” এসো তবে আমরা ভালোবাসি,
ভালোবাসি
ধাবমান প্রহরকে উপভোগ করি
অবিরাম
মানুষের কোনো বন্ধন নেই।
সময়ের কোনো তটরেখা নেই
শুধু বয়ে চলে আমরাও-
পার হয়ে যাই ”
-আলফর দ্যা লামারতিন “
লন্ডন থেকে ম্যানচেষ্টার হয়ে এসেছি ছোট্র পর্যটন শহর হেরোগেটে। ’হেরোগেট ল্যাঙ্গুয়েজ একাডেমি’তে ইংলিশ কোর্স করছি এক মাসের। তারপরেই চলে যাব লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা বেশ ক’জন বাঙালি রয়েছি এ দলে। ইংলিশ কালচার শিখানোর জন্য আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে আলাদা আলাদা বৃটিশ পরিবারে। হেরোগেট ড্রাগন রোড থেকে আসদা সুপার মার্কেটের উল্টোদিকে যে গলিটি বের হয়েছে তার নাম ড্রাগন এভেনিউ। এ গলিটি সোজা গিয়ে পড়েছে বিখ্যাত স্কিপটন রোডে। তার আগেই ড্রাগন এভেনিউ থেকে একটি চন্দ্রাকৃতির রাস্তা আবার গিয়ে মিশেছে ড্রাগন রোডের সাথেই। এ রাস্তার নাম মর্নিংটন ক্রিসেন্ট। মর্নিংটন ক্রিসেন্টের দ্বিতীয় বাড়ীতে আমি থাকি।
সেখান থেকেই একদিন হাঁটতে হাঁটতে হেরোগেট পার্ক পার হয়ে ডাচি রোড এলাকায় এলাম। এ এলাকাটা কিছুটা ফাঁকা, এখানে অপেক্ষাকৃত অভিজাত লোকজন থাকে। রাস্তার দু’পাশে আমাদের সোনালু, শিমুল কিংবা কৃষ্ণচূড়ার মতো ডন্ রেডউড, ওলমি পাইন কিংবা এঞ্জেলিকা নামের বড় বড় গাছগুলিতে শুধুই ফুল আর ফুল। কোথাও হলুদ, কোথাও বেগুনি, কোথাও বা নীল কিংবা লাল-লাল ফুল আর পাতার সমারোহ। ফুলের পাপড়ি পড়ে পড়ে ঢেকে যায় রাস্তা, মনে হয় ফুলের গালিচা পাতা। রঙে রঙে সয়লাব এ পথ ধরে গাঢ় রঙের কাটা স্কার্ট পরে সুন্দরী তরুণীরা হেঁটে যায়। উন্মত্ত দখিণা বাতাসে উড়তে থাকে সামনের দিকের কাটা স্কার্ট, সম্পূর্ণ দেখা যায় অপরূপ সুন্দর পদবল্লব। কখনো কখনো উড়ে যাওয়া কাপড়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ে কোমর থেকে মাত্র পাঁচ-সাত ইঞ্চি নিচের দিকে নামানো মিনি ড্রেসটি পর্যন্ত। প্রকৃতির অপরুপ মাধুর্য্যের মাঝে রচিত হয় আর এক মানবীয় মাধুরিমা।
ডাচি রোডের মাঝামাঝি এসে থামলাম। পাশের রাজকীয় মডেলে তৈরি এ বাড়িতে আমাদের আমিন ভাই থাকেন। লাল সাদায় মেশানো রঙের বিশাল বাড়ি, সামনে অনেক বড় লন, একপাশে টেনিস কোর্ট। এ বাড়ির মালিক বা ল্যান্ডলেডী হেরোগেটের একজন নামকরা সমাজকর্মী। বাড়ির সামনেই তার সঙ্গে দেখা। লনের বেঞ্চিতে বসে বসেই অনেক কথা হলো। সে বাড়িতেই জাপানি একটি মেয়ে থাকে। সেও একাডেমীর স্টুডেন্ট। মেয়েটিও এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল।
ল্যান্ডলেডি মিজ. এলেন বললেন, সপ্তদশ শতাব্দীতেও ইয়র্কশায়ার রাজ্যের অন্তর্গত এ হোরেগেট ছিল ছোট্ট একটি গ্রাম। গুটি কয়েক লোক বাস করতো এখানে। সে সময়েই উইলিয়াম সিংসরাই নামের এক লোক একটি ঝরণার জল পান করে চমৎকার সুন্দর খনিজ জলের স্বাদ অনুভব করেন। প্রাকৃতিক জলাধার থেকে জল পানে অভিজ্ঞ এ ব্যক্তিই সর্বপ্রথম এখানে মিনারেল ওয়াটার রয়েছে বলে প্রচার করেন। পরবর্তীকালে ড.মাইকেল হাটানহোপ নামের অপর এক ব্যক্তিও সুমিষ্ট মিনারেল ওয়াটার সম্পন্ন আর একটি ঝরণার সন্ধান দেন। তখন মানুষ বিশ্বাস করতো এমন ধরনের খনিজ জল পান করলে রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায় ও মানুষ দীর্ঘায়ু হয়। ফলে শুরু হয় এখানে মানুষের আসা যাওয়া এবং সপ্তদশ শতকেই এখানে সরাইখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
