Type Here to Get Search Results !

বৃদ্ধাশ্রম - নয় নির্বাসন ঃ শিউলি চক্রবর্তী, ত্রিপুরা

'বৃদ্ধাশ্রম' এই শব্দটির সাথে  কোথায় যেন এক বিষাদের সুর বেজে ওঠে। সত্যি কি তাই? তবে একেবারে পুরোপুরি মিথ্যাও বলতে পারিনা। জন্ম থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে পারিবারিক পরিবেশে সবার সাথে মিলেমিশে, সুখে-দুখে কাটানোর পর জীবনের শেষ দিনগুলো অন্য অচেনা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া খুব যে সহজ তাও নয়।  আমাদের সমাজ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের একটি অঙ্গস্বরূপ বৃদ্ধাশ্রম এর সৃষ্টি।

আগে সমাজে বেশিরভাগ পরিবার একান্নবর্তী ছিল। এক দুজন পুরুষ চাকুরী বা বিভিন্ন জীবিকার সূত্রে বাড়ির বাইরে থাকতে বাধ্য হলেও মহিলা এবং বাচ্চারা বাড়িতেই থাকতো। ঠাকুরমা, ঠাকুরদা, দাদু দিদা এদের সঙ্গ দেওয়া এবং এদের দেখাশোনা করাটা কোনো বাড়তি কাজ বলে পরিবারের লোকেরা মনে করতেন না। শিশুদের লালন পালনে বাড়ির বৃদ্ধদের একটি বড় ভূমিকা থাকতো। জন্ম থেকে একসাথে থাকার ফলে এদের মধ্যে আন্তরিক টান অনুভূত হতো। নাতি-নাতনিরা আনন্দের সাথে ঠাকুরমা দিদার ফাইফরমাশ খেটে দিতো। এটা জীবনের অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো। এদের সাথে গা ঘেঁষে বসে বা পাশে শুয়ে পরস্তাব (রূপকথার গল্প) শোনা ছিল খুব আকর্ষণীয় ব্যাপার। বাড়ির কারো যদি ছেলে মেয়ে নাও থাকতো তাতেও বৃদ্ধ বয়সে তাদের অন্য সদস্যরা দেখাশোনা করতো। তাই বৃদ্ধাশ্রম এর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়নি।


বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিভিন্ন কারণে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেয়েরাও বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। ঘরে-বাইরে ব্যস্ততার কারণে বাড়ির বৃদ্ধদের সঙ্গ দেওয়া ও সঠিক দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বৃদ্ধদের মধ্যে একাকিত্বের সমস্যা বাড়ছে। উনারা ডিপ্রেশনে ভুগছেন। বৃদ্ধদের মধ্যে যারা ঠিকঠাক চলাফেরা করতে অক্ষম তাদের ক্ষেত্রে  সমস্যা আরো বেশি । বাড়িতেও এখন একজন বাচ্চার বেশি থাকে না। এদেরও Play School প্রায় দেড় বছর বয়স থেকেই শুরু হয়ে যায়। তাদেরকেও শিশু অবস্থায় ইঁদুর দৌড়ে সামিল হতে হয়। ছুটির দিনে সকাল শুরু হয় art School দিয়ে এবং শেষ হয় সাঁতার শিক্ষা দিয়ে। বাড়ির বৃদ্ধদের সাথে বসে গল্প শোনার বা ভাব বিনিময়ের সময় কোথায়  তাদের?  বর্তমানের শহর অঞ্চলের বহুতল ফ্ল্যাটে থাকা বৃদ্ধদের একাকিত্বের সাথে সাথে বন্দিজীবন হয়ে যাচ্ছে।

এই সমস্ত দিক দেখতে গেলে আমাদের দেশে এখন বৃদ্ধাশ্রম এর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একাংশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন যাদের কেউ নেই (ছেলে মেয়ে)। আর্থিক অবস্থাও ভাল নেই। একটা বয়সের পর কোন কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম একটা প্রয়োজনীয় আশ্রয়স্থল। অনেক এনজিও বা কোন সহৃদয় ব্যক্তি তাদের উদ্যোগে অনেক বৃদ্ধাশ্রম করেছেন যেখানে বিনা পয়সায় থাকা খাওয়া এমনকি প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও পাওয়া যায়। মানুষ বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। 


