Type Here to Get Search Results !

নববর্ষের একাল – সেকাল ঃ অগ্নিশ্বর সরকার, বর্ধমান

‘এসো হে বৈশাখ , এসো এসো..’ – কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের প্রথম দিন। নববর্ষ। নতুন করে শুরু। এখনকার বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বৈশাখ মাসের প্রথম দিন। উর্দু শব্দ ‘পহেলা’র আভিধানিক অর্থ ‘প্রথম’ আর বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস হ'ল বৈশাখ তাই আমরা বর্ষশুরুর এই দিনটিকে পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ বলে থাকি। যদিও সেন বংশের পূর্বে অগ্রহায়ণ মাস দিয়ে নূতন বর্ষের সূচনা হত। সেন আমল(মতান্তরে আকবর) থেকে বৈশাখ মাসে কৃষিজাত পন্য ও অর্থনৈতিক উন্নতির দিক মাথায় রেখে বৈশাখ মাসকে বঙ্গাব্দের সূচনা হিসাবে ধরা হত। সেই ধারা এখনও অব্যাহত। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে ১৪ই এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ‘চারুকলা’ বিভাগ থেকে একটি মঙ্গলযাত্রার সূচনা করা হয়।  ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর UNESCO-র দ্বারা ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’, Cultural Heritage of Humanity হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে এই শোভাযাত্রা। আসামে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় রঙ্গালী বা বহাগ বিহু অনুষ্ঠান। 

বাঙালীদের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ দিন। বছরের শুভ সূচনার দিন। বিভিন্ন পূজা, মঙ্গল আরতির মধ্য দিয়ে আবাহন করা হয় নূতনের। রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ফুলে সেজে ওঠে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি। সাথে থাকে আম্র পল্লব ও বিভিন্ন ফুল। মন্দিরে চলে মঙ্গল কামনায় পূজা। দোকানে দোকানে হয় হালখাতার পুজো। হালখাতা মানে নতুন খাতা। লাল খেরোর খাতা অর্পণ করা হয় আরাধ্য দেব-দেবীর(সাধারণভাবে গনেশ-লক্ষী) সম্মুখে। প্রতিষ্ঠানের আগামীদিনের সুখসমৃদ্ধির জন্য করা হয় আরাধনা। খেরোর খাতার মধ্যে পুরোহিতমশাই লিখে দেন বিভিন্ন মাঙ্গলিক শব্দ। সাথে এঁকে দেন বিভিন্ন শুভ চিহ্ন। 




ইতিহাসে বর্ষবরণ :-

তখন দিল্লির সিংহাসনে মুঘল সম্রাট আকবর।  ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর প্রজাদের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে আরবি ও ইংরাজি সনের পাশাপাশি একটি নতুন সনের প্রচলন করেন। নাম হয় ‘ফসলি সন’। সেই সময় সাধারণ মানুষ ছিল কৃষিকেন্দ্রিক। চৈত্র মাসের শেষে মানুষদের খাজনা পরিশোধ করতে হত। বৈশাখ মাসের প্রথম দিন ভূমির মালিকরা বা জমিদাররা তাদের অঞ্চলের মানুষদের মিষ্টি মুখ করে বছরের সূচনা করত। 

আবার কারোর মতে শশাঙ্ক এই বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন।

তখন বাংলার সিংহাসনে মুর্শিদকুলি খান। তিনি সেই সময় ‘পুণ্যাহ’ বলে একটি উৎসব পালন শুরু করেছিলেন। এটিও বৈশাখ মাসের শুরুর দিনেই হত। এই দিনে জমিদার, প্রজারা তাদের বকেয়া খাজনা মিটিয়ে দিতেন। সকলে সেদিন নূতন বস্ত্র পরিধান করতেন। অঞ্চল জুড়ে খাওয়াদাওয়ার প্রচলন ছিল। লাল রঙের খাতায় একটি মোহরকে সিঁদুর দিয়ে দূর্বা সহযোগে ছাপ দিয়ে নতুন বছরের হিসাবের সূচনা করা হত। রাত্রে গান-বাজনার আসর বসত এইসব নবাব,রাজা, জমিদারদের বাড়িতে। 

পরে ইংরেজ শাসকেরাও একইভাবেই এই বর্ষবরণ উৎসব পালন করতেন। চলত নাচ-গানের আসর। বিখ্যাত বাইজীরা আসতেন শাসকের প্রাসাদে। রাতভর চলত অনুষ্ঠান।