অষ্টাদশ শতাব্দির শুরুতে নানা এলাকা থেকে স্বচ্ছল মানুষেরা এখানে বসতি স্থাপনের জন্য আসতে শুরু করে এবং তাদের জন্য দু’শ একরের মত জায়গাও বরাদ্দ দেয়া হয়। ধীরে ধীরে এখানে গড়ে ওঠে চার্চ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ যাবতীয় নাগরিক সুবিধাসমূহ। অষ্টাদশ শতকেই এখানে স্থাপিত হয় বিখ্যাত বয়েন বাথ হসপিটাল, রয়েল পাম্প হাউজসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। ১৮৪৭ সালে এখানে গ্যাস লাইট জ্বালানো শুরু হয় এবং এখানে রেললাইন স্থাপনের ফলে হেরোগেট যুক্ত হয়ে যায় সমগ্র ইংল্যান্ডের সঙ্গে। উনিশ শতকের শেষ দিকে হেরোগেটের জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২৫ হাজার। সমগ্র বৃটেন থেকে ধনী লোকেরা বিশেষ করে কয়লা খনির মালিকেরা এখানে বসতি গড়ে তোলে। এ শহরের লোকসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৮৭ হাজার এবং এদের অধিকাংশই বাইরে থেকে আসা। নাগরিক সুবিধার এমন কিছু বাকি নেই, যা হেরোগেটে পাওয়া যায় না। বেশ কিছু ভারতীয বাঙালি পরিবারের সাথে গোটা দু’য়েক বাংলাদেশী পরিবারও এখানে বাস করছে। তাদের দু’টি রেষ্টুরেন্টও রয়েছে এখানে।
এলেন বললেন, আটলান্টিকের কাছাকাছি বলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর জলবায়ুর নির্মলতার কারণে এ শহরটি ইতোমধ্যেই ট্যুরিস্ট সিটি হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। অন্যদিকে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের তেমন প্রসার লাভ করেনি। কিন্তু এডুকেশন এবং চিকিৎসার দিক থেকে হেরোগেট একটি অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এখানে অনেক কিছুই চারশত বছর আগে নির্মিত। বিশেষ করে কিছু কিছু রাস্তাঘাট, ইমারত, চার্চ এবং পাঠশালা সে আমলের। তবে শ’ দেড়েক বছর আগে এখানে প্রায় সব কিছুই পুন:নির্মান করা হয়। তাই রাস্তাঘাট, ওভারব্রিজ, ঘর-দোর সব কিছুই প্রায় শত বছরের পুরনো।
এলেনের কথা শুনতে শুনতে মনে হলো, পুরনো সবকিছুর সঙ্গেই নতুন করে যোগ হয়েছে আধুনিক ব্যবস্থা। তবে পুরনোকে ঝেড়ে ফেলা হয়নি। অত্যাধুনিক হিটিং ব্যবস্থা সম্বলিত বাড়ির দিকে তাকালেই চোখে পড়ে বাড়ির ছাদে চুলার চিমনি। তবে ধোঁয়া নেই। কারণ, ঘরে এখন আর তাপের জন্য চুলা জ্বালানো হয় না। চুলাটি আছে আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে। তাই চিমনি দেখা যায় প্রায় প্রতি বাড়ির ছাদেই। আমরা যে বাড়িতে থাকি সেখানেও দেখি বেসিনে টেপ খুললেই গলগল করে পানি আসে, প্রচুর পানি। কখনো ইলেকট্রিসিটি যায় না, গ্যাস তো আছেই। কিন্তু, এসব কিছু আসে কোথা থেকে, পাইপ কোথায়, তার কিছুই বোঝা যায় না।
একদিন দেখি, রাত দশটার সময় একটি রাস্তা বন্ধ। সব গাড়ি অন্য পথে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সামনেই বন্ধ রাস্তার মাঝখানে তীব্র আলো আর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে গেলাম এবং দেখি রাস্তায় খোঁড়া খুঁড়ির কাজ হচ্ছে। অনেক লোক কাজ করছে। পুরো রাস্তাটি খুঁড়ে নিচে লোকজন পাইপ মেরামত করছে। ভাবলাম, সকালে এ রাস্তা দিয়ে একাডেমীতে যাব কেমন করে!
