যদু মল্লিকের বাগান বাড়িতে একদিন বেড়াতে এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বৈঠকখানায় বসে গল্প করছেন যদুর সঙ্গে। হঠাৎ দেয়ালে টাঙানো একখানা ছবির দিকে তাঁর নজর পড়ল। বড় মধুর ভাবের ছবিখানি।
মা আর ছেলে। মা'র নধর বাহুর বেষ্টনীতে পবিত্র একটি শিশু, ঊষার আকাশে প্রথম উদয়ভানু।
মা'দুটি বড় বড় বিভোর চোখে দ্রবীভূত স্নেহ, মুখে তৃপ্তিপূর্ণ হাসি। আর শিশুর মুখে সে যে কি নিস্পাপ সারল্য তা রামকৃষ্ণ যেমন বুঝেছেন তেমনি কি কেউ বুঝবে ?
" ওরা কারা হে ?"
" এক মেমসাহেব আর তার ছেলে। "
তাই হবে বা। অন্যদিকে চোখ ফেরাতে চাইলেন রামকৃষ্ণ। কিন্ত চোখ ফেরায় এমন সাধ্যি নেই।
" বলো না সত্যি করে। ওরা কে ? ও তো দেখছি জ্যোতির্ময় শিশু। আর ওর মা তো পুণ্যময়ী পবিত্রতা। "
" মা মেরী আর তার ছেলে যীশুখ্রিষ্ট। "
একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। দেখলেন যশোদা আর তার ছেলে বালগোপাল।
সোজা শম্ভু মল্লিকের কাছে গিয়ে হাজির হলেন।
বললেন,---
" যীশুখ্রিস্টের গল্প শোনাও আমাকে। জানোই তো আমার বিদ্যেবুদ্ধি। তবে এবার আমায় একটু বাইবেল শোনাও দিকি।"
শম্ভু মল্লিক বাইবেল নিয়ে বসলেন। আবিষ্টের মত শুনতে লাগলেন রামকৃষ্ণ।
ভূমাভিমুখী মন নামল অবগাহনে।
পরে একদিন উন্মনার মত চলে এলেন যদু মল্লিকের বাগান বাড়িতে। যদু মল্লিক বাড়ি নেই। বৈঠকখানা খুলে দিল চাকররা। শিশুযুতা মাতৃচিত্রের কাছে বসলেন রামকৃষ্ণ।
" মা গো তুই আমাকে একি দেখাচ্ছিস ?"
রামকৃষ্ণ দেখলেন সেই ছবি যেন জীবনায়িত হয়ে উঠেছে। মা আর ছেলের দিব্য অঙ্গের জ্যোতিতে ভেসে যাচ্ছে দশ দিক। তার অন্তর-বাহির ধুয়ে যাচ্ছে সেই জ্যোতিস্নানে। এতদিনের দৃঢ়মুল সংস্কার উন্মূলিত হয়ে যাচ্ছ। বিশ্ব-সংসারে আর কেউ বিরাজমান নয় -- শুধু পীযুষপ্রেমময় যীশু। কৃষ্ণ নয়, খ্রিস্ট। ঈশান নয়, ঈশা।
দেখলেন এ-ঘর যেন গীর্জা হয়ে গিয়েছে। নানা ধূপ দীপ মোমবাতি জ্বেলে ব্যাকুলতার মূকমূর্তি হয়ে প্রার্থনা করছে পাদরীরা। সামনে ক্লেশভার ক্লিষ্ট অথচ অক্লিষ্টকান্তি দেবতা।
কে তুমি পরম যোগী, পরম প্রেমিক ? কে তুমি " আদিত্যবর্ণং তমস: পরস্তাৎ ?" সংসারদুঃখগহন থেকে জীবের উদ্ধারের জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিলে। যাকে ত্রাণ করতে এলে, তারই হাতে প্রাণ দিলে হাসিমুখে। এলে যে যন্ত্রণার নিবারণে, সেই যন্ত্রণাই ক্ষমা হয়ে, প্রেম হয়ে শান্তি হয়ে উদ্ভাসিত হল।
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন এক গীর্জার সামনে। বড় রাস্তার পারে বড় গীর্জা। সব বিদেশী-বিজাতীয়দের ভীড়। " রাজার বেটা " না হোক, সব রাজার জাতের লোক। ভিতরে ঢুকতে সাহস পেলেন না রামকৃষ্ণ। কে জানে, হয়তো বা কালী-ঘরের খাজাঞ্চি বসে আছে।
" মা গো, খৃস্টানদের গির্জেতে তোমাকে কি করে ডাকে একবার দেখিও। কিন্তু ভিতরে গেলে লোকে কি বলবে ? যদি কিছু হাঙ্গামা হয় ? আবার কালী-ঘরে ঢুকতে না দেয় ? তবে মা, গির্জের দোরগোড়া থেকেই দেখিও।"
গির্জের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেন রামকৃষ্ণ। চক্ষু মেলে তাকালেন একবার ভিতরে। সর্বতচক্ষু রামকৃষ্ণের চোখে এখন " পরম পশ্যন্তী দৃষ্টি"।
দেখলেন সত্যিই এ কালী-ঘর। ভিতরের বেদীতে মা বসে আছেন, মা জগদম্বা। ভবতারিনী। সব্যে খড়গমুন্ডকরা, অসব্যে বরাভয়দাত্রী-- সেই মা, যিনি করালী হয়েও কৈবল্যদায়িনী। আনন্দধারায় দুই চোখ ভেসে গেল রামকৃষ্ণের।
সর্বত্রই এই মা'র ভজন। সর্বস্থানই মাতৃস্থান। কাজলের ঘরে বাস করলে গায়ে কালি লাগবেই, কিন্তু কোথাও আর কাজলের ঘর নেই, সর্বত্র কালী-ঘর।
তিনদিন থাকলেন এই খৃস্টানভাবে। চারদিনের দিন পঞ্চবটীতে বেড়াচ্ছেন রামকৃষ্ণ, দেখলেন কে একজন গৌরবর্ণ সুপুরুষ হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বুঝতে দেরী হল না বিদেশী বিজাতি। কিন্তু সৌম্য আননে কি অপার সৌন্দর্য, সর্বাঙ্গে দেবদ্যুতি।
কে তুমি ? তুমিই কি সেই পুরুষত্তম যীশু ? তুমিই কি সেই তমালশ্যামল বনমালী ?
