কয়েক সপ্তাহ কেটে গেলো। ফার্মগেইট এলাকায় গেলেও সাধনপাড়া মেয়েদের সেই হোস্টেলের দিকে আর পা বাড়াই না। নিজের ক্লাস শেষ করে আগারগাঁও চক্ষু হাসপাতাল অর্থাৎ লায়ন্স ভবনে গিয়ে দৌঁড়ে এসে আবার টিউশনীর ঘরে হাজিরা দেওয়া আমার জন্য তখন অনেকটা ছিল বড় ধরনের দায়িত্ব পালন করা। লায়ন্স ভবনেই ছিল তখন আমাদের লিও ক্লাবের প্রধান কার্যালয়। প্রতি বুধবার যেতাম অফিসে। সেখানে গেলে ঢাকা শহরের বিভিন্ন লিও ক্লাবের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা হতো। সেখানে যাওয়ার কারণেই আমাদের ক্লাবের মার্কিং এগিয়ে যেতো।
যে সময়ের কথা বলছি, তখন একটা বাচ্চা পড়িয়ে দুইশ থেকে সাড়ে তিনশ টাকা মাসে বেতন পাই। এরমধ্যে ভর্তি হলাম ওয়াইজ ঘাট বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে। সেখানে গিটার শিখি। প্রতি শুক্রবার সকালে গিটার ক্লাস করে সেখানেও একটা গ্রুপ মেনটেইন করতে শুরু করি। শুক্রবার গিটার ক্লাসের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে ওয়াইজঘাট বুলবুল ললিতকলা একাডেমী চত্বরে দুপুর গড়িয়ে যেতো গ্রুপের সবার সাথে আড্ডা দিয়ে। কখনও আবার কাছেই বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ভ্রমণ ছিল টসটস করা যৌবনের আনন্দঘন মুহূর্ত কাটানোর উল্লেখযোগ্য সময়।
এতসব করে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম বলা যায়। এতকিছু করার পর প্রেম করার বাড়তি ঝামেলা একদম মাথায় আসছিল না তখন আমার। তবে একটা কাজ আমি তখন করেছি, কাজটি ছিল এমন যে, প্রায় প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সি-তে অলিখিত একটা আড্ডা হতো। এ বিষয়টি ঝড়ের বেগে এসে ঝড়ের বেগে আবার চলেও গেছে আমার জীবন থেকে, তাই এখানে টানলাম না। কখনও কোথাও যদি সময় সুযোগ আসে তাহলে বলা হবে, না হয় অব্যক্ত থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই টি এস সি-র আড্ডার দিনগুলোর কথা।
আসা যাক আসল বিষয়ে। যে বন্ধুটি আমাকে তেজগাঁও গির্জা থেকে রমলাদের হোস্টেলে নিয়ে যেতে আগ্রহী করে তুলেছিল সে আমার ইয়ার মেট হলেও অনার্সে তার ছিল ভিন্ন সাবজেক্ট, অর্থাৎ অর্থনীতি নিয়ে পড়ছিল সে। আমাদের প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো কলেজ প্রাঙ্গণে। আমার ছাত্র জীবনে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে যে কজন আমাকে বেশি সহযোগিতা করেছে তাদের মধ্যে সে ছিল একজন। একদিন সে ক্যান্টিনে বসে চা খেতে খেতে বলল, আপনাকে দেখা করতে বলেছে। ওর কথায় জানতে চাইলাম, সে কে? আমার এমন প্রশ্ন শুনে সে হা হা হা করে হাসলো।
বন্ধুটি একটু আমতা আমতা করে বলল, রমলা। আমি হাসলাম। অনেকটা ঘটকালী করার স্টাইলে বলল কথাটি। বন্ধুটি যেভাবে বলছিল আমি বিষয়টি সেভাবে ভাবিনী তার আগে কখনও। যে কারণে খুব হাল্কাভাবে নিলাম ওর কথা গুলো। তারপর আরো কয়েকবার বলল আমাকে দেখা করার কথা। ওর আগ্রহ দেখে মনে হলো মেয়েটির চেয়ে ওর আগ্রহই যেনো বেশি আমাকে হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে আবার রমলার সাথে কথা বলানোর জন্য।
একদিন সত্যিই ওর সাথে চলে গেলাম রাজাবাজার সাধনপাড়া রমলার সাথে দেখা করতে। বন্ধুটি তখন থাকে ফার্মগেইট মনিপুরিপাড়া। আগেই সম্ভবত রমলাকে বলে এসেছিলো আমাকে নিয়ে যাবে ওর সাথে দেখা করানোর জন্য, যে কারণে হোস্টেলের সামনে গিয়ে নক করতেই বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। মেয়েটির সাথে তার কথোপকথনের বিষয় শুনে আমার এমনটিই ধারনা হয়েছিল। মেয়েটিকে অনুরোধ করে বলল, ভিতরে গিয়ে যেনো রমলাকে ডেকে পাঠায়। সত্যি সত্যি মেয়েটি ভিতরে গিয়ে ডেকে পাঠালো রমলাকে।
রমলা আমাদের দেখে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। এসে এমন ভাবে কথা বলতে শুরু করলো, শুনে পরিষ্কার হলাম, আমি যে যাবো সে আগে থেকেই সব জানতো। আমার তো ওকে দেখে পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি এমনিতে চুপচাপ প্রকৃতির হলেও পরিবেশ বুঝে তাৎক্ষনিক কথা বানিয়ে রসিকতা করতে কিছুটা পারদর্শী ছিলাম তখন। যদিও নিজের কথা নিজে বলছি, তবে এটি আমার নিজের উপর এক ধরনের কনফিডেন্স থেকে বলা।
