Type Here to Get Search Results !

প্রেম দিবসের ভাবনায় ।। রীণা দাস, ত্রিপুরা

কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত-----

বোকা না সহজ স্বভাব অমিতের সে নিজেও ঠাহর করতে পারে না।নিজেকে পরিমাপ করার মত কোন মানদন্ডও নেই তার হাতে।আর তা যদি হয় কাউকে মানে কোন মেয়েকে মনে ধরার মত তাহলে বোধহয় অমিত কেন গোটা পুরুষ জাতিই সিংহ থেকে চুনোপুটি ইঁদুর হয়ে যায়।
তখন কত আর বয়স হবে অমিতের--পনের কি ষোল,সবে মাত্র স্কুলের গন্ডিতে যৌবন ঢুকছে।মনেও দোলা যুবক বয়সের।এ সময় সব রঙিন।প্রজাপতিরা পাখনা মেলে মনের সুখে।হাফ প্যান্ট ছেড়ে সবে ফুল প্যান্টে উন্নিত ছেলের দল।রঙিন নেশা সবার চোখে মুখে।এর মাঝে যদি কোন মেয়ের প্রতি নেশা লেগে যায়,তো এ নেশা ঘোর লাগার মত।সব নেশা ছাড়াবার মত নয়।সূর্য ডোবার সাথে সাথে এ নেশা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে যায় অমিতের।

বসন্ত সেদিনও এসেছিল অমিতের মনে ঋতুর হাত ধরে।অমিতের হৃদয়ে সেই ছেলের দলের মাঝে বসন্তের রঙ একটু অন্যভাবেই সাড়া জাগিয়েছিল।হাওয়া হয়ত এমনই।সবাইকে সমানভাবে ছুঁতে পারে না।ঝটকা লেগেছিল অমিতের।দেখেছিল পথ চলতি অনেককেই।আবালবৃদ্ধবনিতা,কেউ বাদ যায় নি।এ বয়সে নজর থাকে তুখোর।ছাপিয়ে যায় সবকিছু।অমিতের চোখ ছিল শান দেওয়া।ঝাঁঝালো ছুড়ির মত।হাজারো লোকের ভিড়ে সেদিন তার চোখ যেন কাকে খোঁজছিল।এত মানুষের ভিড়ে সে কেমন একাকীত্বের জালে বুঁদ হয়ে পড়েছিল।

এমন এক বসন্তের হাওয়ায় কেউ আটকে যায় অমিতের দৃষ্টিতে।সম্পূর্ণ অন্যজন।সবাই নারী,সবাই পুরুষ।এর মাঝেও বিশেষ কেউ --অনুভবে এসে যায় অন্যভাবে।একদিন দুদিন পরপর যখন একজনই দোলা দিয়ে যায় মনে,ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের অন্তঃস্হল,কানে এসে গুনগুনিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে যায়--সকলের অশ্রাব্য যে মধুর সুর,তখন অমিত বুঝতে পারে হৃদয় মন্দিরে এবার ঝংকার তোলার কেউ এলো বুঝি।

বসন্তের হাওয়ায় এমন দিনে ই ঘ্রাণ ছড়িয়ে গেছিল লাবন্য।বুঝতে পারেনি এমন সুগন্ধে কেউ পাগলপারা হতে পারে।বুঝার কথাও নয়।সবে মাত্র বার তের বয়স।কিশোরী বয়স জাগে নি তখনো।মনে শৈশবের দৌড়ঝাঁপ।ফাগুন তখনো বই পুঁথিতে আবদ্ধ।ফাগুনের আগুনের মর্ম তার বুঝার কথা নয়।বালখিল্যভাব তাকে ঘিরে রাখে অনুক্ষণ।প্রেমানুভূতি গ্রাস করবে এমন হাওয়ায় পরিচিত হবার ডাক আসে নি তখনো।