প্রাচীন কলকাতার বর্ষবরণ :-

চৈত্রমাসের শেষ দিনে হয় বাঙালীদের ‘চড়ক’ উৎসব। সেই উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। সেই মেলা থেকে গনেশ-লক্ষ্মীর মাটির মূর্তি কিনে সেটিকে পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন যথাযথ উপাচারে পুজো করে শুরু হত বর্ষবরণ উৎসব। কলকাতার বড় বড় বনেদী বাড়িগুলিতে বিশেষ জলসার আয়োজন করা হত। গৃহস্বামীরা সকালে নতুন পাঞ্জাবী-ধুতি পড়ে বসতেন তাদের বাড়ির কাছারিতে। সাথে থাকতেন তাদের বন্ধু, মোসায়েবরা। খানা-পিনার সাথে চলত সুরাপান। 

পরবর্তীতে কলকাতা যখন ‘বাবু কালচারে’(১৯শতকে) আচ্ছন্ন, তখন দেখা যেত বিভিন্ন অঞ্চল বা পাড়ার বাবুদের মধ্যে চলত রেষারেষি। সং সেজে শোভাযাত্রা বেরত। চলত দেদার ফুর্তি। আত্মীয়স্বজনদের আমন্ত্রণ করা হত। ব্যবসায়ীরা তাদের খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ করাতেন। 


শান্তিনিকেতনে বর্ষবরণ :-

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কর্মভূমি শান্তিনিকেতন-বোলপুর। তিনি সেখানেও প্রচলন করেছিলেন বর্ষবরণের। উপাসনাগৃহে আচার্যের আলোচনা, ব্রাহ্মসঙ্গীত ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় নূতন বছরকে। সাথে থাকেন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও আশ্রমিকরা। নূতনের আবাহন করা হয়  ‘এসো হে বৈশাখ , এসো এসো..’ , ‘হে চির নূতন’, ‘ অন্তর মম বিকশিত কর’, মন্ত্রপাঠ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। সকলে হাজির হন রবীন্দ্র ভবনে। বিশ্বকবির চেয়ারে মাল্যদান করে শুরু হয় বর্ষবরণ উৎসব। বিকেলেও থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 

আগে গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহের কারণে কবিগুরু ১লা মে থেকে দুমাস ব্যাপী গ্রীষ্মবকাশের শুরু করেছিলেন, পরে(১৯৩৬ খ্রীঃ) আশ্রমিক ও অধ্যাপকদের অনুরোধে তিনি বর্ষবরণের পাশাপাশি তাঁর জন্মদিন পালনের অনুমতি দেন।  

প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী তাঁর “আমাদের শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “২৫শে বৈশাখ তো হয় ৭/৮ মে। তখন গরমের ছুটিও হয়ে যায়। তাই গরমের ছুটি হবার আগেই আম্রকুঞ্জে প্রভাতে আশ্রমিকেরা রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালন করতেন। আমরা, ছোটরা। প্রথম সারিতে বসতাম। ...দিনটি ছিল ১ বৈশাখ।...মে মাসে আশ্রমে জলাভাব। তাই নাচে। গানে কবিতায় সেই জন্মদিন পালিত হত। যাঁর জন্মদিন তিনি ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি আর উত্তরীয়ে সেজে গাড়ি থেকে নামতেন। কী রূপ, যেন ঝলমল করত আম্রকুঞ্জ।”  

২০০৫ খ্রীঃ থেকে ১লা মে-র পরিবর্তে ২৫শে মে গ্রীষ্মবকাশের শুরু হয়। এখন নির্দিষ্ট দিনেই ‘বর্ষবরণ’ ও ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’ পালন করা হয়। 

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতেও নতুন বছর জাঁকজমকের সাথে পালন করা হত।  বাড়ির লম্বা টানা বারান্দায় খাওয়া-দাওয়া আর গানবাজনা হত নববর্ষের দিনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন রকম রান্না খেতে ভালোবাসতেন। নববর্ষের দিন এবাড়িতে কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল, নারকেল চিংড়ি, ইলিশ মাছের পোলাও, আম দিয়ে শোল মাছ, ইত্যাদি হত। সবাই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে সানন্দে নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানাতেন।



