করোনাভাইরাস নামে পরিচিত লাভ করলেও তার বৈজ্ঞানিক নাম কোভিড ১৯। তার জন্মতারিখ এবং জন্মস্থান নিয়ে নানাবিধ মতপার্থক্য থাকলেও সে বেজন্মা না। তবে তার জন্মসাল নিয়ে সবাই একমত হয়েছেন। তার জন্মসাল ২০১৯। তার জন্মতারিখটি অনেকটা বাংলাদেশের গ্রামের শিক্ষার্থীদের মতো। বাবা মা নয় গ্রামের স্কুলের কেরানি সাহেব নির্ধারণ করে থাকেন ফলে শিক্ষার্থীদের সঠিক জন্মতারিখ কখনো জানা সম্ভব হয় না। করোনাভাইরাসের জন্মস্থান আমেরিকা নাকি চীন সে বিষয়ে বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত। তবে জন্ম যেখানেই হোক তার বেড়ে উঠা চীন নামক রাষ্ট্রে। চীনের আলো বাতাসে বড় হয়ে আজ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। মাত্র পাঁচমাস বয়সী করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়েছে। তার ভয়ে বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রের বাঘা বাঘা সরকার প্রধান থেকে শুরু করে স্বৈরশাসক, যুদ্ধবাজ, সেনাসমর্থিত সরকার সবাই স্বেচ্ছায় প্রকারান্তরে ভয়ে ঘরে অবস্থান করছেন। বিশ্বে ধনী গরীবের পার্থক্য থাকলেও করোনাভাইরাস সবার সাথে সমান আচরণ করছে। সে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, স্পেনের রাজকন্যা, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী থেকে শুরু করে ফুটপাতের হকারকে পর্যন্ত আক্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তাকে ধ্বংস করার জন্য সমাজতান্ত্রিক, গনতান্ত্রিক, স্বৈরাতান্ত্রিক সব রাষ্ট্র একমত পোষণ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরির সুবাধে আমি ১৭ মার্চ থেকে ঘরে আছি। সরকারি ভাষায় যেটিকে বলা হচ্ছে হোম কোয়ারান্টাইন। প্রথম দিকে আনন্দে থাকলেও পরবর্তীতে আতংকিত হয়ে পড়েছি। অংকের হিসেবে আজ ২১ দিন। তিন বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামী স্ত্রী একসাথে ২১ ঘন্টা কখনো থাকা হয়নি অথচ আজ ২১ দিন পার করলাম ঝগড়াঝাটিছাড়া। অবশ্য ইচ্ছা থাকলেও ঝগড়াঝাটি করার উপায় নেই কারন রাস্তায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহল জোরদার করেছেন। তবে ২১ দিন ঘরে থেকে বুঝলাম আমাদের বউ, মা, বোনেরা বাসায় কত কাজ করে থাকে। অথচ আমি অফিসে বসে মনে করতাম এরা বুঝি বাসায় বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখে সময় নষ্ট করে। আজ কবির কথায় সত্যি হলো " সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে "।
আমরা যখন হোম কোয়ারান্টাইন থেকে নিজেদের জীবনরক্ষার চেষ্টা করছি তখন দেখছি আমাদেরকে ভালো রাখার জন্য সকাল বেলা ময়লাওয়ালা আধুনিক রাষ্ট্র যাদের নাম দিয়েছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী তারা ময়লা পরিস্কার করার জন্য আমাদের বাসাবাড়িতে আসছে। অথচ আমি অফিসের কাজ ফাঁকি দিয়ে ফাইল জমিয়ে এমনভাবে রেখেছি দেখে মনে হবে ময়লার ভাগাড়। পত্রিকার হকার সকাল বেলা আমার হাতে পত্রিকা তুলে দিয়ে পুরোদুনিয়ার খবর দিচ্ছে অথচ দেশ ও জাতির দুঃসময়ে আমি নিজের গরীব অসহায় আত্মীয় দূরে থাক পাশের বাসার খবরটি পর্যন্ত নিচ্ছি না। আমরা যাতে ঘরে থাকতে পারি সেজন্য পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডিসের কর্মীরা অফিস করছেন অথচ আমরা তাদের সুরক্ষার জন্য কোন উদ্যোগ নিচ্ছি না। যে পুলিশকে গালি না দিলে আমার পেটের ভাত হজম হয়না সেই পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে আজ নিজের জীবন বিপন্ন করে রাস্তায় অথচ আমি সরকারি চাকুরির সুবাধে এপ্রিল মাসের বেতনের সাথে বৈশাখী ভাতা পেয়ে মনের আনন্দে ফেসবুক চালিয়ে মানুষের সমালোচনা করছি এবং উপদেশ দিচ্ছি।
