ইতিহাস সাক্ষী-সত্যই তাই।একশো বছর আগে-কি ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেছিল এই জায়গায়ে?১৯১৯ সালের কথা মনে আছে তোমাদের?এই তো সেদিন- বৈশাখীর ঠিক আগেই গুরমিত ও তার বাবা বাগে গেছিলেন বন্ধুদের সাথে। আর ফেরেন নি।আর যাই হোক –ভারতের স্বাধীনতা তাতে আটকে থাকেনি।কিন্তু গুরমিতের মা আর কখনও কথা বলেননি।চোখের জল গড়াতে গড়াতে শুকিয়ে গেছিল, বেশভূষা এ্লোথেলো হয়ে গেছিল চিরতরে।
১৯১৯ সালে পাশ হয়েছিল রাওলাট অ্যাক্ট অথবা ব্ল্যাক অ্যাক্ট ।যত গন্ডোগোল ছিল তো ওই ভাইসরয় চেমসফোরড এর রাওলাট অ্যাক্ট নিয়ে।ব্রিটিশ লেজিসলেটি্ভ এসেবম্লী আইন পাস করলো যে রাজনৈতিক বন্দীদের বিনা জিজ্ঞাসাবাদে জেলে আটক রাখা হবে অনন্তকালের জন্য।সারা দেশে অশান্তি,ভারতীয়রা নিজেদের খুব অসহায় বোধ করতে লাগলেন।এই আইন অনুযায়ী-ভারতীয়রা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন।খবর কাগজের অপর আইন কড়া হল।চারিদিকে ধরপাকড় শুরু হোলো।ব্রিটিশদের নাজেহাল করতে লাগল পাঞ্জাবের সংগ্রামীরা- যাদের গোরারা আতঙ্কবাদী বলে চিনহিত করত। স্বধীনতা সংগ্রামীদের জীবন হল ওষঠাগত।সবদিক দিয়ে সাধারন জীবন বিপরযস্ত। পুলিশের এত সাহস বাড়ল যে তারা লোকের বাড়ী হানা দিয়ে সংগ্রামীদের ধরতে সুরু করে দিল।
এই কালো আইনের প্রতিবাদে গান্ধীজি ছিলেন।এমন কি জিন্নাহ সাহেবও লেজিসলেটি্ভ এসেবম্লী থেকে অবসর নিলেন।সারা ভারতে যখন উত্তাল তখন ঠিক হল ৬ই এপ্রিল সারা ভারত জূড়ে ধর্মঘট হবে। আর যায়ে কোথায়!বৄটিশদের অত্যাচারে মানুষ পাগল প্রায়ে।ব্রিটিশরা ভয় পেয়েছিল।বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারত থেকে সৈন্য ও শস্য- এ দুই এর সাহায্য ছাড়া জেতা অসম্ভব ছিল।তবু তারা তাদের প্রতিজ্ঞা রাখে তো নি বরং অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
অশান্ত পাঞ্জাবে পুলিশ ডাক্তার শৈফুদ্দীন কীচলু এবং ডাক্তার সত্যপাল কে চুপিচুপি নিয়ে গেল ধরমশালা – এত বড় নেতা, তবু কিছু করা গেল না।তাই নিরস্ত্র হাজার দুইমানুষ জালিয়ানওয়ালাহবাগে এসেছিলেন সমকালীন রাজনৈতিক কথা আলোচোনা করতে।কেউ এসেছে গ্রাম থেকে, কেউ পাশের মাঠে গম চাষ করছিল, কেউ বা স্বর্ণ মন্দিরে এসেছিল পুজা পাঠ করতে-কেউ ই জানত না তাদের ভবিষৎ।গ্রীষ্ণের দাবদাহ থেকে একটু জিরিয়ে নিতে জালিয়ান ওয়ালার বাগে গিয়েছিলেন।তারপরের ঘটনা তাদের কাছে কোনও ব্যাখ্যা রেখে যায়নি।অমৄতশ্বর জ্বলেছে, রাগে ও অপমানে।ভারত জ্বলেছে।বিশ্ব জ্বলেছে।
পথচলতি মানুষের উপর চাবুক চালাচ্ছে,নাকখত দিচ্ছে প্রতিবাদীরা।আর,আর কতদিন চলবে এই অমানবিক অত্যাচার?ভয়, আতঙ্কে দিন কাটছে শত শত অসহায় মানুষের।কে তাদের পরিত্রান দেবে?কে দেখাবে পথ?কে দেবে তাদের মুখে একটু খাবার? তাই স্বর্ণ মন্দিরের লঙ্গর খেয়ে অম্রিতশরের লোকজনের দিন কাটছে।
কী সরুগলি।দুটি লোক এক সাথে হাঁটা যায়ে না।সেই গলি দিয়ে এগিয়ে এল নিশব্দ মৃত্যু।পাঞ্জাবের শান্তি বজায় রাখা যে তাঁর দায়িত্বে ছিল, সেই জেনেরাল ডায়ার ৯০জন স্বশসত্র সেপাহী নিয়ে বাগানের রাস্তা বন্ধ করে বিকেল ৪.৩০ নাগাধ সাধারন মানুষের ওপর আক্রমণ করলেন।
