Type Here to Get Search Results !

যুদ্ধে কেউ বাঁচা মরার কথা চিন্তা করে অংশ নেন না, ডাক্তাররাও তাইঃ পি.আর.প্ল্যাসিড,জাপান

বর্তমানে সাড়া পৃথিবীতেই চলছে এক মহামারী। এটাকে কেউ কেউ যুদ্ধ বলছেন। অনেকে এর বিরুদ্ধে লড়াইকারীদের এ যুগের মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে ভূষিত করছেন। ৭১’ এ দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে দেশের আপমর জনসাধারণ এক যোগে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। এখানে হয়তো ৭১’ এর মত করে সবার অংশ গ্রহণ সম্ভব হবে না। কারণ চিত্রটা যে ভিন্ন। তখন সবাই ঘরের বাহিরে এসেছিল শত্রুর মোকাবেলা করতে আর এখন সবাইকে ঘরের ভিতর থাকতে হবে নিজের ও অপরের জীবন বাঁচাতে। করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম শহীদ হলেন সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা: মঈন উদ্দিন। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম শহীদ হওয়া ডাক্তারের গুণাগুণ তিনি মারা যাবার পর আমরা বিভিন্ন মিডিয়া এবং সামাজিক সাইটের মাধ্যমে জেনেছি। তার সাহসিকতা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি, মারা যাবার অল্প দিনের মধ্যেই তার সাথে কে বা কারা রাজনৈতিক পরিচয় সেটে দিয়ে তার প্রশংসনীয় কর্মকাণ্ডগুলোকে সমালোচিত করতে চেয়েছে। বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। অনেকটা দেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিণতির মতোই যেন। আমরা কী পেরেছি স্বাধীন দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ণ করতে? দেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তাদের আমরা ঘৃণ্য রাজনীতির বলি বানিয়েছি। ডা: মঈন উদ্দিনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে মনে হলো। ১৯৭১ সনে দেশের সূর্য সন্তানরা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সেই অংশ গ্রহণ ছিল তাদের দেশকে শক্রমুক্ত করে লক্ষ কোটি মা বোনের ইজ্জত রক্ষার। ইতিহাস থেকে যতটুকু জেনেছি, তখনও নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে ছিল। তখন গুজব ছিল, হিন্দুরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। যার ফলশ্রুতিতে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্লেন বোঝাই করে সৈন্য আমদানী করা সহজ হয়েছিল। কঠিন সত্য হলেও আমি যতটা বুঝি, তখন কেবলই জাতিগত বৈষম্য থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেননি। (আমি লাইনটি লিখলাম ইতিহাসের অবতারণ করে, কাউকে ছোট করতে নয়)। তবে আমি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাই আমার দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারে কারো কারো যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তখন বাধ্য হয়ে তারা নিজের জীবন বাঁচাতে এবং চোখের সামনে মা বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানাতে না পেরে প্রতিশোধ নিতেই অংশ নিয়েছিল যুদ্ধে। (মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বললে এমন কথাও বেরিয়ে আসে)। নয় মাসের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলো। সে সময় স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলার অবিসংবাদিত নেতা দেশ স্বাধীন হবার পর নানা কারণে দেশ শাসনের ক্ষেত্রে সফল হতে পারেননি। একসময় তার বিশ্বস্ত কিছু উশৃংখল এবং বিপথগামী সৈন্যদের হাতে সপরিবারে শহীদ হন। এরপর থেকেই দেশ ও দেশের মানুষ তার গতি হারায়। ১৯৭৫ এর আগষ্ট মাসে দেশের পট পরিবর্তনের ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাগণ বরাবরই অবহেলিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়ে আসছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির দ্বারা। দেশ পরিচালনার কারণে তাদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত। আবার যারা প্রকৃতভাবে দেশের জন্য জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন তারা