ও মাই গড! সকালে দেখি একদম স্বাভাবিক রাস্তা। কোথাও রাতের বেলা কাজের চিহ্নটুকুও নেই। খোঁড়া রাস্তাটিকে কাজ শেষে সম্পূর্ণ মেরামত করে পিচ ঢেলে সম্পূর্ণ আগের মতো করে দেওয়া হয়েছে। আশেপাশে কোথাও একটি মাটির চাকা, ইটের টুকরো কিংবা অন্য কোনো আবর্জনার চিহ্নও নেই। একেবারেই স্বাভাবিক।
কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে এলেন উঠে গেলেন। আমাদের জন্য চা আর কিছু বিস্কুট একটি ট্রেতে নিয়ে তিনি আবার আসলেন, আমাদের চা পানে আমন্ত্রণ জানালেন। বিলেতে এ ধরনের আপ্যায়ন করার কোন নিয়ম নেই। আমরা সে প্রসঙ্গ তুলতেই এলেন হেসে বললেন, ঠিক আছে, তবে তোমরা ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশীরা যে অতিথিকে চা খেতে দাও সে আমি জানি। কিন্তু আমার বাসায় তো তোমাদের দেশের মতো সারভেন্ট নেই। তাই আমাকেই চা তৈরি করে আনতে হলো। এখানে তোমরা আমাকেই সারভেন্ট মনে করতে পার বলে এলেন একটু মশকরা করলেন। আমরা লজ্জায় জিভ্ কাটলাম।
চা খেতে খেতে এলেনের সঙ্গে অনেক কথা হলো। হেরোগেটের পাশেই একটি বাজবাড়ী আছে হেরোউডে। পশু পাখিতে ভরপুর চিড়িয়াখানার মতই সে রাজবাড়ী। এলেন বললেন, পারলে একদিন যেও, নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
হেরোউড দর্শন
আমাদেরকে শুধু শ্রেনিকক্ষেই ইংরেজী শিখানো হয়না। ইংলিশ কালচার শিখার জন্য রয়েছে কমিউনিটি ভিজিটের ব্যাবস্থাও। এ পোগ্রামের আওতায় রাজবাড়ী ভিজিটের কথা বলতেই একাডেমি কর্তৃপক্ষ রাজি হয়ে গেল।
পরদিন দুপুর দু’টায় একাডেমি থেকে বের হলাম। সামনেই দেখি অনেক লম্বা এবং খুবই সুন্দর একটি বাস আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাস থেকে বের হওয়ার আগেই সোশ্যাল অফিসার বললেন, আজ আমাদের হেরোউড নিয়ে যাবেন রাজবাড়ি দেখার জন্য।
এক জাপানী বেরসিক শিক্ষার্থী বললো, রাজবাড়ি দেখে কি হবে?
তিনি উত্তর দিলেন, সেখানে একটি সুন্দর পার্কও আছে।
তিনি মৃদু ভৎসনা করে বললেন, তা ছাড়া বিলেতে এসেছ ঘরে বসে থাকার জন্যে নাকি?
আসলেই বিলেতিরা ঘরে বসে থাকে না। সুযোগ পেলেই তারা ঘর থেকে বের হয়ে যায়। প্রতিটি ছুটির দিনেই তারা লং-ড্রাইভে যায়। ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। ঘরে আইডল বসে থাকা বা ঘুমিয়ে থাকার কালচার ওদের নেই।
হেরোগেট থেকে বের হয়ে লীডস্ রোড ধরে দক্ষিন দিকে দশ পনের কিলোমিটার যাওয়ার পরই দেখলাম এলাকাটি কিছুটা পাহাড় আর বন-জঙ্গলে ঘেরা। মাঝে মাঝেই আমরা পার হয়ে যাচ্ছি ওভারব্রিজ, আবার ঢুকে যাচ্ছি সুড়ঙ্গে। এক একটি সুড়ঙ্গ হবে এক কিলোমিটার পর্যন্ত। দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে বনভূমি। এখানে বলা হয়, উড্। দু’ একটি নদী-নালাও চোখে পড়ছে। ছোট ছোট নালাগুলো দেখতে মনে হয় আমাদের কত আপন। মনে হয় নদীটি বাংলাদেশ থেকে এসেছে। মনে হয় নদীটি এসেছে আমার সাথেই!