আহত ও নিহতর সংখ্যা বৄটিশদের পাঠান তথ্যর অপর ভিত্তি করে দেখা যায়- অগনিত।
ভাবতে পারেন-মহিলা,শিশু, ছোটো ছেলে-মেয়ে, মা,বাবা,কাকা,জেঠা,দাদু,দিদা সকলে বসে আছে-শুনছে ভাষণ।বেশির ভাগ লোক ই জানে না কিসের বক্তৃতা চলছে।বাচ্ছারা খেলছে।নির্ভয়ে গল্প করছে কিছু মহিলা-খবরের আদান-প্রদান করছে।চারিদিক পাচিলে ঘেরা এক ফাকা
মাঠ।মাঠের বাঁদিকে মাঠের পাশে এক পাত কুয়া।অনেকেই সেখান থেকে জল তুলে খাচ্ছে।
হঠাৎ চারিদিক কাঁপিয়ে সৈন্যদের দল বাগানের ছোটো দরজা বন্ধ করে হাটুগেরে বসে চিৎকার করা আদেশ শুনে বন্দুক তাক করল।
আকাশ বিদীর্ণ কন্ঠস্বর শুনে চমকে তাকানোর সুযোগও জনতা পায়েনি।গুলির শব্দ ধ্বংস ডেকে আনল।লুটিয়ে পড়ল শয়শয় মৃতদেহ ।
আতরকিতে ছুটোছুটি করতে শুরু করল নিরস্ত্র মানুষগুলি।হায় রে বিধাতা!কি রঙ্গ তোমার।কানভেদ করা গুলির আওয়াজ- লাল রক্তের বন্যা-তরতাজা জীবনগুলি মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল।একের পর এক- মৃতের পাহাড় ।দুধের শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে মা ঝাঁপ দিলেন পাতকুয়োতে। সেই দেখে অন্যরাও ঝাঁপ দিলেন। চিৎকার থেমে এল।রক্তিম সন্ধ্যের কোলে ডোলে পড়লো রক্তের ধারা।
বুটজুতোর শব্দ তুলে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে গেল ব্রিটিশ সৈন্য।‘ব্লাডি ইন্ডিয়ানস’ বলে গেলেন জেনেরাল ডায়ার।
এরপর যা হল তা ভারতের ইতিহাসে লজ্জার ইতিহাস লিখল ব্রিটিশ । সারা বিশ্ব স্তব্ধ । বিশ্বযুদ্ধ প্রায় নগ্ন করে দিয়েছে ইয়িরোপের দেশগুলো কে।জালিয়ানওয়ালা বাগ লিখল বৃটিশের বর্বরতা ও অসভ্যতা । জেনেরাল ডায়াররের বিচারে অবিবেচক ডায়ার কে ধিক্কার জানান হল, বদলি করে দেওয়া হল।ধিক্কারে ডায়ার কে লজ্জিত করা যায়ে নি।স্বয়ং চার্চিল এই ঘটনা কে তিরস্কার করেন।
বৃটিশ সরকার এর নাইট উপাধি পাওয়া এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি লজ্জায়ে মর্মাহত হয়ে স্যার উপাধি রাজা জর্জকে {পঞ্চমকে} ফিরত দিলেন।উপহার ফেরত নিতে রাজা জর্জকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। সেদিন কবিগুরু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কলমের জোড় বন্দুকের থেকে বেশী।নিশব্দে ধিক্কার জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছিলেন খবরের কাগজে।
উধম সিংহ কে মনে পড়ে?শহীদ উধম সিং?মনে না থাকারই কথা...ভগত সিং এর শিষ্য ছিলেন।
“মাইকেল ও ডায়ার” ছিলেন পাঞ্জাব প্রভিন্সের গভরনর।তার সময়ে জেনেরাল ডায়ার এই মর্মান্তিক গনহত্যা করেন।ছোটো ছেলে কোনো ভাবে বেঁচে যায়-পালিয়ে জায়ে- বুকে জড়ো হয়ে থাকে দুঃখের সাগর।শুধু পরিকল্পনা চলতে থাকে।এক দশকের মধ্যে যখন ভগত সিংহ কে ফাঁসি দেওয়া হল এবং গান্ধী নিরব রইলেন তখন উধম সিংহ ঠিক করে নিলেন এবার সে কি করবেন। কেউ তো প্রতিবাদ করুক।১৯৪০ সালে লন্ডন ওয়েস্ট মিনিশটারে উধাম সিংহ মাইকেল ও ডায়ারকে গুলি করে মারলেন।শান্ত উধম ধরা দিলেন।প্রতিহিংসার জ্বালা মিটল । প্রনাম জানালেন সেই অতৃপ্ত আত্মাদের উদ্দেশ্যে।