দেশে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি এখনও তারা হচ্ছেন নিগৃহীত। সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলার মিলন সেনগুপ্তের কথা ফেইসবুকে জানতে পেলাম। শ্রী গুপ্ত মুক্তি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। স্বীকৃতি পাননি। খুঁজলে বাংলাদেশের ৬৪ হাজার বর্গমাইলে এমন সেনগুপ্ত আরো পাওয়া যেতে পারে। যারা অবহেলিত। নকল মুক্তিযোদ্ধাদের ভীড়ে আসল যোদ্ধারা অন্তরালে চাপা পড়ে গেছে প্রায়। শহীদ ডা: মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর খবরে কেবল তার জন্মস্থান ছাতক নয়, সিলেটের সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তার মৃত্যুর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। মঈন ছিলেন একজন মানবদরদি চিকিৎসক। সর্বমহলে তিনি ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার পিতা মুনসী আহমদ উদ্দিন ছিলেন একজন পল্লী চিকিৎসক। মৃত্যুর আগে ছেলেকে বলেছিলেন এলাকার অসহায় রোগীদের যেন নিয়মিত সেবা দেন। পল্লী চিকিৎসক পিতার কথা রেখেছেন ডা: মঈন উদ্দিন। প্রতি শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের ছাতকের নাদামপুরে ছুটে আসতেন, সেখানে তিনি বিনামূল্যে গরিব অসহায়দের ব্যবস্থাপত্র দিতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পও করেছেন তিনি। ২২তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজসহ স্বাস্থ্য ক্যাডারে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালের ২০ মে তিনি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। ডা. মঈন উদ্দিনের মতোই এবারের যুদ্ধে প্রধান যোদ্ধা হচ্ছেন আমাদের দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যারা শপথ নিয়েছেন তারা। অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স এবং সহযোগীরা। তাদের পেশাই মানুষের সেবা এবং জীবন বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু রোগীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের জীবন যদি হয় বিপন্ন তাহলে পরাজয় যে নিশ্চিত। করোনা নিয়ে মানুষ কিছু বুঝে উঠার আগেই যেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে কেউ কেউ। সরকার যতই লকডাউন দিচ্ছে কিংবা প্রেস ব্রিফিং দিচ্ছে কোনো লাভ হচ্ছে না। যাদের পেটে ভাত নেই তারা ওসবের ধার ধারে না। বেরিয়ে পড়ছে তারা বেঁচে থাকার তাগিদে। তাদের দ্বারাও হতে পারে এই ভাইরাস সংক্রামণ। দেশের অল্প সংখ্যক জনগোষ্ঠী সচেতন হলেও বেশীর ভাগ লোক যেখানে শিক্ষার আলো পায়নি তারা করোনা ভাইরাস সম্পর্কেও কিছু পরিষ্কার না। সাধারণত তারা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হলেও রোগ সম্পর্কে তথ্য গোপন করছে বা না জানার কারণে ডাক্তারদের নিকট সঠিক বিষয় বুঝিয়েও বলতে পারছে না। যে কারণে রোগীদের থেকে ডাক্তারগণও সংক্রমিত হচ্ছেন। বিষয়টা জেনেও ডাক্তারগণ রোগী সেবায় নিজেদের লুকিয়ে রাখছে না। এটাই প্রকৃত বীরত্ব ও সাহসিকতা। যুদ্ধে যেমন কেউ বাঁচা মরার কথা চিন্তা করে অংশ নেন না, ডাক্তাররাও এ যুদ্ধে বাঁচা মরার কথা চিন্তা করে অংশ নেননি। এ সাহসের পুরস্কার কী হতে পারে ভেবেছেন কী রাষ্ট্র পরিচালকরা? এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রোগীর চিকিৎসা সেবা দান করতে গিয়ে কোনো ডাক্তার যদি মারা জান তারা অবশ্যই দেশের সর্বোচ্চ সম্মান পাবার দাবী রাখেন। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট বলতে পারি তা হচ্ছে, ডাক্তারদের প্রধান এবং একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিৎ, তারা সবাই ডাক্তার। আজকের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে কেউ যদি রাজনৈতিক পরিচয় বুকে লাগিয়ে কাজ করেন সেটা হবে দুঃখজনক।

পি.আর. প্ল্যাসিড
------------------------------- লেখক : প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক,
জাপান

২৪শে এপ্রিল ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.