মধ্যবিত্ত পরিবারে সাধারণত সাত দিনের বেশি খাবার মজুদ থাকেনা। সবার পনের দিন হোম কোয়ারান্টাইন পার হতে চললো অথচ আমার মনে একবারও ভাবনা আসেনি দিন এনে দিন খাওয়া মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত মানুষগুলো কি খাচ্ছে বা কিভাবে খাচ্ছে নাকি না খেয়ে খাওয়ার ভান করছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে। আমি বাসায় বসে ডাইনিং টেবিলে পেটপুরে খাচ্ছি। মাঝে মধ্যে খাওয়া বেশি হলে পানীয় পান করছি আর গাল দিচ্ছি গার্মেন্টস শ্রমিকদের যাদের তিন মাসের বেতন বকেয়া এবং চাকরি হারানোর ভয়ে পায়ে হেঁটে ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছেন। অথচ আমার বেতন ভাতাদি একাউন্টে জমা হতে একদিন দেরি হলে আমি গালমন্দ করি প্রতি ঘন্টায়।
আমার অসুস্থ বাবা মা কে দেখতে আটমাস গ্রামের বাড়ি যাবার সময় পায়নি নানা অজুহাতে। অথচ আজ আমি ২১ দিন ঘরে থেকে বের হতে পারছিনা কোন অজুহাতে। ঘরে বসে টেলিভিশনে নাটক সিনেমা আর খবর দেখে সময় পার করছি অথচ একবারও খবর নিতে মন চাইনি নিজের কর্মস্থল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। তাদের সঙ্গে কথা হলে সবসময় বলতাম তোমরা আমার সন্তানের মতো। আজ এতটা স্বার্থপর হয়ে গেলাম যে একবার ভাবিনি তাদের টিউশনি বন্ধ, তাদের মেসের বুয়া আসছে না, তাদের রুমে টেলিভিশন নেই। তারা বেঁচে আছে নাকি টাকার অভাবে ছুটির ঘন্টার শিক্ষার্থীর মতো....। তার মেস ভাড়া কিভাবে আসব। ভাবছি এতকিছু ভাবার কি দরকার, ভাবার জন্য সরকার আছে।
ছোট বোন জামাই মস্তবড় করপোরেট চাকরিজীবি। ভাগ নেটা পড়ুয়া ছাত্র। এসময়ে তার পড়ার চাপ কমাতে বোনকে ফোন করে বলেদিয়েছি আপাতত টিউটরকে আসতে না করে দিতে। দুই মাস বন্ধ রাখতে। অথচ আমার কেন মনে পড়েনি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ নিজের লেখাপড়া ও থাকা খাওয়ার খরচ যোগাড় করেন টিউশনির টাকার বিনিময়ে। অনেক শিক্ষার্থী টিউশনির টাকা জমিয়ে গ্রামের বাড়ি পাঠান অসুস্থ বাবা মায়ের ঔষধ কিনতে অথবা ছোট ভাই বোনের পড়াশোনার খরচ যোগাতে। বলুন এসব চিন্তা আমার মাথায় আসবে কি করে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বাবা প্রতিমাসে খরচের তুলনায় অনেক বেশি টাকা পাঠাতেন।
শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় খোঁজ নিয়ে দেখলাম বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা বন্ধ। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য রোগী ভর্তি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই আপাতত বেশি কিছু ভাবছি না, যদি আবার হার্ট অ্যাটাক করে বিনা চিকিৎসা মারা যায়। করোনাভাইরাসের চেয়ে মৃত্যু আতংক বেশি তাড়া করছে। এখন যে কোন ভাবেই মারা গেলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছি সন্দেহে লাশের গোসল, জানাযা, কবর কোনকিছুই ধর্মীয় রীতিনীতিতে হবে না ভাবতেই কেমন বুক ধড়ফড় করে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিফিংয়ে জানালেন অনেকে করোনাভাইরাস মোকাবেলা করার যুদ্ধে যোগদানের জন্য শর্ত আরোপ করেছেন। এতদিন শুনেছি প্রেম আর যুদ্ধ কখনো শর্ত দিয়ে হয়না। করোনাভাইরাস তুমি আজ সে জানাকে ভুল প্রমাণ করে দিলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন করোনাযুদ্ধেযারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকবেন প্রেরণা হিসেবে তাদেরকে বিশেষ প্রণোদনা সহায়তা দেওয়া হবে। তিনি সংশ্লিষ্টদের নামের তালিকা তৈরি করতে বলেছেন। ভয় হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং রাজাকারের তালিকার মতো ভূয়া তালিকা তৈরি হয় কিনা। তালিকা তৈরির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা নিজের শশুর, শাশুড়ী, শালা, শালী, গার্লফ্রেন্ডদের তালিকা তৈরি করেন কিনা।
