড হিট্ সঙগুলি কভার করে, যার মধ্যে 'মধুমতি' থেকে 'আজা রে পরদেশী', 'পাকিজাহ'-এর 'ইনহিঁ লোগোঁনে নে' এবং 'মহল'-এর 'আয়েগা আয়েগা আনাওয়ালা' ইত্যাদি শতাব্দীজয়ী গান গুলি রয়েছে।


লাইভ শো থেকে রেকর্ডিং, লং-প্লেয়িং রেকর্ডের (LPs) দুটি ভলিউমে সেট করা, 1,33,000-এরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে সেসময়।


(বিঃদ্রঃ- রয়্যাল অ্যালবার্ট হল যেটা কিনা 1871 সালে রানী ভিক্টোরিয়া তার প্রয়াত স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের স্মরণে উদ্বোধন করেছিলেন, এটি যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রধান কনসার্ট ভেন্যু যা বছরের পর বছর ধরে বিশ্ব-বিখ্যাত শিল্পীদের হোস্ট করেছে। এটা সেন্ট্রাল লন্ডনের কেনসিংটন গার্ডেনে অ্যালবার্ট মেমোরিয়ালের অংশ এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়া ইভেন্ট এবং পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।) 


 প্রত্যেক ধরণের আবেগের জন্য কণ্ঠস্বরের মোচড়ঃ


সাজ্জাদ হুসেনের সঙ্গীতে আরবি প্রভাব হোক বা নৌশাদের ধ্রুপদী ঘরানার সঙ্গীত, লতা মঙ্গেশকর বিশিষ্ট সুরকারদের চাহিদার সাথে খাপ খাইয়ে নিতেন ধারাবাহিকভাবে।


রিহার্সাল করার সময়, সুরকাররা লতার স্মিত হাসির জন্য অপেক্ষা করতেন। এর অর্থ হল লতা একটি নির্দিষ্ট  চ্যালেঞ্জিং বাক্যাংশ খুঁজে পেয়েছেন। গীতিকাররা যে অব্যক্ত কথার জন্য আকাঙ্ক্ষা করতেন যে তিনি তাদের প্রাণহীন শব্দগুলিকে বেঁধে ফেলবে। যেমন মুলায়ম (নরম), পানি (জল) এর মতো সাধারণ শব্দগুলি একটি গভীর অর্থ বহন করত যখন তিনি সেগুলিকে সিনেমার গানে প্রয়োগ করলেন। ইয়ে কাঁহা আ গয়ে হাম (সিলসিলা) এবং পানি পানি রে (মাচিস) তে উপস্থাপন করেছিলেন এমনকি "হুন হুনা রে হুনাহুনা" র মতো কথোপকথন বাক্যাংশগুলি লতার কণ্ঠে প্রাণের সাথে স্পন্দিত হতে শুরু করে, যেমন উচ্চারণগুলি রুদালীতে কেঁদে ওঠেছিল।


তার কণ্ঠস্বর সি. রামচন্দ্র, রোশন এবং রবির মতো সুর নির্মাতাদের শৈলীর জন্য উপযুক্ত। সলিল চৌধুরী ক্রমাগত তাকে তার কমফোর্ট জোন থেকে ঠেলে তুলেছিলেন এবং আর.ডি বর্মণও তাই করেছিলেন। উচ্চ অষ্টকেও তিনি তার মাধুর্য বজায় রেখেছিলেন এবং নিম্ন স্বরলিপিতে গান গাওয়ার ব্যাপারেও খুব স্বচ্ছন্দ ছিলেন। মদন মোহন এবং খৈয়ামের সাথে, তিনি গজলে পারদর্শী হয়েছিলেন, যখন শঙ্কর জয়কিশান, কল্যাণজি আনন্দজি এবং লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলালের সাথে তিনি হিন্দি চলচ্চিত্রের গানের ব্যাপক আবেদনের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। এ আর রহমানের জন্য, লতাজী চেন্নাই ভ্রমণ করেছিলেন এবং একটি তৎক্ষণাত জাদুকরী আলাপ ভেজেছিলেন। তিনি জিয়া জলে ( দিল সে) রেকর্ড করছিলেন, "লুকা ছুপ্পি ( রং দে বাসন্তী) রেকর্ড করার জন্য, তিনি আট ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন। একটুও বসেননি পর্যন্ত।

সাউন্ড এডিটিং ও মিক্সিং-

লতা মঙ্গেশকর

তাঁর ভয়েস মাইক্রোফোনের মাধ্যমে প্রবেশ করতো এবং রেকর্ডিং যন্ত্রে নিখুঁতভাবে রেকর্ড হতো। রেকর্ডিং টেকনিশিয়ানদের তার ভয়েসের উপর সবচেয়ে কম কাজ করতে হয়েছে। গানের মেজাজের জটিলতা সম্পর্কে তার প্রশিক্ষণ এবং সংবেদনশীলতার উপলব্ধি তাঁকে অপরিহার্য করে তুলেছিল।


"লাগ জা গলে" ( ওহ কৌন থি ) যতটা ইথারিয়াল শোনাচ্ছে ততটাই প্রলোভনসঙ্কুল। "ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি" (পরখ) উচ্চ এবং নিম্ন অষ্টকগুলির উপর তার নিখুঁত নিয়ন্ত্রণের একটি উদাহরণ এবং "আজ ফির জিনে কি তামান্না হ্যায়" (গাইড) তে তিনি একটি মেয়ের উচ্ছ্বাস ক্যাপচার করেছেন যে সবেমাত্র কিছু সামাজিক শেকল ভেঙেছে। "ও বেকারার দিল " , এবং "আজিব দাস্তান হ্যায় ইয়ে, কাঁহা শুরু কাঁহা খতম" র মতো গানগুলিতে, তিনি সুন্দরভাবে প্রেমের বিষাদময় ছায়াগুলিকে বন্দী করেছিলেন। জয়দেবের সাথে ভজন "আল্লাহ তেরো নাম" বা এ "মেরে ওয়াতান কে লোগোঁন" কে ই বা ভুলতে পারে!