সেই লাবন্যের দিকেই শ্যেন দৃষ্টি পড়েছিল অমিতের।অমিতও বুঝেনি একেই প্রেমের পূর্বরাগ বলে কি না ।প্রতিমূহুর্তে আঁখি ছটফট করে মরে যার তরে,তার বোধগম্যতা নেই।সেই বোধহীন চঞ্চলা চপলাকে ঘিরেই অমিতের কল্পনার জগত আঁকা শুরু হয়েছিল।ধীরে ধীরে অনুভব করে অন্য এক জগতের।যে জগতে আর কেউ নয় ,কেবল দুজন।কিন্তু হঠাৎ ফাটকা মনে হয় সব।এ কেবল ভাবনাই।মরুভূমি কেবল।ধূ ধূ প্রান্তরে পিপাসা কাতর ভালোবাসার আর্তজনে কেউ তৃষ্ণা নিবারণের নেই।এ কেমন পাগলপনা মন !!! 

অমিত বুঝে যায় --ভালোবাসা কারে কয়।নীরবে দহন করে যায় যে--সেই বুঝি।আত্মজন বুঝি সেই ই--যে সব ভাবনাকে তছনছ করে দিয়ে যায় ,সামনে না এসে,অলক্ষ্যেই।

লাবন্য নির্বিকার।অমিতের বুকের ভিতর বয়ে চলে ফল্গুধারা,অন্তঃসলিল হয়ে।সময় গড়িয়ে যায় সময়ের তালে।বহু বার চিত্ত চঞ্চল হয়েছে লাবন্যকে তার মনের ভাব ব্যক্ত করবে বলে।হোঁচট খেয়েছে মনে মনে প্রতিবারই।যুবকে পরিণত হওয়ার প্রাক লগ্নে এমন উথাল পাথাল হওয়া মানসিক অবস্হাই পূর্বরাগ,বুঝেছিল অমিত অনেকটা সময় পেরিয়ে।পূর্ণ যৌবনাবস্হায় যখন ক্লাশে পাঠ দিতেন বাংলার শিক্ষক মহাশয় পুলকেশ স্যার।কৃষ্ণকালো ,কৃষ্ণচোখের শিক্ষক মহাশয় পাঠ আলোচনাকালে কখন যে অমিতর মনে প্রেম জাগিয়ে তুলেছিলেন ,সে বোধহয় অমিত ছাড়া এ পৃথিবীর কেউ জানতে পারে নি।

সে থেকে আরও আকর্ষণ বোধ করত অমিত লাবন্যের জন্য।আর ভাবত রঙে ঢঙে কতই তো এপার ওপার হচ্ছে লাবন্যেরই মত কত মেয়েরা।কই কারো প্রতি তো এমন বোধ জন্মায় নি।তবে কেন ওই কাজল নয়না ??অমিত ততদিনে চোখের ভাষা,চোখের সৌন্দর্য্য শিখে নিয়েছে।লাবন্যের কাজল কালো চোখের দৃষ্টিতে সে কি পাঠ করতো,নিজেও বুঝে উঠতে পারে নি।কেবল অবগাহন।গভীরে,আরো গভীরে।

একাকী পথ চলা,বন্ধুদের এড়িয়ে যাওয়া তার অভ্যাসজাত হয়ে গেল।খুঁজতে থাকে নিজেকে,খুঁজে লাবন্যকে মনের গভীরে।কখনো বুক ধুকপুক করা তো কখনো বুকের পাঁজরে খামচে ধরা অনুভূতি।পাগল করে তুলে অমিতকে।বলবে কি লাবন্যকে তার অনুভবের কথা ??? কি ভাবে নেবে লাবন্য অমিতের অনুভবকে ?? বেলেল্লাপনা বলে গুড়িয়ে দেবে না তো তার স্বপ্নকে ?? তিলে তিলে করে গড়ে তোলা ভালোবাসার বোধকে যদি আবর্জনার স্তুপে ছুড়ে ফেলে দেয় ???  যদি আর কোনদিন লাবন্যকে নিয়ে সুন্দর ভাবনায় নিজেকে না জড়িয়ে রাখতে পারে --

