Type Here to Get Search Results !

দিনে দিনে সোমেশ্বরী-বিরিশিরি"... আরশিকথা'র ভ্রমণ বিভাগে লিখলেন সৈয়দ ইফতেখার আলম

নেত্রকোনো ঘুরে এসে: প্রকৃতির কী এক জাদু আছে, তা মানুষকে বশীভূত করে রাখে। সাধারণে দেয় দোলা, কবিমনে তোলে ঝড়, স্বপ্নবাজকে করে আত্মপ্রত্যয়ী আর প্রৌঢ়কে করে তার মতোই চিরসবুজ। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে। কথাটা মনে হচ্ছিল ক’দিন ধরে। শুধু ঘাস দেখতে বের হব। চায়ের সঙ্গে যেমন বিস্কুট হলে জমে, তেমনি মন বলল, ঘাসের সঙ্গে পাহাড় হলে জমবে। পাশাপাশি নদীও থাকা চাই! ভাবনায় পড়ে গেলাম। কোথায় যাওয়া যায়? হাতে সময় কম, দিনে দিনে ফিরতে হবে। হুট করে মনের মধ্যে উঁকি দিল, গারো দেশের কথা। সে এক দুর্দান্ত গন্তব্য। নিচে ঘাস, উপরে মেঘ। এর মধ্যেই রয়েছে কিনা পাহাড়, গাছপালা, হ্রদ বা জলাশয়, নদী, পাখিদের কিচিরমিচির, স্নিগ্ধ হাওয়া, আরো কত কী! রাত হয়েছে অনেক। ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আর ভেবে কাজ নেই। এবার বাস্তবায়নের পালা।
যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। ভ্রমণের নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুম হয়নি রাতে খুব একটা। উশখুশ মন। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে যে সময়টা লাগে, ঠিক সে সময়টায় ঘুম ভাঙল মনে হয়। বিছানায় শুয়ে থাকার জো নেই, উঠতে হবে। ডে অফের দিন, সঙ্গে এক বন্ধু। দুজনে হলাম রওনা। মিরপুরের বাসা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে পৌঁছলাম মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের ময়মনসিংহ স্ট্যান্ডে। যাচ্ছি নেত্রকোনা। ৮টার মধ্যে বাসে উঠলাম। ৪ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। তবে যাত্রা এখনো বাকি, যেতে চাই বিরিশিরি। তাই ময়মনসিংহ-নেত্রকোনার রাস্তা ধরে শ্যামগঞ্জ মোড়ে এসে নামতে হলো। এরপর পূর্বধলা সড়ক দিয়ে দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরির উদ্দেশে যাত্রা। পথটা বেশ বন্ধুর। ভাঙাচোরা। কোথাও কোথাও পানি জমে থাকে, কাদাও প্রচুর। একবার তো রিজার্ভ করা সিএনজি থেকে নেমে রীতিমতো ঠেলা দিতে হলো! তবে ঠেলাঠেলির সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল যখন কংস নদের হাওয়া গায়ে এসে লাগল। যেতে পথেই পড়বে এ নদী। ছোট্ট সেতু। একটু দাঁড়ালাম। বর্ষায় যার পানি থই থই করছে। মেঘালয়ের তুরা পাহাড় থেকে বয়ে আসা নদীর খোলা হাওয়া খেতে খেতে আবারো রওনা হলাম। ভাবতে থাকলাম এর ইতিহাস। ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এ নদ কংসাই বা কংসবতী নামেও পরিচিত। ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগে তুরার কাছে গারো পাহাড়ে যার উত্পত্তি। কংস হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের এক নেতিবাচক ব্যক্তি। ভারতের উত্তর প্রদেশের মথুরায় তার রাজ্য হলেও বাংলাদেশে কংস একটি নদীর নাম। তবে সেই চরিত্রের সঙ্গে এ নদের মিল কোথায় তা জানা নেই। শেরপুর জেলার হাতিবাগার এলাকা দিয়ে নদটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উত্পত্তি স্থল থেকে শেরপুরের নালিতাবাড়ী পর্যন্ত এর নাম ভোগাই। এর পর থেকে কংস নাম হয়েছে, যা পরে সোমেশ্বরীর সঙ্গে মিলেছে। কংস ও সোমেশ্বরীর মিলিত স্রোত বাউলাই নদী নামেও পরিচিত। কংস তো দেখা হলো, বিরিশিরি দেখে এবার সোমেশ্বরীও দেখব। যেতে পথে ভারতের মেঘালয়ের সুন্দর সুন্দর পাহাড়ে চোখ আটকাবে। দুর্গম পথের যন্ত্রণা দূর করে দেবে এই মনোরঞ্জক দৃশ্য। সঙ্গে মেঘের খেলা করার দৃশ্যে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে বাধ্য যে কেউ।
পথেই দুপুরের খাবার সারা হলো। ঘণ্টা দুয়েক চলতে চলতে বিজয়পুরের সাদামাটির পাহাড় বা চীনামাটির পাহাড় ও নীল পানির জলাশয়ে পৌঁছলাম। খুব একটা বড় নয় পাহাড়, মিনিট তিনেকের মধ্যেই উঠে যাওয়া সম্ভব। ওপর থেকে মনে হবে যেন শিল্পীর আঁকা ছবি দেখছি। দূরে সবুজ টিলার ওপর ছোট কুঁড়েঘর চোখে পড়বে। প্রকৃতি যেন এখানে ঐশ্বর্যের ক্যানভাস। এই ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে যে ছবিই তুলুন না কেন, দারুণ আসবে। ফ্রেমিংও হবে বেশ। চাইলে হ্রদে শরীর ভেজাতেও পারেন। সেজন্য অতিরিক্ত জামাকাপড় সঙ্গে নিতে হবে। এখান থেকে চীনামাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে মিশে থাকা স্বচ্ছ জলাধারগুলো দেখতে চমত্কার। তবে বাস্তবতা হলো, একদিন হয়তো এ সৌন্দর্য থাকবে না। ব্যবহারের জন্য দিন দিন কেটে ফেলা হচ্ছে সাদা-নীলাভ চীনামাটির পাহাড়। তাই সময় থাকতে এটি সংরক্ষণ জরুরি। যেন আরো বৃহৎ পরিসরে পর্যটক আকৃষ্ট করা যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এই আকুতি থাকবে। পাহাড়ের গাছপালা, মেঘের লকোচুরি, দূরদৃষ্টিতে ফসলি জমি, পাখির কলতান শুনতে শুনতে এবার যেতে হবে ভিন্ন গন্তব্যে।