বঙ্গের প্রতি টানঃ


কলকাতার মিউজিক করিডোরে একটি জনপ্রিয় প্রবাদ অনুসারে, প্রতিটি আবেগের জন্য বাংলায় লতা মঙ্গেশকরের একটি গান রয়েছে। 

   যাদের হৃদয়ে ব্যথা আছে তাদের জন্য রয়েছে 'না যেও না, রজনী এখনও বাকী,আরও কিছু দিতে বাকী,বলে রাত জাগা পাখি '। সুখী-সৌভাগ্যবানদের জন্য আছে 'চঞ্চল মন আনমনা হয় যে তার ছোঁয়া লাগে'। গভীর ভক্তির জন্য রয়েছে 'মঙ্গল দ্বীপ জ্বেলে'। বাংলায় গানের প্রতি কান আছে এমন যে কেউ তার একাধিক প্রিয় গান ছিল লতার গান।

মাধবী মুখোপাধ্যায় 'আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাবো' ('শঙ্খবেলা'), 'তোমাদের আসরে আজ এই তো প্রথম গাইতে আসা' ('প্রক্সি') অপর্ণা সেন এবং সন্ধ্যা রায় 'কে যেন গো ডেকেছে আমায়' ('মনিহার') ছবিতে লিপ দিয়েছেন।


"আনন্দমঠ" ছবির কাজ শুরু হয়েছে। বন্দে মাতরম গানের সুর করতে হবে। গান কে গাইবে ? হেমন্তের পছন্দ ছিলেন লতা। কথাটা বলেন প্রযোজন শশধর মুখোপাধ্যায়কে। তা শুনে শশধর বলেন, লতা ফিল্মিস্তানে আসবে না। ও অনেক ব্যাপার। তুমি অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াও। হেমন্ত তো উভয় সঙ্কটে। লতাকে দিয়ে এই গান গাওয়ানো যাবে কি না নিশ্চিত নন। আবার লতা না গাইলে গানটাই মাটি। শেষে প্রায় মরিয়া হয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটা সিদ্ধান্ত নেন, তিনি শশধর মুখোপাধ্যায়কে বলেন আপনি বলছেন লতা আসবে না। কিন্তু, আমি যদি ওকে আনতে পারি তাহলে আপনাদের কোনও আপত্তি আছে কি ? শশধর শুনে বলেন, না। তাঁর তরফে কোনও আপত্তি নেই। বরং ও এলে ভালই হয়। কিন্তু, ও আসবে না। এরপর হেমন্ত নিজের উদ্যোগে এগোতে শুরু করেন। 


লতা মঙ্গেশকর তখন নানাচকের একতলা বাড়িতে থাকেন। সেখানেই গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। লতার আদর-আপ্যায়ণে তো তিনি মুগ্ধ। তারপর কথায় কথায় নিজের প্রস্তাব পেশ করেন তিনি। লতা একটু ভেবে বললেন, যদিও ফিল্মিস্তানের সঙ্গে আমার ঝগড়া, আমি ওখানে গাইব না ঠিক করেছি, কিন্তু শুধু আপনার জন্য গাইব। তখম হেমন্ত জিজ্ঞাসা করেন, কত টাকা লাগবে ? এর উত্তরেও লতা মঙ্গেশকর চমকে দেন। লতা শুনে বলেন, শুধু আপনার জন্যই গাইছি। পয়সার জন্য নয়। সুতরাং ফিল্মিস্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনও কথা বলার দরকার নেই। সেই থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক শুরু। যা ছিল আজীবন।


লতা মঙ্গেশকর জন্মগতভাবে বাঙালি ছিলেন না। বাংলা বুঝতেনও না। কিন্তু, ভাষাটার প্রেমে গিয়েছিলেন তিনি। তাই শুধু বাংলা শিখবেন বলে বাড়িতে শিক্ষক রেখেছিলেন লতা। শিক্ষকের নাম ছিল বাসু ভট্টাচার্য। দায়সারা ভাবে নয়, রীতিমতো লিখতে ও পড়তে যাতে পারেন, রীতিমতো সেই চেষ্টা  করেছিলেন তিনি।


 
‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে’ র পারিশ্রমিকও নেন নি-


প্রভাত রায়ের প্রথম ছবির গান গেয়েও টাকা নেননি লতা মঙ্গেশকর। প্রভাত রায়ের প্রথম ছবি ‘প্রতিদান’-এর যুগান্তকারী গান ‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে’ গানের জন্য কোনও পারিশ্রমিক নেননি তিনি। জীবনের প্রথম লগ্নে তাঁর সংস্পর্শে আসা এবং পরে তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা, লতা মঙ্গেশকরের স্মৃতি চারণায় জানালেন চিত্রপরিচালক প্রভাত রায়।


ডঃ শ্যামৎপল বিশ্বাস, ত্রিপুরা

২০শে ফেব্রুয়ারি ২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.