মনে পড়ে গেল কবি জীবনানন্দ দাশ-এর লেখা ’নদী’ কবিতার ক’টি লাইন,
নদী তুমি কোন কথা কও?
তুমি যেন আমার ছোট মেয়ে-আমার সে ছোট মেয়ে;
যতদূর যাই আমি-হামাগুড়ি দিয়ে তুমি পিছে পিছে আসো,
তোমার ঢেউয়ের শব্দ শুনি আমি; আমার নিজের শিশু
সারাদিন নিজ মনে কথা কয় (যেন)
তবে, এখানকার নদীতে কোথাও একটি নৌকা চোখে পড়েনি। সব নদীতেই স্বচ্ছ জলরাশি। ব্রিজের উপর দিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করেছি, নদীর নীল জলের স্বচ্ছতা, ইচ্ছে হচ্ছিল ঝাঁপিয়ে পড়ি। বহুদিন ধরে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে স্নান করতে না পারার জ্বালা মিটিয়ে নেই।
সে যাক,আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে কিছুটা সময় নিয়ে আবার হেরোগেট রোডে উঠে গেলাম। দ্রæতবেগে সামনে এগিয়ে কিছুটা উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে চল্লিশ কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ঘন্টাখানেকের মধ্যেই হেরোউড পৌঁছালাম। এখানে একটি ছোট্ট শহর আছে। কয়েক’শ পরিবার থাকে এখানে। তবে শহরের সব আধুনিক ব্যবস্থাই এখানে বিদ্যমান ।
আমাদের সঙ্গে জাপানি স্টুডেন্টরাও এসেছে। আমার পাশের সিটে বসেছিল জাপানি একটি মেয়ে, নাম তাকাশু। সব কাজেই তার তাড়া। একরকম আমার হাত ধরেই টেনে টেনে সে আমাকে রাজবাড়ির দিকে নিয়ে চলল। সামনের গেট থেকেই রাজবাড়ি পরিদর্শনের জন্য তিন পাউন্ড দিয়ে টিকেট কাটলাম। তারপর মূল ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সামনের খোলা মাঠটি পেরিয়ে রাজবাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
তিনতলা একটি দালান। বিশাল বিশাল থাম, চমৎকার ডিজাইন! বোঝাই যাচ্ছে এটা রাজপ্রাসাদ। বারান্দায় প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়ালাম। বিশাল বিশাল তিনটি হাতে আঁকা ছবি। ছবিগুলো ভারতীয় পেইন্টার মকবুল ফিদা হুসেন-এর আঁকা। জানা গেল এখানে ফিদা হুসেইন এসেছেন। তিনি বর্তমান রাজা, মানে রাজ প্রতিনিধির বন্ধু।
বিলেতে এক একটি এলাকায় একজন রাজ প্রতিনিধি থাকেন। তিনি সে এলাকার রাজা। এখানে থাকেন রাণীর এক ফুফাতো ভাই। লোকটি নাকি পাগল বা আধা মাস্তান। তাই সে শহর এলাকায় না থেকে এ নির্জন এলাকায় থাকে। এখানে সে একটি ছোটখাট পার্ক বানিয়েছে। মাঝখানেই তার প্রাসাদ। এই নির্জন প্রাসাদের পঞ্চম তলায় সে একাই থাকে। চিরকুমার এই পাগলাটে মানুষটিকে আমার খুবই ভালো লাগলো। ভাবলাম, একসময় সম্ভব হলে আমিও পাগল হয়ে যাব।
রাজপ্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। টকটকে লাল গালিচা পাতা। বিশাল বিশাল উঁচু উঁচু দরজা জানালার উপর ক্রিম কালারের পর্দা লাগানো। সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল, কাটলারিজ সবই রাজকীয়। তবে সবকিছুই ভারতীয়। প্রত্যেকটি আইটেমের উপর এমন কি লবনদানির উপরও লেখা আছে এটি ভারত থেকে সংগ্রহ করা। রানা প্রতাপ সিংহ, ঝাঁসির রানি এবং লাক্ষেèৗর নবাবদের ব্যবহার করা অনেক জিনিসপত্রই এখানে আছে।
