পতিতা শব্দটা শুনলেই কেমন থমকে যেতে হয়, তাই না? তাৎক্ষণিক মনে হয় শব্দটা কি অশ্লীল! শব্দটা শোনার সাথে সাথে চোখে ভাসে অর্ধনগ্ন একটা নারী শরীর। চোখে,মুখে কড়া মেকআপ। হাত ভর্তি চুরি। সব আছে, তবু কেমন অসমাপ্ত সাজ। সাজটা পূর্ণতা পেত,যদি শরীরে পরিপাটি করে একটা শাড়ি পরা থাকতো। কিংবা সালোয়ার,কামিজের ওপর সুন্দর করে একটা ওড়না জড়ানো থাকতো। তখন একজন নারীর সাজে পূর্ণতা আসে।
কিন্তু ওরা পতিতা। নামটা একটা সাইনবোর্ড। বলার সাথে সাথে যেন মানুষ ধরতে পারে কাদের কথা বলা হচ্ছে। এই সাইনবোর্ড ব্যবহার করা নারীরাও বোঝে তাদের শালীনভাবে থেকে কোনো লাভ নেই। কারণ যেসব পুরুষ তাদের সাথে বিছানা শেয়ার করতে আসবে তারা তাদের বুকের,নিতম্বের মাপ দেখতে চাইবে আগে। অনেকটা গরু বাছাইয়ের মতো। কারো হয়তো শুকনো খটখটে শরীর ভালো লাগে। আবার কারো হয়তো নাদুসনুদুস মোটা শরীর। তাই ওরা এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রদর্শন করে। মাঝে মাঝে কাজের প্রয়োজনে ওদের সামনে দিয়েই আমার যেতে হয়। আমি আড়চোখে তাকাতেও সাহস পাই না। নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। ওদের ভালোভাবে না রাখতে পারার জন্য নিজের ওপর ঘেন্না হয়। তাই তাকাই না। টের পাই ওরা তাকায়। হিজাব পরা থাকে বলে হয়তো শ্রদ্ধার চোখে তাকায়। খুব ছোট মনে হয় তখন নিজেকে। আমি নারী, ওরাও তো নারী! একজন নারী জন্ম নিয়েই তো পতিতা হয়ে যায় না। তাকে পতিতা বানানো হয়। অনেক সময় নারীরা নারীকে পতিতা বানায়। অনেক সময় পুরুষরা নারীকে পতিতা বানায়। যে শেষ পর্যন্ত পতিতা হয়, সে একটা বড় সময় পর্যন্ত মানতেই পারে না যে সে একজন পতিতা। কত নারী এই জীবন মানতে পারে না বলে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কত নারী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মারা পরে। পতিতা হতে চায় না বলেই তো। অথচ সমাজ তাদের কতটা ঘৃন্য চোখে দেখে। সমাজের প্রয়োজনে বিলিয়ে দেয়া নারীকেই সমাজ সব সময় অপরাধীর কাতারে ফেলে রাখে। পতিতা পল্লীর অথবা যৌনকর্মীর আসলে কাজ কি! পতিতা পল্লী কতটা জরুরি আমাদের সমাজের জন্য? যদি জরুরি হয় তবে নারীরাই কেন পতিতাদের এত ঘৃনার চোখে দেখে? নতুন করে বলার কিছু নেই যে,একজন নারী কেন পতিতা হয়! আমরা সবাই এটা জানি, টাকার জন্য হয়তো কোনো বাবা অথবা মা মেয়েকে বিক্রি করে দেয়। প্রেমিক ভুলিয়ে প্রেমিকাকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। কাজ দেবার নাম করে এলাকার কোনো বিশ্বস্ত কাছের মানুষ পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু তারপর কি হয় তার খবর কেউ রাখে না। যৌনতা তো অশ্লীল কিছু না। এটা প্রয়োজন। এটা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলার নেই। সবাই আজকাল সবকিছু জানে। আমি বলতে চাই যৌনকর্মীদের কষ্টের কথা। এরা যৌনতা নিয়ে কাজ করে। বিনিময়ে টাকা পায় বলে আমরা জানি। কিন্তু আমরা কি খোঁজ রাখি এরা আসলে সত্যি ঠিকঠাক পারিশ্রমিক পায় কিনা! কারণ এরা তো নিজের শরীরটাকে বিলিয়ে দিচ্ছে। দশজন পুরুষ এসে এদের শরীর নিংড়ে সুখ নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। হয়তো নিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু কয়জন পুরুষ যাওয়ার সময় পারিশ্রমিক ঠিকমতো দিয়ে যাচ্ছে! অনেকের কাছে মনেও হয় না পারিশ্রমিক দিতে হবে। কারণ এ আর এমন কি! দু'জনেই তো সুখ পাচ্ছে। এমন যখন ভ্রান্ত ধারণা মনে পোষণ করে, তারা আর পারিশ্রমিক কি দেবে! কিন্তু আদৌ কি যৌনকর্মী কখনো সুখ পায়! কেউ কি ভেবেছে যৌনতা আর সুখ দুটো পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত! যা থেকে যৌনকর্মীরা সারাজীবনের জন্য বঞ্চিত। যারা ভালোবাসা পেয়ে আসে তাদের কষ্টটা বেশি। কারণ এরা দুটো জীবন আলাদা করতে পারে। আর যাদের জন্মই যৌনপল্লীতে,তারা তো ভালোবাসা কি বস্তু জানেই না। জন্মের পরে সাবালিকা হওয়ার আগেই তাদের কাজে নামিয়ে দেয়া হয়। ভীষণ কষ্ট থেকে আজ লেখাটা লিখলাম। খুব ইচ্ছে করে এদের একটা সুষ্ঠু, সুন্দর জীবন উপহার দিতে। নয়তো এমন কোনো ব্যবস্থা করে দিতে যাতে করে নির্দিষ্ট নিয়মে এদের কাজ গুলো সমাধা হয়। যেমন, নির্দিষ্ট একটা বয়সের আগে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া যাবে না। একদিনে কয়জন পুরুষ একজন যৌনকর্মীকে ভোগ করতে পারবে সেটা সম্পূর্ণ সেই নারীর ইচ্ছের ওপর নির্ভর করবে। পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট থাকতে হবে। এবং ভবিষ্যতের জন্য যেন কিছু সঞ্চয় হিসেবে রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। নইলে সারা জীবন কষ্ট করে শেষ বয়সে যখন শরীরে রোগ বাসা বাঁধবে তখন যেন সে তার নিজের টাকায় চলতে পারে। আর এমন কিছু যদি ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে যৌনপল্লী বলে কিছু থাকা উচিৎ নয়। আপাত দৃষ্টিতে কত সহজ মনে হয় কাজটা। আসলে কতটা কঠিন তা একজন যৌন কর্মীই জানে। ভালোবাসলেও তো দিনে এতবার শারীরিক মিলন করা যায় না,যতবার যৌনকর্মীরা করে। অনেক সময় ইচ্ছের বিরুদ্ধে এসব করতে বাধ্য করা হয়। ভালোবাসা ছাড়া যৌনতা অনেক বড় কষ্টের কাজ। সুতরাং সমাজ সেটা বুঝুক। সমাজের মানুষ যৌনকর্মীদের ঘৃনার চোখে না দেখুক। এটাই ওদের ছোট্ট চাওয়া। কারণ একবার যৌনপল্লীতে ঢুকে গেলে যেহেতু শরীরে সাইনবোর্ড একটা লেগে যায়। তখন আর সমাজের কাছে ওদের চাওয়া পাওয়ার কিছু থাকে না।
সালমা তালুকদার, বাংলাদেশ
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২০