কীভাবে এলো বঙ্গাব্দ ? এ নিয়ে নানা মত রয়েছে।
যতদূর জানা যায়,বঙ্গদেশে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন ৯৬৩ হিজরী সনে বা ১৫৫৬ সালে।হিজরী সনের ইতিবৃত্ত ঘাঁটলে জানা যায়, ৬২২ খ্রীষ্টাব্দে হজরত মহম্মদ মক্কা থেকে মদিনায় হিজরী বা প্রস্থান করেন।এর দিন থেকে ইসলামী অব্দ বা হিজরী সনের প্রবর্তন।
প্রাক হিজরী পর্বে মহম্মদের সময়ে বা আরবভূমিতে সম্ভবত চান্দ্র সৌর মিলিত কোনও বর্ষপঞ্জি প্রচলিত ছিলো।ব্যবিলনে এ ধরণের ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিলো।ইহুদী ক্যালেন্ডারও এ রকম ছিলো।এদেরই রকমফের আরবভূমিতে মহম্মদের আগে ও পএর প্রচলিত ছিলো।এই ক্যালেন্ডারের চান্দ্র বর্ষ ও সৌর বর্ষের ব্যবধান দূর করার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছাড়াই একদল পঞ্জিকাকার চান্দ্র বর্ষ ও সৌর বর্ষের ব্যবধান দূর করার জন্য কয়েক বছর অন্তর একটি ত্রয়োদশ মাস ঢুকিয়ে বর্ষ পূরণ করতেন।সম্ভবত খলিফা ওমর তা বিধিবদ্ধ করেছিলেন।প্রসঙ্গত,উল্লেখ্য,সংস্কৃত ' অব্দ ' বা ' বর্ষ ' শব্দের আরবী ও ফারসী প্রতিশব্দ হলো যথাক্রমে সন ও সাল।
শের শাহের রাজস্বনীতি অনুসারে রাজস্ববর্ষ হিসেবে হিজরী বা ইসলামী সন গৃহীত ছিলো। হিজরী সন ঋতুনিষ্ঠ নয় এবং হিজরী সনের গণনা হয় চান্দ্র গননা অনুসারে।তাই আমরা দেখি,সম্রাট আকবর শের শাহের রাজস্বনীতি গ্রহণ করলেও তিনি বুঝেছিলেন ভারতবর্ষের মতো কৃষিপ্রধান উপমহাদেশে হিজরী সন বা চান্দ্র বর্ষ অনুসারে রাজস্ব আদায় অসুবিধাজনক।এই অসুবিধাগুলি দূরীকরণের জন্য আকবর ভারতবর্ষে একটি অব্দ প্রণয়নে উদ্যোগী হন।চৈত্র মাসে ফসল উঠার পর থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা টোডরমল ইসলামী চান্দ্র হিজরী সন ও হিন্দু সৌর বর্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ' তারিখ - ই - ইলাহী ' বা ' ইলাহী অব্দ ' বা ' ফসলী ' নামে বর্ষ গণনা পদ্ধতি চালু করেন।
প্রসঙ্গত,উল্লেখযোগ্য,জুলিয়াস সীজার প্রবর্তিত সৌর ক্যালেন্ডার,১৫৮২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে গ্রেগরীয় সংস্কারের পরে প্রচলিত ছিলো যা গ্রেগরী ক্যালেন্ডার বা ইংরেজী ক্যালেন্ডার নামে খ্যাত তা ছিলো একান্তভাবে ঋতুনিষ্ঠ।কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে, আকবরের বহু পূর্বে ফসলী অব্দের যা কিনা বঙ্গাব্দের প্রাকরূপ বলে কেউ কেউ মনে করেন তা ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিলো।এ প্রসঙ্গে ' Journal of Indian History ( vol xix ) ' তে প্রকাশিত ' Fasali Era ' শীর্ষক প্রবন্ধে ড. ডি. এস. ত্রিবেদা লিখেছেন ' The Fasali Era started with the birth of Harshavardhana in 593 A.D. and various others factors led to its adoption all over India. " এই মত যথার্থ হলে বলা যেতে পারে যে,আকবরের আগে থেকেই উত্তর ভারতে ফসলী অব্দ ছিলো,হয়তো অন্য নামে পরিচিত ছিলো।
বঙ্গাব্দ সম্পর্কে আরেকটি মত হলো স্রং সন গাম্পো নামে তিব্বতের জনৈক শাসক আনুমানিক ৫৯৫ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেন এবং তাঁর নামের অংশ ' সন ' থেকে বাঙলা ' সন ' এর উৎপত্তি।বঙ্গাব্দের সূচনাকাল নির্ধারণে অনেক ঐতিহাসিকরা অবশ্য বাংলার শাসনকর্তা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ( ১৪৯৩ - ১৫১৯ ) এর মতবাদকে গুরুত্ব দিয়েছেন।আলাউদ্দিন হোসেন শাহের মতাবলম্বীরা বলেন,সেই সময়ে বঙ্গদেশে হিজরী সন রাজকার্যে ব্যবহৃত হতো,কিন্তু প্রজারা শকাব্দকে অনুসরণ করতো।
