তীর্থভূমি
***
ওরা এখনও জেগে আছে
বেঁচে আছে আমাদের মননে
আর থাকবেও চিরদিন অম্লান।
কথা হচ্ছিল সকালের চায়ের আড্ডায়-
আজকাল তো আবার আমার ছেলে
বাংলাটা ঠিক বোঝেনা
লিখতেও জানেনা,
পড়তে তো পারেই না
বলার সময়ও কি সুন্দর করে ইংরেজিতে বলে
গর্বে বুকটা ভরে যায়-
বলছিলেন, আমাদের পাড়ার বাসু দা
বাসুদেব মিত্র; পাড়ার বাসু দা
সবাই যাকে আড়ালে বাঁশ দা বলে
খেজুর রসের মতো
অহংকার যেন টুপটাপ ঝরে পড়ে
সারা অঙ্গ বেয়ে
গর্বে বুকের ছাতি
সামনের দিকে ছয় ইঞ্চি এগিয়ে আসে
যখন তার জলপানের ইচ্ছে হয়
কি সুন্দর করে বলে
গিভ মি এ গ্লাস অফ ওয়াটার
যেন প্রতিটি শব্দে মুক্তো ঝরে
মাকে তো সেই কবে থেকেই ম'ম
আমাকে ডেড আর সব আঙ্কেল আন্টি
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা
অনেক বেশি অ্যাডভান্সড
এ হেন বাঁশ দা ভাবতেই পারেননি
কেউ তার কথার কোনো প্রত্যুত্তর দেবে
ও পাড়ার ঘোষাল বাবু
যিনি বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ থাকেন
বক্তার চেয়ে ভালো শ্রোতা হিসেবে যার নামডাক আছে
প্রতিবাদ তো দূর অস্ত
কথার সায় দেওয়াতেও যার চিরকালই অনীহা
সে-ই হঠাৎ ফোঁস করে ওঠে
যেন শীতঘুমে থাকা সাপ ফণা তুলেছে
হুম, মামা-মাসি-কাকা-কাকিমারা তো
কবেই জীবাশ্ম হয়ে গেছে
মা-ও মিশরীয়দের মৃত ঘরে
আর আপনি, যিনি কিনা বাবা ডাক শুনতে
লজ্জাবোধ করেন
ওর ডাকেইতো আপনি মৃত
এখন শুধু বাকি মুখাগ্নি করার
তাহলেই ষোল কলা পূর্ণ হয়ে যায়
যে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন
রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার কিংবা
কানাইলাল, কমলাদের মতো
বাংলার বীর পুত্র কন্যারা
আজকের প্রজন্মের কাছে ওরা ব্রাত্য
ইংরেজিতে দু'চারটা কথা বলতে পারলে
নিজেদেরকে ইংরেজি পোষ্যপুত্র বলে ভাবে
ওদের কাছে বাংলা ভাষা তো অসভ্যদের ভাষা
মাতৃভাষায় কথা বলতে ওদের ঘেন্না হয়
আর আমরা যারা দ্বিতীয় প্রজন্ম কে
ইংরেজিতে কথা বলতে শিখিয়ে
গর্ববোধ করি, অহংকার করি
তারাও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা
আমরা কোন্ প্রজাতির জীব
মিথ্যা অহংকারে বুকের ছাতি বড় করি
আর নিজের মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে
অন্যের ভাষাকে নিয়ে মাতামাতি করি
অথচ আমাদের কাছেই আছে
বরকত, সালাম, কমলাদের মতো
মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্ম বলিদানে
পাগল বীর সৈনিকেরা
যাদের পদতলে আজও মাথানত হয়
যাদের কথা মনে হলে আজও
চোখের কোণ ভিজে যায়
তাই আমি গর্বিত, আমি বাঙালি
বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলা আমার প্রাণ
এই বাংলা-ই যেন হয় আমার গর্বের অধিষ্ঠান
এই বাংলাতে জন্মেছি, এই বাংলাতেই যেন
ফিরে আসতে পারি বারবার, শতবার
এই বাংলা আমার মক্কা মদিনা
এই বাংলা আমার গয়া কাশি
এই বাংলা-ই আমার পূর্বজন্মের বর্তমান তীর্থভূমি।
-টিংকু রঞ্জন দাস,ত্রিপুরা
২১শে ফেব্রুয়ারি ২০২২