রমলা সামনে এসে প্রশ্ন করলো, কেমন আছেন? আমি ইচ্ছে করেই ওকে তুই সম্বোধন করে জানতে চাইলাম, তোর খবর কি? দু’জনের এই ডাকটি আমাদের শেষ পর্যন্ত ছিল। শেষ পর্যন্ত বলতে আমাদের দু’জন দু’জন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া পর্যন্ত। রমলা আমাকে আপনি সম্বোধন করলেও আমি তুই করে ডাকতাম রমলাকে। সেদিন আমি বন্ধুটির সামনে কথা বেশি বাড়ানোর ইচ্ছে করিনি। কারণ ছিল সেই একটাই, কেউ যেনো বলতে না পারে যে আমি রমলার প্রেমে জড়িয়েছি। তবে এরই মধ্যে পরিচিতদের অনেকেই জেনে গিয়েছিল সেই বন্ধুর সরল মুখের কারণে। যা মোটেও পছন্দ হয়নি বা ভালো লাগেনি আমার কাছে।
সেখানে সেদিন অল্প সময় দাঁড়িয়ে কথা বলে চলে আসলেও পরে আমি একা কয়েকবার গিয়েছি রমলাদের হোস্টেলে দেখা করতে। মেয়েদের হোস্টেল বলে সেখানে বিনা প্রয়োজনে ছেলেদের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও আমার বেলায় মনে হয় কোনো বাধা কার্যকর ছিল না। যেহেতু রমলা ছিল সেই হোস্টেলের দায়িত্বে। আমার পরপর কয়েকদিন যাবার কারণে বিষয়টি অন্য মেয়েদের চোখে পড়বে মনে করে একদিন আমাকে শুধু বলেছিল, ঘনঘন গেলে অন্য মেয়েরাও যে তার মতো অধিকার খাটাতে চাইবে তখন তো কাউকে নিষেধ করা যাবে না। পারলে আমি যেনো ওখানে কম যাই তবে চাইলে আমরা বাইরে কোথাও দেখা করতে পারি। আমি তাতে সরাসরি সম্মতি না দিলেও ভিতরে ভিতরে মেনে নিয়েছিলাম ওর এমন প্রস্তাব।
রমলার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাকে যেনো কোনোভাবে ছোট হতে না হয় তাই বলেছিলাম, ওখানে আর যাবো না। তবে কথা বলার জন্য একদিন অন্ততঃ বাইরে কোথাও দেখা করার প্রোগ্রাম করতে হবে। আমার কথায় সে রাজি হলে কথা বলে স্থির করলাম বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবো এবং আমিই প্রস্তাব করেছিলাম পুরাতন ঢাকার ওয়ারী কবরস্থানের সামনে যে বলধা গার্ডেন রয়েছে সেখানে যাবার জন্য। ফার্মগেইট ওর হোস্টেল থেকে এতদূরে (পুরাতন ঢাকা) যেতে প্রথম আপত্তি করলেও পরে অবশ্য মেনে নিয়েছিল মনে হয় আবেগের কারণে। আমার যতটুকু মনে পড়ে, আমাদের প্রথম ডেটিং হয়েছিল পুরাতন ঢাকার (ওয়ারি) নারিন্দা কবরস্থানের সামনে সেই বলধা গার্ডেনে।
সেখানে আমি ডেটিং করার পিছনে একটি বিশেষ কারণ ছিল, আমি তখন থেকেই যেহেতু লেখালেখি করি এবং ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে বেড়ানো পছন্দ করি তাই। যতটা শুনেছি, আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ একসময় এই বলধা গার্ডেন পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। পাশাপাশি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে নিয়ে আসার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বলধা গার্ডেনে রাখা হয়। এখানেই কবির থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। (বিষয়টি আমার শোনা।) তাই রমলাকে যেন এ নিয়ে গল্প করতে পারি বা পরবর্তীতে যেনো কিছু লিখতে পারি এজন্যই বলধা গার্ডেনে তাকে নিয়ে যাওয়া।
যেহেতু সেদিন আমরা দুজন একসাথে প্রথম বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি তাই কিছুটা অবিশ্বাস আর ভয় মনে কাজ করতে পারে মনে করে আমাদের সাথে ওর অন্য এক বান্ধবীকে নিয়েছিলাম। সাধনপাড়া থেকে তখন নারিন্দা পর্যন্ত রিক্সা চলাচল করতো। এমনিতেই রিক্সা ভ্রমণ আমার কাছে প্রিয়। তিনজন এক রিক্সায় চড়ে গিয়েছিলাম রাজাবাজার থেকে সেই বলধা গার্ডেন পর্যন্ত। এক রিক্সায় চড়ে তিনজনের সেই ভ্রমণ ছিল বেশ আনন্দের আর মধুর। সত্যিই বলছি, সেদিন তিনজনের সেই রিক্সাভ্রমণ কোনোভাবেই ভোলার নয়।
ক্রমশঃ --------
পি আর প্ল্যাসিড জাপান প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক
২৪শে আগস্ট ২০২০
ক্রমশঃ --------
পি আর প্ল্যাসিড জাপান প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক
২৪শে আগস্ট ২০২০