30/07/18.(তৃতীয় অংশ)
গত রাতেই ডায়েরীতে গুজে রেখেছিলাম সারাদিনের ঘোরার ফর্দগুলো।বেড়িয়েই চারদিকের পরিবেশের ঝলকানি দেখে মনে হলো এ দেশ বহুমাত্রিকভাবে তৈরী হওয়া ।একদিকে কোমল প্রকৃতি অন্যদিকে শুষ্ক শহর,এক প্রান্ত জ্যান্ত মাটি মানুষে ঘেরা তো অন্য প্রান্ত পোড়া মাটি ও মানুষে আবর্তিত।সবকিছু মিলেমিশে আছে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যমন্ডিত দৃশ্যপট।
ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানা এড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে হোটেল ছেড়ে বের হয়ে আসি।ছয় হাজার টাকা চুক্তিতে ইনোভা গাড়ী সাথী করে নেই সারাদিনের জন্য।সবুজ বনানী তখনও চোখে ধাঁধাঁর মত লেপটে আছে।হঠাৎ শহুরে তপ্ত হাওয়া ঝটকা মেরে জানান দিলো গোলকধাধার কথা।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম পথের দুধারে দীর্ঘকায় ইট পাথুরে বাড়ী,মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আর তার কোল ঘেঁষে নকসাদার ছোট বড় ঘষামাজা দালান বাড়ি।আবার কোথাও পরমস্নেহে লালিত ঝুপড়ি কুপড়ি।ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বড় বড় খিলানে।একটু অবহেলাতেই ঘাড় মটকে পড়ে যাবার ভয়ে স়েঁটে আছে।উ়ঁকি দিচ্ছে ভেতর থেকে জোড়া জোড়া চোখ।ঝলসে যায় অন্তর এই চোখগুলোর দিকে তাকালে।
বস্তুজগতের এই পার্থিব সৌন্দর্যেও বুঁদ হতে হয় মাঝে মাঝে।
যাত্রা শুরু করি ঢাকা চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়ক ধরে।চলার পথের পাশে লাখোয়াড়ি বস্তিবাস।আবাল বৃদ্ধ বনিতায় ঠাসা।শুনেছিলাম শহরে বস্তিবাসী জনসংখ্যার হারে এশিয়ায় দ্বিতীয় বাংলাদেশ।ঢাকা শহরের আশপাশ তারই জানান দিচ্ছে।এক দুজনের সাথে আলাপ আলোচনায় জানা গেলো নাগরিক সুবিধাবিহীন বস্তিবাসীরা সবসময়েই উচ্ছেদের আশঙ্কায় দিনাতিপাত করেন।ছোট বড় সব গাড়ি হনহনিয়ে ছুটছে,যাত্রীরা সব নাক মুখে রুমাল গুজে।বস্তীবাসীরা নাক মুখ খুলেই শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছেন।ধীরে ধীরে আমাদের গাড়িও এদের হাওয়া করে দিয়ে এগিয়ে গেল।খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্হ্যহীনতার শিকার এইসমস্ত বস্তীবাসীদের পাশে রেখেই আমাদের সবল সচল গাড়ী দ্রুতগতিতে শহুরে সীমানা ছাড়িয়ে গেল।দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে গেল।
এসে গেলাম নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনার গাঁ উপজেলার মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায়।সেখান থেকে বারদী গ্রাম,যেখানে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্হান ,পরম পূজ্য লোকনাথ বাবার পূণ্য সমাধিভূমি।হিন্দু ধর্মভূমি হলেও সব ধর্মের লোকের অবাধ যাতায়াত দেখে মন ভরে গেল।
পূজা আহ্নিক সেরে দুপুরে প্রসাদ গ্রহণ শেষে রওনা হই ঢাকার উদ্দেশ্যে।সূর্য তখন মধ্য গগনে।তারপর সদর ঘাটে।যেখান থেকে লঞ্চগুলো চাঁদপুর যাত্রা করে থাকে।সেখান থেকে শহীদ মিনারে।
দেখা পেলাম হীরা হাফিজার।চকচক করলেই সোনা হয় না,এ প্রবাদ হাফিজাকে পেয়ে উপলব্ধ হলো।ফুলের মালা হাতে নিয়ে সে দৌড়ে এলো সাজাবে বলে।ভাবলাম এ ভালোবাসা রাখি কোথায়।সাজিয়ে দিলো নিজের হাতে আমাকে আর আমাদের সফর সাথী সাগরিকা দি কে।সে মোহনীয় স্পর্শ ভোলার নয়।ওকে আনতে পারি নি সাথে করে,নিয়ে এসছি ওর ভালোবাসা হৃদয় ভরে।ক্যানভাসে এঁকে নিয়ে এলাম সময়ে সময়ে আদর করব বলে।
আরেক দর্শনীয় স্হান ঢাকেশ্বরী কালী মন্দির।কথিত আছে বল্লাল সেন মন্দিরটি নির্মান করেছিলেন।ঢাকেশ্বরী যা দেবী দুর্গা বা আদিপরামহাশক্তির একটি রূপ।অনিন্দ্যসুন্দর এই মূর্তিটি দীর্ঘকাল ধরে পূজিত হচ্ছে ও জাতীয় মন্দিরের তকমা পেয়েছে।
চলার পথে দেখে নিলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।দেখার সুযোগ হল ঐতিহ্যমন্ডিত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ।বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে,ষাটের দশকের ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে এই কলেজের ছাত্রদের অবদান স্মরনীয়।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও কলেজের ছাত্র,শিক্ষক,কর্মরত নার্স ও কর্মচারীদের অবদান ছিল অসামান্য।অনেকেই পাক বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে জীবন দিয়েছিলেন।
হু হু করে বয়ে যাওয়া সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুরে এলাম জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ি।যা বর্তমানে জাতির জন্য সংগ্রহশালা হিসাবে উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে।
দেখার সুযোগ হল সোহরাবর্দি গার্ডেন,পার্লামেন্ট ভবন,রামকৃষ্ণ মিশন,ইসকন মন্দির,একুশে পদক প্রাপ্ত ভাষা শহিদ রফিক,জব্বার,আব্দুস,বরকতদের পাথুরে মূর্তি গড়া স্মৃতি।
রাস্তার যানজট,সময়ের অপ্রতুলতা সব কিছুকে ডিঙিয়ে আর কিছু দেখার সাধ্য ছিল না আমাদের।
সাধকে মনে পুষে রেখে ,"আবার হবে তো দেখা ,এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো"--এই কথা কয়টি গুনগুন করতে করতে হোটেলের দরজায় পা রাখলাম।ঘড়িতে তখন রাত দশটা।
রীণা দাস, শিক্ষিকা
ত্রিপুরা
২১শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ইং