উধম সিংহর বিচার হল লন্ডনে। উধম সিংহ তার বক্তব্য রাখলেন ইংরাজীতে।কেঁপে উঠল বিচারালয়ের ব্রিটিশ শিক্ষিত মহল।তিনি জানালেন ভারতের গরিব মানুষের দুঃখ।গরীবীর কারন ব্রিটিশ শাসন ও শোষোণ। উধম সিংহর ফাঁসী হল।তরতাজা প্রান দিয়ে কত উধম, হারজিত, গুরজিত, ভাগতের প্রানের প্রতিশোধ নিল উধম। সেলাম তোমায় উধম।
স্বাধীনতার পর ১৯৫২-৫৩ প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু স্মৃতিসৌধ নিরমান করে বাগের শোভা বর্ধন করলেন। পাতকুয়ো বাঁধিয়ে সুন্দর করলেন।একটি মিউজিয়াম তৈরী হল। তবে আজ ও সেখানে হাজার হাজার মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে যায়ে।
কান পেতে শুনলে কান্না শোনা যাবে।দেয়ালে গুলীর দাগ রয়েছে।চারিদিক বদ্ধ এক উদ্যানে এত নৃশংস হত্যা ভারতে কম হয়েছে।
সবচেয়ে চমকে দেবার মত ঘটনা ঘটল মিউজিয়াম এর ভিতর- অজানা তথ্যে মনটা বেশী ঝোঁকে-
অবাক হয়ে পড়লাম, জানলাম আর আলাপ না করে পারলাম না-
আবার বাঙ্গালী-প্রাণ ভরে গেল স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প জেনে-
হুগলীর দশঘড়ার মুখারজী দের কথা শুনেছেন? জানেন কি?আরে একদম বাঙ্গালি
পরিবার-ঘটি-আজ ১০০ বছর ধরে জালিয়ানওয়ালা বাগের রক্ষানাবেক্ষন করছেন ।
এবার তাদের গল্প বলি শুনুন...
১৯১৯ সালে জাতীয় কংগ্রেস নেতা মদন মোহোন মাল্ভিয়ার অনুরোধে ষষ্টী চরণ মুখারজী হোমিওপ্যেথি ডাক্তার অমৃতশরে আসেন কংগ্রেস এর মিটিং এর জায়েগা ঠিক করতে । বৈশাখী বলে এশেছিলেন মন্দিরে।সভা জালিয়ান অয়ালা বাগে আছে জেনে সেখানে গিয়ে বসেছিলেন। রাখে হরি মারে কে?বাঙ্গালি গুলির শব্দে ঝাঁপ দিয়ে সভায়ে বক্তৃতা দিছিলেন যে নেতা- সেই ডায়াসের তলায়ে ঢুকে ছিলেন।হাহাকার,গুলির শব্দ,চিৎকার কান্না শুনেও বেরোতে পারেন নি, কিন্তু জেনেরাল ডায়ার সৈন্য নিয়ে বেড়িয়ে যাবার পর আহতদের সেবা করতে শুরু করেন।
১৯১৯ সালে ষষ্টী চরণ মুখারজী অমৃতসর কংগ্রেস অধিবেশনে আর্জি পেশ করলেন যে এই জমি শহীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হোক। রেসুলুসান পাশ হোল ।জমির জন্য পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করে জমি কিনে ষষ্টী চরণ ট্রাস্টের সহকারি হয়ে অমৃতসরে রয়ে গেলেন।হয়েত সেই ভয়ংকর হাহাকার তাকে আটকে রেখেছিল ।১৯৬২ সালে ষষ্টী চরণএর মৃত্যুর পর তার ছেলে এবং এখন তাঁর নাতি সুকুমার মুখারজি দেখাশুনা করেন।তিন পুরুষ ধরে তারা যত্ন করে চলেছেন ভারতের ইতিহাসের এক জলন্ত নিদর্শন কে।
সুযোগ হয়েছিল একদল প্রাণোচ্ছল ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে জালিয়ানওয়ালা বাগ বেড়াতে যাওয়ার।শুধু বেড়ানো হলো যে তা নয়ে, শ্রদ্ধা জানালো হলো, বিদ্যালয়ে ফিরে এসে শতবর্ষে জালিয়ানওয়ালা বাগ এর ওপর নাটক করা হল।
সাধারন নাগরিক হয়ে যুগান্তকারী ঘটনার উদ্দেশ্যে এটুকু শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার গল্প শেষ করলাম।
শমিতা চক্রবর্তী
শিক্ষিকা-ই্নডিয়ান স্কুল আলগুবরা
সমাজ বিজ্ঞান,মাস্কাট
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
২৬শে এপ্রিল ২০২০