তাছাড়াও যাদের সন্তানরা বিদেশে বসবাস করেন তাদের জন্য 'বৃদ্ধাশ্রম' একটি উপযুক্ত জায়গা। বৃদ্ধ বয়সে বিদেশে গিয়ে বেশিরভাগ মা-বাবারা থাকতে চান না। মা-বাবাদের দুজনেই তো আর একসাথে পৃথিবী ছেড়ে যান না। যিনি থাকেন একা তার জন্য বৃদ্ধাশ্রম জরুরি হয়ে পড়ে। যতোই অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকুক একটা বয়সের পরে বা অসুস্থ হলে লোকের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে বৃদ্ধাশ্রম গুলি আমাদের ভালো আশ্রয়স্থল।

বৃদ্ধাশ্রমের নিজের পরিবারের মাঝে থাকা হয় না ঠিকই কিন্তু কিছুদিন থাকার পর এটাই সবার পরিবার হয়ে ওঠে।  সেখানে একাকিত্ব বলে কিছু নেই। বেশিরভাগ সময় সবাই মিলে গল্প করে নিজেদের স্মৃতিচারণ করে সুন্দর সময় কেটে যায়। সময়মতো খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। চিকিৎসার সুযোগ থাকে। সবচাইতে যা শান্তি দেয় মনে সেটা হল  --- এখানে সবাই পরিবার ছেড়ে এসেছে। মানে 'আমরা সবাই এক' এই বোধ সবাইকে স্বস্তি দেয়। সবার বয়স কাছাকাছি, এতে করে মনের মিলও তৈরি হয়। বয়স কালে যেটা  সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ---জীবনের রুটিন মেনে চলা,  সময়মতো খাওয়া  দাওয়া করা এগুলি  বৃদ্ধাশ্রমগুলিতে মোটামুটি ভাবে মেনে আলা হয়। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এদিক সেদিক বেড়াতে যাওয়া হয়। দুর্গা পুজোতে পুজো দেখানোর ব্যবস্থা থাকে। পত্রিকা ম্যাগাজিন পড়া, সবাই মিলে টিভি দেখা ইত্যাদির আনন্দই আলাদা। 

এইসব বৃদ্ধাশ্রমে অবশ্যই টাকা দিয়ে থাকতে হয়। আত্মীয় পরিজন চাইলে নির্দিষ্ট সময়ে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে তাদের নিজেদের লোকদের সাথে দেখাও করতে পারেন। আজকাল মোবাইল ফোনের যুগ। বাবা-মা সঙ্গে না থাকলেও চাইলে ফোনে যোগাযোগ করতে পারেন। Video call এর মাধ্যমে দেখতেও পারেন। একসাথে থাকা সম্ভব না হলেও যোগাযোগ রাখা যায়।

বর্তমান ব্যস্ততার যুগে বৃদ্ধাশ্রম একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় স্থান যেখানে বয়স্করা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। একাকিত্বের কারণে তাদের মধ্যে যে অবসাদের সৃষ্টি হয় সেটা হবে না। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় এমনকি ত্রিপুরাতেও অনেক বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার নরসিংগড় এলাকায়  সরকার  পরিচালিত একটি বৃদ্ধাশ্রম আছে। এছাড়া বড়জলায় আছে " আপনাঘর" মধুবনে আছে "পথের সাথী" এগুলো অবশ্য বেসরকারী। প্রতিটিতেই মোটামুটি  ভালো থাকার ব্যবস্থা আছে।

যুগ বদলেছে কাল বদলেছে আর তার সাথে সাথে বদলেছে অনেক কিছু।  বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমানতার চাপে  মানুষের বসবাসের জায়গার অভাব হয়ে উঠেছে প্রকট। এই অবস্থায় বাড়ির বয়স্ক মানুষরা যদি বহুদিন ধরে বাড়ির একাধিক  ঘর আগলিয়ে বসে থাকে তবে ছোটোরা যাবে কোথায়?  সাথে আছে চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারনা,মূল্যবোধের পার্থক্য।  সমাজের   দ্রুত পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে পারছেন  না বাড়ির অভিভাবকরা। ফলে  দেখা দিচ্ছে মনোমালিন্য, মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে অশান্তি। আজকের এই রোবটের যুগে অনেক সময় চেষ্টা করেও আমাদের  নতুন প্রজন্ম   ধরে রাখতে পারছে না  তাদের মানবিকতা, তাদের সহমর্মিতা, তাদের  উষ্মা।  তাই বোধহয় সময় এসেছে নতুন করে ভাববার,  নতুন করে চিন্তা  করবার,  সময় এসেছে বৃদ্ধাশ্রম কে নির্বাসন না ভেবে শেষ বয়সের সঠিক ভরসার স্থল ভাববার।


- শিউলি চক্রবর্তী, ত্রিপুরা


ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট

৭ই আগস্ট ২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.