Type Here to Get Search Results !

সাগরপারে সরস্বতী ।। মানস দে, আটলান্টা

।। সাগরপারে সরস্বতী ।।

স্টেজে কচিকাচারা। মুখে টেনশনের ভাবমাত্র নেই। যত টেনশন ব্যাকস্টেজে, লিপস্টিক বা ফাউন্ডেশন ভেদ করে ফুটে উঠছে মায়েদের মুখে। যদি বাচ্চা স্টেজে ভুলে যায় সেই টেনশনে নিজের ছেলেকে গ্রিনরুম ছাড়া সব জায়গায় খুঁজে অবশেষে না পেয়ে মায়ের কান্না, শাড়ির স্টলে বৌকে ঘোরাফেরা করতে দেখে অন্য বরদের মতো আমারও টেনশন, বাচ্চাদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় বাবাদের পুরস্কার সবমিলিয়ে হৈ হৈ , হৈ চৈ বা বলা ভালো হই হই রই রই করে কাটলো এবছরের আমাদের সরস্বতী পুজো। মানে আটলান্টার পূজারীর ( Pujari Atlanta) সরস্বতী পুজো গত শনিবার। 

 যেহেতু পুজো, তাই পুজোর কথায় প্রথমে আসি। বিশুদা আমাদের পুরোহিত। আমাদেরই কলেজ থেকে ইঞ্জিনীরিং পাস করেছে আমার কয়েক বছর আগে। বিশুদা যে সে বামুন না একবারে ভট্চায্যি! কোনোদিন খালি গায়ে দেখিনি তবে পৈতে ভেতরে নিশ্চয় আছে। অসম্ভব ভালো সংস্কৃত উচ্চারণ। বিশুদা আমাকে দেখতে পেলেই হুমকি দেয়। তৃতীয়বার অঞ্জলি এবারে নাকি করাবে না। আমার দোষ আমি নাকি কোন একবার বিশুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম  - "বিশুদা লাস্ট অঞ্জলি কখন হবে?" সে যাই হোক বিশুদা আমাকে আগে থেকেই আল্টিমেটাম দিয়ে রেখেছিল টাইমে না এলে অঞ্জলি হবে না। তাই সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়ির হিটার জ্বালিয়ে স্নান করে, বৌ ছেলে পুলে সবাইকে জ্বালিয়ে এক্কেবারে সকাল এগারোটার সময় এসে দেখি তখনো পুজো শুরু হয়নি। বিশুদা আমায় এতো সকাল সকাল আশা করেনি। আমাকে দেখেই দেখি নিজের হাতে ঘড়িটা দেখে নিয়েই অন্যকে টাইম জিজ্ঞেস করছে। বোধহয় নিজের চোখ বা ঘড়ি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। না হলে কেনই বা বলবে "তোমাকে ঠিক মানসের মতো দেখতে লাগছে।" দাঁড়ি কেটে পাজামা পাঞ্জাবি পরে একটু ভদ্রস্থ হয়ে গেছি বলে মানুষটা কি পুরোই বদলে যাবো?  সেই বিশুদা পুস্পাঞ্জলির আগে সকাল বেলায় ওই ঠান্ডার মধ্যে দেখি শান্তিজল ছিটিয়েই যাচ্ছে যতক্ষণ না পর্যন্ত বিশুদার বৌ পেছন থেকে বিশুদার মাথায় শান্তিজল ছিটিয়ে বিশুদাকে ওই কাজ থেকে নিবৃত্ত করে। সে যাই হোক হটাৎ দেখি সত্যদা দেড়টার সময় কাঁচুমাচু মুখে চুপিচুপি আমাকে বলছে - "তৃতীয়বার কি অঞ্জলি হবে?" মানে সবাই জানে আমি তৃতীয়বারের খদ্দের। নিজের কি ইমেজ, মাইরি!  কিছুক্ষণ পর বিশুদা দেখি সত্যদা সমেত আরো কিছু লোকজনকে নিয়ে তৃতীয়বার অঞ্জলি করাচ্ছে। এই হলো আমাদের বিশুদা। রাগতে দেখিনি তবে আক্ষেপ করতে শুনেছি। বিশুদাকে কেউ কেউ বলছে অঞ্জলিটা নাকি একটু দীর্ঘায়িত! টিকটক, রিলের যুগে যদি ওটাকেও একটু কাটছাঁট করা যেত! বিশুদাকে বললাম - কি করবে যুগের হাওয়া! মানুষের আর ধৈৰ্য্য নেই। শুধু খাওয়া দাওয়ার মেনু ছাড়া, মানুষ সবকিছুই এখন ছোট চায়। পোশাক থেকে যন্ত্র, পরিবার থেকে মন্ত্র! 

