নিজের স্ত্রী-ছেলে ওরাই এখন আমার সব। শরীরের যত্ন নেবার কথা ওরা না বললেও, ওরাই আমার যত্ন নেয় সাড়া বেলা। যেটুকু নিজে অবহেলা করি, সেটিও যেন ওদের দেখা শোনা করার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেছে।
পুরো পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস যে ভাবে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে, এতে জানি না কে কখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। আমিও যে বাঁচবো সেই নিশ্চয়তা নেই। তাই নিজের সম্পর্কে কিছু বিষয় লিখে রাখার ইচ্ছে থেকে আমার বর্তমান এই আত্মকথন লেখার পরিকল্পনা-বাস্তবায়ন। লেখাটি লিখে সম্পন্ন করতে পারলে, আমি বেঁচে না থাকলেও কেউ একজন অন্তত আমার সম্পর্কে মনে করবে লেখাটি পড়ে। লেখার বিষয়টি আমার একান্ত ব্যক্তিগত তাই আমার লেখা অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে। সবার সব কিছু ভাল লাগবে তাও কিন্তু নয়। তবে লিখতে শুরু করেছি। কিছুটা হলেও শেষ করতে চাই। এর মান গুন সব বিচার হবে আপনার পড়ার মাধ্যমে। কষ্ট করে হলেও পড়ার অনুরোধ করছি।
যে কারণে আমি প্রবাসে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম
# আমার আত্মকথন ----১
১৯৮৯ সনের কথা। সময়ঃ- অনুমান সকাল দশটা। আমাদেরই এলাকায় ( নাগরীতে) অনুষ্ঠিত এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঞ্চালন করছিলাম। মঞ্চে বসা ছিলেন তৎকালীন সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডাকসু-র) ভিপি আক্তারুজ্জামান (প্রধান অতিথি), ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, কন্ঠশিল্পী (বিশেষ অতিথি), আমার বড় ভাই চিত্ত ফ্রান্সিস রিবেরু, বিশিষ্ট সংগঠক (বক্তা), সংগঠনের সভাপতি-চন্দন জে. গমেজ সহ আরো কয়েকজন।
অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল ভাওয়াল খ্রিস্টান যুব সমিতি। আমি তখন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক। অনুষ্ঠান স্থল ছিল নাগরী সেন্ট নিকোলাস হাই স্কুল এর হোস্টেল মাঠ।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী যথা সময়েই অনুষ্ঠান শুরু হল। অনুষ্ঠানটি ছিল, আন্তঃ ভাওয়াল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। মূল অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল বক্তব্য পর্ব। এক জনের পর একজন বক্তা হাতের ঘড়ি দেখে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। সামনে ছিল অনেক শ্রেুাতা। তাদের বেশীর ভাগ শ্রেুাতা ছিল মহিলা এবং অল্প বয়সী ছাত্র-ছাত্রী। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সেখানে আমারও বক্তব্য দেবার কথা। সেভাবেই বক্তাদের তালিকা করা হয়েছিল। তালিকা যেহেতু আমার হাত দিয়েই হয়েছে তাই সবটাই জানা ছিল আমার জানা। তাছাড়া সঞ্চালক হিসেবে তালিকার একটি কপিও তখন টেবিলের উপর আমার চোখের সামনে রাখা। পূর্ব বক্তাদের বক্তব্য শেষ হলে এক পর্যায় আমার বক্তব্য দেবার সময় ঘনিয়ে এলো।
পুরো অনুষ্ঠান পরিচলনার দায়িত্বে আমার সাথে ছিল তখন সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক, নাম সুবোধ সি গমেজ। মঞ্চের সামনে এক পাশে লম্বা এক কাঠের বেঞ্চে বসে অনুষ্ঠান সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করছিলাম আমরা দুজন। শুরুতে আমি একা থাকলেও যখন আমার বক্তব্য দেবার সময় ঘনিয়ে আসছিল তখন আমার পাশে এসে বসলো সংগঠনের সহ-সাধারণ সম্পাদক সুবোধ সি গমেজ। তাকে ভঙ্গু এক অযুহাত দেখিয়ে বললাম, আমি বক্তব্য দেবো না। সে আমার কথা শুনে ধমক দিয়ে বলল, যান, বক্তব্য দিবেন না কেন? ফাইজলামি পাইছেন? আমাদের দুজনের আন্তরিক সম্পর্কের কারণে সে একটু ধমকিয়ে কথা বলছিল। তাছাড়া আমরা দুজনে সম্পর্কে বিয়াই হই। যে কারণে অধিকার খাটিয়েই ধমকিয়ে বলা। সময় যখন আরো ঘনিয়ে এলো তখন আমি সহ-সম্পাদক সুবোধকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে টয়লেটে যাবার নাম করে সেখান থেকে উঠে দূরে স্কুল মাঠে চলে গেলাম।