চীনামাটির পাহাড় থেকে একটু গেলেই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের চেকপোস্ট। সেখানে রয়েছে সোমেশ্বরী নদী। শেষ বিকালে নদীর সঙ্গে মিতালি হলে মন্দ কি! মাঝখানে নদী, তার খানিক দূরেই ভারত সীমান্ত। এ যেন অপূর্ব এক পরিবেশ। যখন গেছি তখন কয়লা তোলার কাজ হচ্ছিল না। কিন্তু প্রায় সবসময়ই স্থানীয় শ্রমিকরা এ নদীতে কয়লা তোলেন। পরে মজুদদারদের কাছে তা বিক্রি করেন। কয়লা তোলার দৃশ্য দেখতে পারলে ভালো লাগত। হয়তো আপনি গেলে দেখেও আসতে পারেন। মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে নেমে এসেছে এই সোমেশ্বরী নদী। যার আদি নাম ‘সমসাঙ্গ’। এ পাড়ের দৃশ্য তো দেখলাম, এবার মেঘালয় যেতে মন চাইছে। সঙ্গে পাসপোর্ট-ভিসা থাকলে চলে যেতে পারতাম। তাতে কী, সময় তো পড়ে আছে। যাব কোনো একদিন। দেখে আসব তুরা থেকে নেত্রকোনা। সে আশা নিয়ে এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এসেছে।

দুর্গাপুর উপজেলায় গেলে আরো ঘুরে আসতে পারবেন কমলা রানীর দীঘি, গারো পাহাড়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমি, সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি, টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ, সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী, রাশিমণি স্মৃতিসৌধ। তবে সেক্ষেত্রে একদিন নয়, অন্তত দুদিন প্রয়োজন ঘুরে দেখার জন্য। রাতে থাকার জন্য বিরিশিরি কালচারাল একাডেমিতে যোগাযোগ করতে পারেন অথবা নেত্রকোনা শহরে এসেও রাত কাটাতে পারেন। ঢাকা থেকে ট্রেনেও নেত্রকোনো যেতে পারেন। দিনে-রাতে ট্রেন যায় (দিনে বেলা ২টা ২০ মিনিটে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। রাত ১১টা ৫০ মিনিটে হাওড় এক্সপ্রেস। এছাড়া সন্ধ্যায় যায় মহুয়া এক্সপ্রেস)। তবে মহাখালী থেকে বাসে যাওয়া তুলনামূলক সহজ বলে মনে করি।

সৈয়দ ইফতেখার আলম,বাংলাদেশ

১০ই আগস্ট ২০১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.