ভাবতে ভাবতে অমিতর হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।সমুদ্রের জোয়ারের মত।ভাবতে পারে না অন্য কিছু।ছেদ পড়ে যায় সব ভাবনায়।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।দিনের প্রখর সূর্যতাপ ম্লান হয়ে আসে।মূহুর্তে পুরো আকাশ ধূসর মেঘে ঢেকে যায়।কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে অমিত।ভাবে ,প্রয়োজন কি প্রকাশের ।প্রত্যাখ্যাত হওয়ার চেয়ে ঢের ভালো নীরবে লাবন্যকে লালন করে যাওয়া।যার কাছ থেকে সে কখনো ফিরবে না।প্রত্যাখ্যানের ভয় থাকবে না।সেই ভালো।

------------------------------------------------------------------------------
কেটে গেছে বহু সময়।বয়ে গেছে অনেক বসন্ত।পাতা ঝরে গেছে অনেক বৃক্ষরাজির।আবারও নতুন পাতা,নতুন ফুল।শিউলি গাঁদা ঘেঁটু ছেড়ে জিনিয়া ক্যামেলিয়া আরো কত কি। নতুন মুখ,নতুন কালো চোখ,নতুন পোষাকে আষাকে আরো নতুন নতুন কতো কি ---কত বোধ আসে ,কত বোধ যায়।অনুভবগুলো তরতর করে উল্টে যায় পাল্টে যায়।সময়ের পরিবর্তনে কত কিছুর বিবর্তন,পুরনোর পরিবর্তে সব নতুন আঙ্গিকে।চকচকে সব মোড়ক।ভাবনাগুলো নতুনের ছোঁয়া পায় ঠিকই কিন্তু সে যেন হঠাৎ পেয়ে হঠাৎ যাওয়ার মত।ছলকে উঠে ছলাৎ ছলাৎ বেগে আবার নিমেষে পরেও যায়।বোধ স্হায়ী হয় না কারো পানেই।

"ভালোবাসি"--এই চার অক্ষরের শব্দ লাবন্যকে মুখ ফুটে বলতে পারেনি কোনদিন অমিত।বিয়ে থা করে পুরোদস্তুর সুখী সংসারী সে।অনেক বসন্ত পেরিয়েছে দুজন দুজনের হাত ধরে।পাশাপাশি পায়ে পায়ে হেঁটেছে অনেক দূর।অনেক রোদ্দুর উঠা একসাথে বসেই দেখেছে।কোন খামতি নেই অমিতর সংসারে।অমিতর স্ত্রী তাকে প্রেম ভালোবাসায় পূর্ণতা দিয়ে ঘিরে রেখেছে।কিন্তু যে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়ে আছে অমিতর হৃদয়ের গভীরে --সে শূণ্যতা পূর্ণ হবার নয় কোন বসন্তেই।এ বসন্ত বারংবার হাহাকার হয়েই ফিরে আসে তার কাছে।প্রেম বুঝি এমনই হয় ।বিরহে যার পূর্ণ আস্বাদন।

বলতে পারে নি আজও অমিত লাবন্যকে তার ভালোবাসার কথা।

কে জানে বসন্তের ঝরা পাতার মর্মর শব্দ বেয়ে লাবন্যর কানে কোকিলের কুহুতানে মিশে সে সুর পৌঁছাবে কি না।বহু বসন্ত আগলে রেখে অমিত তাকিয়ে আছে কাজল নয়না লাবন্যর মুখপানে ।যদি কোন দিন বলতে পারে ---আমাদের জীবন গেছে চলে কুড়ি ,কুড়ি বছরের পাড়ে -----।

কত বসন্ত এলো আর গেলো --অমিতর অপেক্ষা অবিরত আজও।।


রীণা দাস, ত্রিপুরা 


ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১৪ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.