রাজাকে দেখার জন্য পঞ্চম তলায় উঠে গেলাম। ঘরে প্রবেশের অনুমতি নেই। জানালা দিয়ে দেখলাম, রাজা মশারি খাটিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এই প্রথম বিলেতে এসে কোনো লোককে মশারির নিচে ঘুমাতে দেখলাম, তাও আবার দিবানিদ্রা।
আসলে এই রাজা সব কিছুতেই ভারতীয় হতে চেষ্টা করেন। প্রায় সত্তর বছর বয়সী এই রাজার জন্ম ভারতে। তাঁর পিতা ভারতের লাট ছিলেন। ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি, রীতিনীতি এমন কি ভারতীয় শিল্পী, নায়ক-নায়িকারাও প্রভাব বিস্তার করেছিল এই পাগলা রাজার হৃদয়ে। তাই তার ভারতের প্রতি এই দুর্বলতা।
রাজদর্শন শেষে পার্কের দিকে গেলাম। অজস্র গাছপালায় সাজানো বিশাল বাগান। সেখানে হাঁস, মোরগ-মুরগি ও অন্যান্য পাখিরা আমাদেরকে যেন জড়িয়ে ধরল। বড় বড় লাল নীল কাকাতুয়া পাখিরা কেউ এসে গায়ে বসে, কেউ উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে পাখনা দিয়ে মাথায় একটু ছোঁয়া দিয়ে যায়। কেউবা শীস দিয়ে গান শোনায়। একটু দূরেই একটি ছোট্ট ডোবার মতো। সেখানে ফুটে আছে সাদা, নীল ও লাল শাপলা ফুল। লেখা আছে, বাংলাদেশ লিলি। একটি ছোট্র নৌকাও দেখলাম সে সরোবরে।
ওমা একি! এ যে দেখি বাংলাদেশের চড়–ই। এক ঝাঁক চড়–ইপাখি। সেখানে লেখাই আছে বাংলাদেশের চড়–ই। অনেক শুকনো খড়কুটো জড়ো করে রাখা হয়েছে। একটি ছ্ট্টো ক্ুঁড়ে ঘরও আছে। সে ঘরের চালেই বাসা বেঁধে থাকে চড়–ই পাখিগুলো। পাখিগুলোকে আমার কিছুটা রোগা ও বিষণœ মনে হলো। আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা চড়–ই পাখিগুলোর করুণ চাহনী দেখে আমার মনে হলো বন্ধু কবি নাসির আহমেদ এদের কথা ভেবেই লিখেছেন:
“ও মাছ রাঙারে! নিয়ে গেলি কার স্বপ্নের রূপালী মৎস্য তুই।
শয্যা পেতেছি এই বিরান জলায়; এখানে পাবদা পুঁটি নেই---
এক অতল অন্ধকারে আছি সূর্যের অপেক্ষায়।”
এ রাজপ্রাসাদটিকে একটি ভারতীয় ও বাংলাদেশী মিউজিয়াম বলেই আমার মনে হলো। সে যাই হোক, সন্ধ্যে ছয়টার মধ্যেই রাজপ্রাসাদ দেখা শেষ হলো। আসার সময় স্যুভেনির বিক্রি হয় এমন এক দোকানে ঢুকলাম। অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে মকবুল ফিদা হোসেনের ছবি দেখলাম সেখানে। কে যেন একজন বললেন, এ রাজার ঘনিষ্ট বন্ধু ফিদা হোসেন। তিনি এখানে আসেন মাঝেমধ্যে। ফিদা হোসেনের আঁকা মাধুরী দিক্ষিতের ছবি সম্বলিত বিশাল পোস্টারও দেখলাম। খুবই ভালো লাগলো লÐন থেকে প্রায় সাড়ে তিনশত কিলোমিটার দূরে পাহাড়ী এলাকার এই ছোট্র শহরে ফিদা হোসেন আর মাধূরীকে দেখে।
একটু সামনে আগাতেই চোখে পড়ল ঘোড়ার পিঠে উদ্যত তলোয়ার হাতে টিপু সুলতানের রাজকীয় ছবি। নিচে ক্যাপশান দেয়া আছে, ’ইন্ডিয়ান কিং, হু হ্যড ফট লাইক এ টাইগার ফর ইন্ডিপেনডেন্স’।
আমি ইতিহাসের ছাত্র বলে মাইশোরের টিপু সুলতানকে আগে থেকেই জানতাম। এখানে এ অবস্থায় তাকে দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠলো। মনে হলো সত্যিই তো আমরা বীরের জাতি। ভারতবর্ষের যোদ্ধারা বুকের রক্ত দিয়েই তো তা প্রমাণ করেছে। এ অহংকার নিয়েই রওনা দিলাম হেরোগেটের দিকে।
তপন কুমার দাস
উন্নয়ন সাহিত্যিক
ঢাকা, বাংলাদেশ
আরশিকথা অতিথি কলাম
২৫শে সেপ্টেম্বর ২০২২