সেই দেবদানব আলিঙ্গন করলেন রামকৃষ্ণকে। এক দেহে লীন হয়ে গেলেন দুজনে। লীন হয়ে গেলেন ব্রহ্মবোধে।
" আচ্ছা তোরা তো সবাই বাইবেল পড়েছিস ----" , একদিন ভক্তদের জিজ্ঞাসা করলেন ঠাকুর,
" সেইখানে যীশুর চেহারার কোনো বর্ণনা আছে ?"
" না, বাইবেলে তার উল্লেখ নেই।"
" আচ্ছা, যীশু কেমন দেখতে ছিল বলতো ?"
" কে জানে ! তবে ইহুদী ছিলেন যখন, তখন রং গৌর চোখ টানা আর নাক টিকালো ছিল নিশ্চয়ই।"
" কিন্তু আমি যখন দেখেছিলাম, দেখলাম নাক একটু চাপা। কেন দেখলাম কে জানে !"
ভাবে-দেখা মূর্তি কি আর বাস্তব মূর্তির অনুরূপ হয় ? কিন্তু যীশুখ্রীষ্টের আকৃতির যে বর্ণনা পাওয়া গেছে, তাতে তাঁর নাক চাপা বলেই লেখা আছে।
" মা গো, সবাই বলছে আমার ঘড়ি ঠিক চলছে। হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান ব্রহ্মজ্ঞানী। সকলেই বলে আমার ধর্ম ঠিক। কিন্তু মা, কারুর ঘড়িই তো ঠিক চলছে না। তোমার ঘড়ির সঙ্গে তো কেউই মিলিয়ে নিচ্ছে না ঠিক-ঠিক। সবাই ঘড়ির কাঁটা দেখে, কেউ ই তোমাকে দেখে না।"
মিশ্র এসেছে ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। ধর্মে খৃস্টান, বাড়ি পশ্চিমে। ভাই গিয়েছিল বিয়ে করতে, সেখানে বরের সভায় সামিয়ানা চাপা পড়ে মারা যায়। একা নয়, সঙ্গে আরো একটি ভাই--- গিয়েছিল বরযাত্রী। সেই থেকেই মিশ্র সন্ন্যাসী। পরনে প্যান্ট কোট বটে, কিন্তু ভিতরে গেরুয়ার কৌপীন।
" ইনিই ঈশ্বর, ইনিই রাম, ইনিই কৃষ্ণ ----" বলতে লাগল মিশ্র।
ঠাকুর হাসছেন। বলছেন," পুকুরে অনেকগুলি ঘাট। এক ঘাটে হিন্দুরা জল খাচ্ছে, বলছে জল। আরেকঘাটে খৃস্টানরা খাচ্ছে, বলছে ওয়াটার। মুসলমানরা আরেকঘাটে খাচ্ছে, বলছে পানী।"
মিশ্রের দিকে তাকালেন ঠাকুর, বললেন," কিছু দেখতে-টেকতে পাও ?"
" শুধু আপনাকে দেখি। আপনি আর যীশু এক।"
ঠাকুরের বুঝি যীশুর ভাব হল। দাঁড়িয়ে পড়লেন। সমাধিস্থ হয়ে গেলেন। ভাবাবেশে মিশ্রর দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। শেকহ্যান্ড কারতে লাগলেন।
# লেখা - অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বই "পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ" থেকে।
ॐ নিরঞ্জনং নিত্যমনন্তরূপম্
ভক্তানুকম্পাধৃতবিগ্রহং বৈ
ঈশাবতারং পরমেশমীড্যং ত্বং
রামকৃষ্ণং শিরসা নমামি।
ॐ ভগবতে শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ
*ছবি : হায়দ্রাবাদের শিল্পী রামকৃষ্ণ রাও কর্তৃক অঙ্কিত ও রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম রাজকোটের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।
ডাঃ শ্যামোৎপল বিশ্বাস
ত্রিপুরা
২৫শে ডিসেম্বর ২০২১