এতে রাজস্ব আদায়ে অসুবিধা হতো।এই অসুবিধা দূর করার জন্য হোসেন শাহ পরিচালিত সৌর শকাব্দের মাসগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৮৯৯ হিজরী ( ১৪৯৪ খ্রীষ্টাব্দ ) থেকে হিজরীকে সৌরাব্দে রূপান্তরিত করেন এবং বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেন। কিন্তু হোসেন শাহ এ ব্যাপারে যে কোনও নির্দেশনামা দিয়েছিলেন এর পক্ষে কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলেনা।ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য ঘেঁটে যতদূর জানা যায়, তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ ( ১৫১৯ - ১৫৩২ ) সিংহাসনে আরোহণ করে ' নসরৎশাহী সন ' নামে এক নতুন অব্দ প্রবর্তন করেন।প্রশ্ন উঠতেই পারে,পিতার কোনও প্রবর্তিত অব্দ থাকলে পুত্র কী একে বাতিল করে নতুন অব্দ প্রবর্তন করতে পারতেন ? না কি নসরৎ শাহ নিজের স্বকৃতিত্ব জাহির করতে চেয়েছিলেন।বঙ্গাব্দের প্রবর্তন বিষয়ে সর্বশেষ মত হলো আনুমানিক ৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে গৌরবঙ্গের প্রবল প্রতাপান্ডিত সম্রাট শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেছিলেন।ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য ঘেঁটে জানা যায়,৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণের ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ঐ বছর মহাবিষুব সংক্রান্তির পরদিন পয়লা বৈশাখ থেকে সম্রাট শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেন।বঙ্গাব্দের উৎস সম্পর্কে সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ' বঙ্গাব্দের উৎসকথা ' (সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ ) গাণিতিক হিসাব কষে প্রমাণ করেছেন যে,শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক,তবে বঙ্গাব্দের প্রবর্তনকাল ৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দ নয়, ৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দ। গুপ্তযুগের জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির বৃহৎ সংহিতায় বলেছেন,২৪১ শকাব্দে ( ৩১৯ খ্রীষ্টাব্দ ) চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তির পরদিন পয়লা বৈশাখ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত তাঁর রাজ্যাভিষেকের দিন গুপ্তাব্দের সূচনা করেন।তাহলে একথা সহজেই অনুমেয়, চন্দ্রগুপ্ত শশাঙ্কের রীতি অনুসরণ করেই বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন।
ত্রিপুরা রাজন্যকাল থেকেই নববর্ষ উৎসব পালিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী পরম্পরায়।রাজআমলের সেই বৈশাখী মেলার স্মৃতি মনে পড়বে নিশ্চয় প্রবীণদের।সে যাই হোক, নতুন বছর রোগ, শোক, দৈন্যদশা ও মালিন্য মুক্ত হোক, বয়ে আনুক নবজীবনের সঞ্জীবনী মন্ত্র।
অমিত ভৌমিক,ত্রিপুরা
সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১লা বৈশাখ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
১৪ই এপ্রিল ২০২০ইং