এখনকার বর্ষবরণ :-

আগেকার রীতি বা প্রথা মেনেই বর্তমানকালেও বর্ষবরণ করা হয়। দোকানে দোকানে ব্যাবসার মঙ্গলকামনায় গণেশ-লক্ষ্মী পূজা অর্চনা সেরে খেরোর খাতায় মাঙ্গলিক চিহ্ন এঁকে সূচনা করা হয় নতুন বছরের ব্যবসার। ব্যবসায়ীরা নতুন পোশাক পরিধান করে শুরু করেন তাঁদের ব্যাবসায়িক নতুন বছরের। সাথে থাকে খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ। চৈত্রমাসের শেষে মিটিয়ে দেওয়া হয় সমস্ত ব্যবসায়িক ঋণ। নতুন বছরে শুরু হয় নতুন বছরের খাতা। এই দিন কলকাতার বই পাড়ায়ও চলে আনন্দ। লেখক-প্রকাশক-বিক্রেতারা নিজেদের মতো করে পালন করেন এই দিনটা। খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনায় মুখরিত হয়ে ওঠে বিভিন্ন পাড়ার জলসা; বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলিও বর্ষবরণের বিভিন্ন আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। 

এই বিশেষ দিনে ময়দানের ফুটবল মাঠে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান পালিত হয়। বারপুজো। ময়দানের ফুটবল ক্লাবগুলির কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়রা যৌথভাবে পালন করেন এই অনুষ্ঠান। ‘বার’ মানে গোলপোস্ট। এটির যথাযথ সম্মান, অর্চনা না করলে কোপে পড়তে হতে পারে ক্লাবগুলিকে। প্রথমে গোলপোস্টটিকে পরিষ্কার করে, রঙ করে – ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হয়। এরপর পুরোহিত মশাই যথাচারে পুজো করেন ওই পোস্টটিকে। প্রচুর সমর্থকও ভিড় জমান ক্লাবে। সেদিন খেলোয়াড়ের সাথে তারাও অনেকটা আত্মিক হওয়ার সুযোগ পান। অটোগ্রাফের আবদার থেকে সেলফির আবদার পর্যন্ত সব খেলোয়াড় থেকে কর্মকর্তারা হাসিমুখে মেটান। 




পরিশেষে:-

নববর্ষ মানেই শুধু বাংলার নববর্ষ নয়; নববর্ষ প্রতিটি দেশে স্ব স্ব রীতিনীতির মাধ্যমে পালন করা হয়। ইংরাজির নববর্ষ মানে ১লা জানুয়ারি, এই দিনটিও আমরা উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে পালন করে থাকি। মানে আমাদের বাংলাতে দুটি নববর্ষ পালন করা হয়। কোরিয়া(ফেব্রুয়ারি), চীন(২২শে জানুয়ারি) প্রভৃতি দেশে তাদের মতো করে নতুন বছরের সূচনা করে। 

বর্তমান সমাজ অবশ্য নিজেদের মতো করে ডিজিটালি বর্ষবরণ করতে অভ্যস্ত। তারা ইমেল, মেসেজ, হোয়াটসএপ, ফেসবুক প্রভৃতির মাধ্যমে বর্ষবরণের শুভেচ্ছা বিনিময়েই বেশি স্বচ্ছন্দ। এতে অবশ্য অনেকটা সুবিধা হয়। ছবি বা মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে অনেক আকর্ষণীয় শুভেচ্ছা বিনিময় সম্ভব, কিন্তু পয়লা বৈশাখের ধুতি-পাঞ্জাবী-শাড়ী-তে যে বাঙ্গালিয়ানার স্বাদ পাওয়া যায় ডিজিটালে তা অমিল। সারাদিনব্যাপী পরিচিত দোকানে বা আত্মীয়স্বজনের সাথে নির্ভেজাল আড্ডার যে আনন্দ তা বর্তমান কর্মব্যস্ত জীবনে দিন দিন অমিল হতে শুরু করছে। 



তথ্যসূত্র:-

১. উইকিপিডিয়া

২. বাংলা ট্রিবিউন (সংবাদপত্র - ১৪/০৪/২০১৭)

৩. ২৪.কম (সংবাদপত্র – ১৪/০৪/২০১৫ ) 

৪. দ্যা ক্যালকাটা মিরর (সংবাদপত্র – ১৫/০৪/২০২১)

৫. ইন্টারনেট ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা

 



অগ্নিশ্বর সরকার

বর্ধমান


আরশিকথা হাইলাইটস

১৫ই এপ্রিল ২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.