খাওয়া-দাওয়ার কথাতে মনে পড়ল শুদ্ধাশীষের কথা। আমাদের প্যাশন শুধু  খাবারের থালার মধ্যে, কিন্তু শুদ্ধাশীষের প্যাশন খাবারের থালার বাইরে। সেও আমাদের কলেজের ছাত্র। আমাদের পিকনিকে একার হাতে সব কিছু নামিয়ে দেয় - মাংস থেকে ফিশ ফ্রাই। সেই প্যাশনে ফ্যাশন বলতে শুধু মসলা। মশলার ব্যাপারে খুব পার্টিকুলার! ব্র্যান্ডের বাইরে যায় না। এবারের শুদ্ধাশীষের মাস্টার স্ট্রোক বেগুনি! একেকটা কামড় দিচ্ছি আর ভাবছি কলকাতার রাস্তায় সেই বেগুনির কথা। কি অসাধারণ মুচমুচে! জিজ্ঞেস করলাম - " গুরু এই বেগুনিটা কি করে করলি?" শুদ্ধাশীষের আপাতঃ গম্ভীরমুখে বাঁ দিকে একটা হালকা হাসির রেখা  কয়েক মুহূর্তের জন্যে - ঠিক যেন রামধনুর মতো। ঘাড়টা একদিকে ঈষৎ কাত করে চোখটা একটু টেনে না তাকিয়েই বললো….। না থাক কি বললো আর বলছি না। যা বলার তা কালকের খাবারই বলে দিয়েছে। শুধু এইটুকু বলি বহুদিন শুধু মুখে নয় মনেও থেকে যাবে। 

সরস্বতী পুজো মানেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই আমাদের সবার প্রিয় রানা। বড়ো গুণী মানুষ। জমকালো চওড়া গোঁফের নিচে হাসিখানি সবসময় চওড়া। রানা কোথায় নেই? রানা আছে তবলাতে, গানে, কবিতায়, নাটকে, রানা আছে বড়োদের অনুষ্ঠানে, রানা আছে ছোটদের সঙ্গেও, রানা শুধু পূজারীতে নয় রানা আছে আটলান্টার সব বাঙালি অনুষ্ঠানে। সে অর্থে রানা সার্বজনীন। রানা থেকে যাবে আমাদের বাচ্চাদের স্মৃতিতে চিরকাল সরস্বতী পুজোর সেই 'কাকু' হয়ে। স্মৃতির ধূলিতে ফুঁ দিয়ে দেখুন, ঠিক দেখতে পাবেন ছোটবেলার সেই সব কাকুদের মুখ, যাঁরা না থাকলে পাড়ার কোন অনুষ্ঠানই হতো না। ধন্যবাদ! না না রানাকে নয়, রানার বৌকে রানাকে এভাবে জনগণতান্ত্রিক করে দেবার জন্যে। 

সব বছরের মতো এবারের পুজোর ডেকোরেশনও নাকি দারুন হয়েছে। কেউ হাঁসের পাখার মধ্যে সিমেট্রি খোঁজে তো কেউ বীণার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মেপে, অনুপাত বের করে গুগুল করার চেষ্টা করে। কেউ বা ঠাকুরের নিচে বই না পদ্মফুল সেই বিতর্কে ব্যস্ত। রাখী মানে আমার বৌকে কাছে না পেয়ে অনেকেই আমাকে প্রশস্তি শুনিয়ে যায়। গম্ভীরমুখে এমন ভান করি, আরে এ আর এমন কি কৃতিত্ব! ঠিকঠাক  লোককে বিয়ে করাটাই আসল কৃতিত্ব। 

এবারে পুজোতে দেখলাম অনেক নতুন মুখ। তাঁদের কথায় পূজারী একটা পরিবারের মতো। নতুন এসে এমন একাত্মতা তাঁরা ভাবতে পারেননি। আসলে এটাই পূজারী। প্রায় সব নতুন মেম্বারই কোথাও না কোথাও নিজের ছাপ রেখে গেছে। অভিনন্দন রিচা ও তার পুরো টিমকে। রিচাকে মনে হচ্ছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো। না থেকেও পুরো মাত্রায় আছে। ক্যাপ্টেন কুল! অহেতুক ছোটাছুটি ছিল না, ছিল না কোন চেঁচামেচি। পুরো ঠান্ডা মাথায় পুরো টিমটা নিঃশব্দে কাজ করে গেল। সবাইকে নিয়ে কাজ করে গেল। আশাকরি আমরা এভাবেই যেন আগামীদিনগুলি উদযাপন করতে পারি একটা পরিবারের মতো। 

কাল দেখলাম প্রায় চার প্রজন্মের মানুষকে একসঙ্গে।ন'মাসের বাচ্চার সঙ্গে নব্বই ছুঁই ছুঁই অসিতদাকেও। তিনিও আবার ঘটনাচক্রে আমাদের কলেজের। অসিতদা সস্ত্রীক এসেছেন এক ঘন্টার ওপর গাড়ি চালিয়ে। অনেকেরই দেশে বাবা-মা আর বেঁচে নেই। বলতে গেলে ছিন্নমূল। সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে বেশ কিছু ছিন্নপত্রের মতো একসাথে কোন বদ্বীপের মতো জায়গায় আমরা আটকে গেছি৷ অর্ধেক পৃথিবী দূরে যাদের একটাই পরিচয় - বাঙালি৷ যেখানে মিশে যায় দুই দেশ - পশ্চিম ও পুর্ব,  সীমান্তের বেড়াজাল ভেঙে একটা পরিবারের মতো। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেবেলা হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। হারিয়ে গেছে অনেক অনেক কিছুই। তবুও সব মানুষের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে থাকে তার ছেলেবেলা বা মেয়েবেলা। সময়ে অসময়ে তাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে বৈ কি? তার টানেই তো ছুটে আসা। ছুঁতে চাওয়া হারিয়ে যাওয়া সময়টাকে। সেই ছোটবেলার মতো সবাইকে নিয়ে। আপন পর, নতুন পুরানো, ছোট বড়ো সবাইকে নিয়ে। একসঙ্গে। একবার বলতে ইচ্ছে করে "জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে৷ বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতি দেবী নমোস্তুতে।"


মানস দে, আটলান্টা

২৭ জানুয়ারি ২০২৩

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.