সত্যি কথা বলতে আমার গুজবে কান দেওয়ার অভ্যাস আছে। অভ্যাসবশত করোনাভাইরাস নিয়ে গুজবে কান দিয়ে দুইশত টাকা দিয়ে দুইটি থানকুনি পাতা কিনে খেয়েছি। গ্রাম থেকে এনে গোমূত্র পান করেছি। তুলসি পাতা নিয়মিত খাচ্ছি। এক সাধু বাবার পরামর্শে মন্ত্রপড়ে গোপনে নিজের অন্ডকোষে তিনটি টোকা দিয়ে রেখেছি। বিজ্ঞানের উপর আস্থা আছে বলে কয়েক মিনিট পর পর সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া চালিয়ে যাচ্ছি। মাঝে মধ্যে চা পান করছি। ভুলেও নাক, চোখ, কান এবং মুখে হাত দিচ্ছি না। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে নিয়মিত ধর্মীয় নির্দেশনা মেনে চলছি।
টেলিভিশন চালু করে বারবার বানিজ্যমন্ত্রী মহোদয়কে খুজতেছি। উনি বলেছিলেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না, উনাকে পেলে মুখে মাস্ক লাগিয়ে তিনফিট দুরত্ব বজায় রেখে একবার বাজার থেকে ঘুরে আসতাম। জাপানের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা যিনি বাংলাদেশে কাইশ্যা নামে পরিচিত। করনোভাইরাসে আক্রান্ত হয় মারা গেছেন। তার আত্মা মনে হয় মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেহে ভর করেছেন। মন্ত্রী মহোদয় বল্লেন কেউ তাকে কোন সহযোগিতা করেছেন না, তাহলে আপনার পদত্যাগ করাই শ্রেয়। করোনাযুদ্ধে সবার সহযোগিতা ছাড়া আপনি একা জয়লাভ করতে পারবেন না। তবে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিবো কারন তিনি সারাদেশে অঘোষিত লকডাউনের সাথে তাঁর দলের অতিকথন মন্ত্রী মহোদয়দের মুখের শাটডাউন করেছেন বলে। তাকে মাদার অব হিউমিনিটি বা মানবতার মা বলা হয়। সত্যিই তিনি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মমতাময়ী মায়ের ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর বক্তব্য এবং পদক্ষেপে মনে হয়েছে তিনি দলমতের উর্ধ্বে উঠে একজন সত্যিকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠেছেন। সত্তরউর্ধো বয়সী একজন প্রধানমন্ত্রী ভেঙে না পড়ে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যেভাবে জনগণকে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তা মনে রাখার মতো। তিনি মমতাময়ী মা তাই হয়তো সকল সন্তানের মঙ্গল কামনা করছেন। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি এখন মানবিক প্রধানমন্ত্রী।
যে সকল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান নিজ, দলীয় অথবা রাষ্ট্রের উদ্যোগে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং বিভিন্ন রকমের সাহায্য সহযোগিতা করছেন তাদেরকে অজস্র সালাম জানাই। আপনারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক। আপনারা করোনাযুদ্ধের সৈনিক। আপনাদের হাত ধরেই আসবে কাঙ্খিত বিজয়। দেশ থেকে নির্মুল হবে করোনাভাইরাস। জাতির হৃদয়ে আপনারা থাকবেন চীরঅম্লিন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনাদের মতো সাহসী মানুষদের হাত ধরেই এসেছিলো বিজয়। আপনাদের বিজয়ের সাথে সাথে আগামী প্রজন্মের জন্য প্রস্তুত হবে এক নতুন বাংলাদেশ।
কাপুরুষের মতো ঘরে থেকে ২১ দিন পার করলাম অথচ জাতি এবং রাষ্ট্রের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। তবে কথা দিলাম করোনাভাইরাস দূর হলে অফিসের কাজে ফাঁকি দিবোনা, অসুস্থ বাবা মা কে দেখতে প্রতিমাসে গ্রামের বাড়ি যাবো, বউ বাচ্চাদের বেশি সময় দিবো।
করোনাভাইরাস দূর হয়ে এক নতুন সূর্য উঠবে। সেই নতুন সূর্য দেখার অপেক্ষায় হোম কোয়ারান্টাইনে আছি।
মোঃ হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী
সহকারী রেজিস্ট্রার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা
১০ই এপ্রিল ২০২০