যাবার একটু পরেই শুরু হল মাইকে আমার নাম ঘোষণা দেওয়া, ”এখন বক্তব্য রাখবেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক” বলেই আমার নাম বলছিল। প্রথম সহ-সাধারণ সম্পাদকের কন্ঠ। এরপর ঘোষণা দিতে শুরু করলো অপরিচিত এক মেয়ে কন্ঠ। মাইকে অপরিচিত মেয়ে কন্ঠে আমার নাম ঘোষণা করতে শুনে আমি তো অবাক। কে এই মেয়ে? যতবারই শুনছি ততই যেন দেখার আগ্রহ বাড়তে থাকে। কে হতে পারে এই মেয়ে? মেয়ে কন্ঠ আমাকে আকৃষ্ট করলে কি হবে? আমি কোন ভাবেই তার আহবানে সাড়া দেবো না স্থির করলাম। কারণ গেলেই যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমাকে বক্তব্য দিতে হবে।
এমন সিদ্ধান্তের পিছরে কারণ ছিল আমার বড়ভাই সেই অনুষ্ঠানের বক্তা হিসেবে মঞ্চে বসা। বড়ভাইয়ের সাথে সেই সময় আমার আদর্শ বা নীতিগতভাবে বনাবনি ছিল না। তাই সে যেখানে থাকবে সেখানে আমি নিজেকে কোন কিছুতে জড়াবো না বা উপস্থাপন করবো না এমন এক প্রতিজ্ঞা করেছিলাম নিজের সাথে। কেউ যেহেতু বিষয়টি জানতো না তাই আমাকে ওরা ভুল বোঝার সুযোগ পেল তখন। আমি নীরব থেকে কাল ক্ষেপন করার চিন্তা করেছি।
বারবার মাইকে আমার নাম ঘোষণা করতে শুনে মাথায় রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল যেন। তাই দূরে স্কুল মাঠে গিয়ে বসে একাই তামাশা করছিলাম। সেখানে তখন আমাকে যারা দেখেছে তারা সবাই বলছিল, এই, তোমাকে ডাকছে মাইকে তুমি এখানে করছো কি? অনুষ্ঠান স্থলে যাও না কেন? আমি তাদের কিছু বুঝতে না দিয়ে বলছিলাম, এতক্ষণ মাইকে কথা বলে আমার গলা ব্যথা হয়ে গেছে, তাই এখানে বসে বিশ্রাম করছি। তাই আপাতত বাদ দিলাম যাওয়া, এখন বক্তব্য দেব না।
যখন আমার সেখানে যাবার আশা ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী বক্তার নাম ঘোষণা করা শুরু করলো তখন একপা দুই পা করে এগিয়ে গেলাম অনুষ্ঠান স্থলের দিকে। যাবার পর সংগঠনের প্রায় সকল সদস্য আমার সাথে রাগারাগি করতে শুরু করে দিল। সবার রাগান্বিত চোখ দেখে চুপ করে আমার সিটে পুনরায় ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার স্থান দখল হয়ে গেছে। বেঞ্চে দু’জন বসা। ওদের দুজনকে দুদিকে ঠেলে মাঝখানে আমার আগের সিটে বসার চেষ্টা করলে পাশে বসা মেয়েটি অপরিচিত এক ছেলের এমন আচরণে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলো। আমি বসাতে তাদের বসতে চাপাচাপি হচ্ছিল, তারপর আবার অপরিচিত একজন ছেলে তার গা ঘেষে বসছে, বিষয়টি এমনিতেই অসহ্যকর। তাই বিষয়টি সহ্য করতে পারছিল না কোনভাবেই সে। বসেই ওর সাথে ফিসফিস করে কথা শুরু করে দিলাম। একটু পর দেখি সেখানে সামনে বসা অনেকেই আমাদের দিকে চোখ বড় করে ঘনঘন তাকাতে শুরু করেছে।
তাকিয়ে থাকার কারণ, পাশে বসা মেয়েটিকে আমি সরাসরি প্রশ্ন করলাম এই তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? থাকো কোথায়? তোমার এত মিষ্টি কন্ঠ শুনে তোমাকে না দেখেই যে তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তোমাকে দেখে তো আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তোমাকে বিয়ে করতে চাই। সামনে বসা আমার বড় বৌদিকে দেখিয়ে বললাম, রাজী থাকলে ঐযে সামনে বসা, তাঁর সাথে যোগাযোগ করো। তুমি সম্মতি দিলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো কিন্তু আজই। সেখানে বসে কোন কিছু না বলেই সরাসরি আমার এমন কথা বলার পর সে থরথর করে কাঁপছিল। তারপর তো অনেক কথা।
আমাদের সামনে উচু বেঞ্চের উপর তখন মাইক রাখা। মাইকটি ছিল অন করা। অন থাকায় আমাদের সব কথাই বাইরে চলে যাচ্ছিল অর্থাৎ সবাই আমার কথা শুনছিল বলেই তাকিয়ে দেখছিল আমাদেরকে। সে সময় আমার সরাসরি এমন কথা শুনে তো দেখছিলাম মেয়েটি পুরো লাল হয়ে যাচ্ছিল। ও তখন সম্ভবত ডিগ্রীর ছাত্রী আর আমি অনার্স পরীক্ষার্থী ছিলাম।
# ক্রমশ....
পি.আর. প্ল্যাসিড জাপান
১৪ই জুন ২০২০
# ক্রমশ....
পি.আর. প্ল্যাসিড জাপান
১৪ই জুন ২০২০