Type Here to Get Search Results !

"আবার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে কার্তিক স্বামীর অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভার মধ্যে"... দীপান্বিতা সরকার, কলকাতা


কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা তাই মেলে দিলাম উত্তরাখণ্ডের মোর ইচ্ছেডানা। পাহাড় আমার ভীষণ ভীষণ পছন্দের জায়গা। পাহাড়ের বৃষ্টিভেজা পথ, মেঘ কুয়াশামাখা আদরের রকমারি সবুজের সমারোহ, নিরিবিলিতে পাখির কুজনে বা পাহাড়ের প্রতিটি অজানার বাঁক,. পাহাড়ের উপরে পড়া সূর্যের আলোর ঝলকানিতে যেন মন হারিয়ে যায়। গত তিন বছর ধরে আমি উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি, ভালোলাগা আর মনের চাহিদা পূরণের দাবিতে বারবার একই জায়গায় যেতে মন চেয়েছে। আজ আমি আমার ভালো লাগাটা একটু শেয়ার করব কারণ এই বছরে করোনার ভয়ে হয়তো আর সেই সৌভাগ্য হবে না। তাই কোনো ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন। এই সমস্ত টাই আমার এক কাছের মানুষের উদ্যোগে হয়েছিল হঠাৎ চা খেতে খেতে। আসলে আমি ঠিক সাহস পাচ্ছিলাম না, কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক সে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছিলো তাই কোনো রকম অসুবিধা হয়নি। চারধাম আর গোমুখ আমার মতন অনেকে গিয়েছেন কিন্তু অনেকেই কার্তিক স্বামী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করে। তাই আজ ইচ্ছা করছে কার্তিক স্বামীর অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভার মধ্যে হারিয়ে যেতে সেই ভ্রমণের স্মৃতি চরণের মাধ্যমে ।
কার্তিক স্বামীর মন্দির থেকে হিমালয়ের বরফ চূড়া দেখার আশায় আমি পৌঁছে গেলাম হরিদ্বার। হরিদ্বারে এক অদ্ভুত গন্ধ আছে যেটা সেই ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বেড়ানোর সময় থেকে আমার মনে লেগে আছে। হরিদ্বার থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম কেদারনাথ সেটা পরে একদিন গল্প হবে। তাই আজ সোজা চলে যাবো কনৌকচৌরির দিকে। আমরা ছিলাম তিন জন আর আমাদের গাড়ির ড্রাইভার, খুব সাদাসিধে মিশুকে মানুষ। কার্তিকস্বামী মন্দিরে যেতে গেলে খুব ভোরবেলা বেরোনো উচিত তার জন্য থাকতে হবে একটি ছোট্ট গ্রাম কনৌকচৌরি যেখানে এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। অল্প মানুষের বাস কিছু হোমস্টে বিরাজমান হয়তো থাকতে পারে সেটা আমার জানা নেই । আমরা ছিলাম মায়াদ্বীপ হলিডে হোম। এখানে একমাত্র গরম জল বা অন্যান্য কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। এখানেকটেজ গুলি ছিলো দুকামরা আর এক কামরা। একমাত্র থাকার জায়গা মায়াদ্বীপ হলিডে হোম নামে হলিডে হোম আসলে এটি একটি উন্নত মানে ইকো রিসোর্ট। পাহাড়ে র ঢালে মাত্র পাঁচটি কটেজ। মানে লোক বেশি হলে জায়গা পাওয়া কঠিন। কটেজ গুলো তাঁবু র আদলে গড়া ভেতরটা বেশ আধুনিক।
কটেজ চারিদিকে ফুল দিয়ে ঘেরা আর সামনে ছিল পাহাড়ের মোহনি রূপ। রাতে খাবার পর বারান্দায় চেয়ারে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম সেই পাহাড়ের দিকে। খুব ঠান্ডার মধ্যে হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু চাঁদের আলোয় পাহাড়ের রূপসজ্জা দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। বেশিক্ষণ বসা হলো না। বন্ধু মনে করিয়ে দিলো পরেরদিন সকালে ভোর চারটের মধ্যে হাঁটা শুরু করতে হবে তাই গুডনাইট জানাতে হলো অনিচ্ছাসত্ত্বেও।
ভোরের অন্ধকার থাকতে থাকতে টর্চের আলোই মন্দিরের পথে রওনা হলাম. রডোডেনড্রন গাছ আর পাইন গাছের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ। আমাদের গাইড এর প্রয়োজন হয়নি যেহেতু সাথে ড্রাইভার দাদা ছিলেন। কিন্তু অন্ধকারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে আমার সত্যিই খুব ভয় করছিল। একে হাড় কাঁপানো ডান্ডা তার উপর নিকষ কালো অন্ধকার আর ঝিঁঝিঁ পোকার গানশুনতে শুনতে পাথুরে চড়াই পথে মন্দিরে দিকে এগিয়ে চলা। ড্রাইভার হাতে লাঠি রাখতে বলেছিল দুটো কারণে একটা পথ চলার সুবিধা, দুই মাঝে মাঝে নাকি ভাল্লুক দেখা যায়। জানিনা আমাকে ভয় দেখাবার জন্য বলেছিলো কিনা । যদি আপনি নাগরিক সভ্যতাএ ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে ওঠেন , আর যদি জঙ্গলের বাতাসের ঝির ঝির শব্দের সাথে রোমাঞ্চকর পরিবেশ আর পাহাড়ের নিস্তব্ধতা আপনার আমার মতন কাম্য হয় তাহলে একবার সময় করে কার্তিক স্বামী মন্দিরে আসুন।
যাইহোক জঙ্গল ঘেরা রাস্তা পার হয়ে যখন পাথরের রাস্তায় এলাম দেখলাম চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। নিচের শহরে বিন্দু বিন্দু আলো আর ভোরের আকাশে জ্বলে থাকা তারার আলো মিলেমিশে একাকার -অপূর্ব দৃশ্য। আমাদের মন্দির থেকে সানরাইস দেখার উদ্দেশ্যে যাওয়া তাই আমাদের পৌঁছানোর আগেই সূর্যদেব নিজে আবির্ভাব না হয় তার জন্য জোরে জোরে পা চালাতে হচ্ছিল। একটা সমতল মতন জায়গা এসে দেখলাম সামনে পাহাড়ের চূড়া ঠিক টিলা র মতন উঁচু তার মাথা র উপরে মন্দির। কিন্তু চড়াই শেষ হতে শুরু হলো , খাড়াই সিঁড়ি -অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল। ভাবলাম আমি আর পারবো না যেতে কিন্তু যখন উপলব্ধি করলাম আমি মেঘের রাজ্যের উপরে দাঁড়িয়ে আছি আর আমার নিচে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের সব চূড়াগুলো সেটা যে কি আনন্দের তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। খুব কাছে থেকে আমি চৌখাম্বা কে দেখলাম, মন্দির এর একটু দূরে প্রচুর ঘন্টা বাধা আর মন্দির চারিদিক শুধু হিমালয় ময়।
প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচু থেকে চারিদিকে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ দেখা যায়। সাউথ ইন্ডিয়া থেকে আসা একটা স্টুডেন্ট আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নিজে থেকে আমাকে সব পাহাড়ি চূড়াগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।সেগুলো হলো ব্রম্ভকোমল, নন্দাদেবী, ডোনাগিরি, নীলকণ্ঠ, কেদার পিক, কেদারডোম, হুনুমান মুকুট, বান্দর পুচ, হাতি, ঘোড়া, ভাগিরথি ১২৩, তাছাড়া অসংখ্য নাম-না-জানা পিক। উত্তরাখণ্ডে একটিমাত্র কার্তিক মন্দির আছে। এই মন্দিরে কার্তিকের হাড় পূজিত হয়। পুরাণে কথিত আছে গণেশের কাছেই পৃথিবী প্রদক্ষিণে হেরে গিয়ে কার্তিক আত্মহতা করে মাংসপেশী মা দুর্গা আর হাড় গুলো পিতা শিব কে দেন যাহা এখানে পূজিত হয়। অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশে মন্দিরটি অবস্থিত।পূর্ব আকাশে আগুন ছড়িয়ে সূর্য দেব উঁকি দিলো কার্তিক দেবের কৃপায় সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়নি আমরা। সে এক অসাধারন দৃশ্য -সূর্য্যর রশ্মি যখন চারিদিকে ঝলমল করছে আর কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্য্য এর কিরণে বরফের মুকুট পরা শৃঙ্গ গুলো উঁকিঝুঁকি মারছে তখন অপার বিস্ময় তাকিয়েছিলাম কতক্ষণ জানি না। এখানে আসার সময় মন্দিরের কিছু আগেই একটা থাকার জায়গা দেখলাম সেখানে নাকি রাতে থাকা যায়। পরের বারে এসে এখানে একটা রাত কাটাবার ইচ্ছা আছে। মন না চাইলেও যে এবার ফিরতে হবে। ফেরার পথে এক আদিবাসীর সাথে যেচে আলাপ করে জানলাম রডোডেনড্রন গাছের আধিপত্য বিস্তারের জন্য

