আজ (১৫ সেপ্টেম্বর) তোমার জন্মদিন। অমর কথাশিল্পী বললে ভারতীয় সাহিত্যে একজনকেই বোঝায়, সে হলে তুমি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক,তুমি।
শরৎবাবু, তুমি কি জানো তোমার সমাজের মেয়েরা কিন্তু আজ একদম ভালো নেই । সাহিত্যের মাধ্যমে তুমি যতটা সহজ ও অনাড়ম্বরভাবে এদেশের ঘরোয়া কাহিনী বিবৃত করে গেছো, যেভাবে এদেশের অবহেলিত, দারিদ্র-নিপীড়িত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, প্রেম প্রতিহিংসার ছবি এঁকেছো, সে তোমার মত আর কেউ এত সহজে পারে নি বলেই আজ এত বছর পরেও তুমি সবার হৃদয়ের সিংহাসনে দরদী মানবপ্রেমিক হয়ে বসে আছো
আচ্ছা বলতো তুমি, কেমন করে নারীর মনের ভাষা পড়তে জানতে ?কেমন করে নারীর সকল যন্ত্রনার ছবি ফুটিয়ে তুলেছো ?তৎকালীন সমাজ জীবন মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিল দীর্ঘজীবনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আনন্দ ভালোবাসা প্রেম-প্রীতি দ্বেষ-বিদ্বেষ সাহিত্য রসের মাধ্যমে অনন্যভাবে বিবৃত করে গিয়েছো ? সবচেয়ে অবাক হলাম, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করে একজন পুরুষ হয়ে তুমি তোমার কলমের আঁচড়ে সেই সময়ের পল্লী অঞ্চলের অবহেলিত নিপীড়িত নারীদের বঞ্চনা অত্যাচার, অসহায়ত্বের কাহিনী ফুটিয়ে তুলেছো, আজ এতো বছর পরও তোমার গল্পের রমা, নিরুপমা, জ্ঞানদা, অভয়া, অচলা, সাবিত্রী, হেমাঙ্গনারা যেন আমাদের চারপাশের গীতা, সুশীলা, দীপার মধ্যে দেখতে পাই।
তুমি নারীজাতির কথা এমন সুন্দরভাবে কি করে ভাবলে? মানুষের মনুষ্যত্বকেই বড় করে দেখিয়েছো তুমি তোমার গল্প- উপন্যাসে। কী অপরিসীম সহানুভূতি ও দরদে রাঙিয়ে তুলেছো নারীর জীবনের স্বাভাবিক সুখ-দুঃখকে? সমাজের মানদণ্ডে যেসব নারী চরিত্রহীন, তাদের মধ্যেও তুমি খুঁজে পেয়েছো মনুষ্যত্ব। তুমি পছন্দ করতে না, সমাজের অন্যায়-অত্যাচারে মানুষের হঠাৎ চরিত্র স্খলন হলে তাকে চিরকালের জন্য সমাজবহির্ভূত গণ্য করা, তোমার দৃষ্টিতে ছিল নিতান্ত অন্যায়।
আর আজ আমরা, মানুষকে ভালোবাসতে ভুলে গেছি নিজের স্বার্থের জন্য।
তোমার গল্পগুলোতে সমাজের সকল স্তরের নারীর কথা ছিল, পতিতার দুঃখ, বাল্যবিধবার হৃদয়বেদনা, স্বামীসুখবঞ্চিত নারীর অন্তর্দহন-
তুমি যে দৃষ্টিকোণ থেকে নারীদের জীবন যন্ত্রনার কথা লিখেছিলে আজ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ লেখে না, বলে না নারীদের কথা, জানো শরৎ বাবু।
বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ কাঠামো, বিকশিত হচ্ছে সভ্যতা ৷ পরিবর্তনের হাওয়াও লেগেছে মানুষের জীবনযাত্রায় ৷ আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, এখনো বন্ধ হয়নি তােমার মাধবী, সবিতা, কমললতার উপর নির্যাতন ৷ অথচ আমরা সবাই জানি, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী এবং সমাজের উন্নয়নে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য ৷ তারপর ও নারীর স্বাধীনতা আজও বন্দী কাগজে কলমে।
আজ তোমার মত একজনকে আবার দরকার যে নিদ্ধিধায় বলবে, "পুরুষের তত মুস্কিল নেই, তার ফাঁকি দেবার রাস্তা খোলা আছে, কিন্তু কোথাও কোনো সূত্রেই নিস্কৃতির পথ নেই শুধু নারীর।
জানো শরৎবাবু তোমার দেব আর পার্বতীর ভালোবাসায় কত মানুষ কেঁদেছে।তুমি এমন বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডি কেন লিখেছো? তুমি লিখতে গিয়ে যেমন কেঁদেছো, ঠিক তেমনি পড়তে গিয়ে আমরাও কান্নায় ভেঙে পড়েছি।
কঠিন নারী চরিত্র সৃষ্টিই নয়, নারীর পক্ষে এবং নারীর সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধেও তেজি, সাহসী কলম তোমারই ছিল সেই রক্ষনশীল সমাজে।আর তাইতো তুমি সকল নারীর অত্যন্ত আপনজন।
যাই হোক, শরৎবাবু, তোমার জন্মদিনে নারীদের জন্য এত ভাবতে পেরেছো বলে, তাদের কথা তোমার মন কে নাড়িয়ে উপন্যাস রচনা করে অনুপ্রাণিত করে বলে, নারী হয়ে তোমাকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রনাম জানাচ্ছি ।
তুমি ভালো থেকো শরৎবাবু।
সুস্মিতা দেবনাথ
আরশিকথা গ্লোবাল ফোরাম
১৫ই সেপ্টেম্বর ২০২১