এখানে মার্চ-এপ্রিলে ফুলগুলি আগুনের রুপে রুপসী হয়ে ওঠে। সেইরূপ নাকি চোখ ঝলসে যাওয়ার মতন। আর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বরফে ঢাকা থাকে তাই মার্চ এপ্রিল মাসের ফুলের আগুন এর রূপ দেখার আবদার টা আগে থেকে প্রমিস করে নিয়ে অনির্বচনীয় রূপবতী চৌখাম্বা চোখে চোখ রেখে আমি বললাম আমি কোন এক সময় তোমার আরো কাছে যাবো। তোমার আমার দেখা হবে মদমহেশ্বরে। বিশেষ দ্রষ্টব্য: হরিদ্বার থেকে রুদ্রপ্রয়াগ আসতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা। আবার রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কনৌকাচোরি সময় লাগে দু ঘন্টা।তাই হরিদ্বার থেকে ভোর বেলা খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সন্ধ্যা র মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় কনৌকচোরিতে। তবে অবশ্যই থাকার ব্যবস্থা আগে থেকে ঠিক করে যাওয়া উচিত। এই ট্যুর টা সব কিছু প্রয়োজনীয় ইনফরমেশন, গাড়ি, হোটেল বুকিং করে দিয়েছিলেন তার ফোন নং এখানে দিলাম ঃ 9639245542


দীপান্বিতা সরকার
কলকাতা

২৪শে মে ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.