উজ্জ্বল কুমার দাস,বাগেরহাট,আরশিকথাঃ
বাংলাদেশের বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার মঘিয়াতে প্রায় ৪ শত বছরের পুরনো স্থাপত্য নিদর্শন দিনের পর দিন পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়।অনেক আগে থেকেই খসে পড়ছে এর পলেস্তর।তাছাড়া সংরক্ষণের অভাবে কোটি-কোটি টাকার মূল্যমানের কষ্টি পাথরের দক্ষিণা-কালী মূর্তি ও শিব লিঙ্গ চুরি হয়ে গেছে অনেক আগেই।এখন সময়ের পরিক্রমায় বিনষ্ট হচ্ছে রয়ে যাওয়া চতুর্ভূজ আকৃতির ইট ও কারুকাজ খচিত মন্দিরের মূল ভবন ২টি।
এখানে গিয়ে শিব মন্দিরের ফলকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে মন্দিরটি সংস্কার করেন সুকুমারী চৌধুরানী ও সরজবালা চৌধুরানীর মেজ ছেলে বীরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী। শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর সহধর্মীনি ব্রহ্মময়ী ও শশ্রুমান কাদম্বিনী রায় চৌধুরানী।তাদের সহ অসংখ্য স্মৃতি বহন করছে এই মন্দিরে।
তবে এবিষয়ে যতদুর জানাযায় জমিদারী আমলের শুরুর দিকে শিব মন্দির ও দক্ষিণা-কালী মন্দিরসহ অন্যান্য স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেন জমিদারগন।বাগেরহাটে আউলিয়া সম্রাট খাঁজা খাঁনহাজান আলীর আগমন ও তার স্থাপনা সমূহ নির্মাণের সমসাময়িককালে এখানে এই শিব ও দক্ষিণা-কালী মন্দির,জমিদার বা রাজবাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মিত হয়।সম্ভবত গন্ধর্ব নারায়ণ চৌধুরীরর জমিদারি সময়ে ওই মন্দির নির্মিত হয়। জমিদারগন তৈরি করলেও কালের পরিক্রমায় এখন তা সার্বজনীন রূপ নিয়েছে।
মন্দিরটির বিষয়ে কথা হয়েছিল মন্দির কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাধন কুমার দাসের সাথে তিনি বলেন,প্রতি বছরের বৈশাখ মাসে এখানে নানা অনুষ্ঠান হয়ে আসছে।জাগ্রত এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অনেক অনেক ইতিহাস।কচুয়া উপজেলায় আর কোথাও এমন নির্দশন খুজে পাওয়া যাবে না।এত কিছুর পরেও তিনি কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন,প্রথম ১৯৭৭ সালে দক্ষিণা-কালী মায়ের কষ্টি পাথরের মূর্তি চুরি হওয়ার মধ্যদিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সংশয় সৃষ্টি হয়।এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে চুরি হয় কষ্টি পাথরের শিব লিঙ্গটিও।এরপর নিরাপত্তা ঘারতি জনিত কারনে প্রশাসনের সহায়তায় ১৯৯৬ সালে ভূবনেশ্বরীর কষ্টি পাথরের মূর্তি খুলনা যাদুঘর নিয়ে যায়।সবশেষ শিব মন্দিরের চূড়ায় অবস্থিত মহামূল্যবান দৃষ্টি নন্দন কলিশাটাও রাতের অন্ধকারে কেটে নেওয়া হয়েছে।এর ফলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে কটি-কটি টাকা নষ্ট হয়েছে ইতিহাস।এখন বাকী যে স্থাপত্য আছে তা কালের স্বাক্ষী হয়ে পরে আছে অবহেলায়।এখনো পর্যন্ত নষ্ট হচ্ছে ইট,কাঠ,বালু।তৈরি করা যায়নি চারিদিকের সীমানা প্রাচীর।
মন্দির কমিটির আরেক সদস্য বলেন,এটি শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির নয় এটি এ অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করছে।উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পুরাকীর্তি সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।বিশ্বের কাছে দেশের পরিচিতি আরো বৃদ্ধি পায় তাই এটি এখনি সংরক্ষণ করা না হলে এ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করা আর সম্ভব হবে না ফলে নষ্ট হবে ইতিহাস ঐতিহ্য।
মন্দির কমিটির সভাপতি সুব্রত রায় চৌধুরীর তথ্যমতে,এখনো মাটির নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক নিদর্শন।দ্রুত সময়ের মধ্যে এই স্থাপত্য সংরক্ষণ করার মাধ্যমে সঠিক পদক্ষেপ নিলে এই এলাকার ইতিহাস যেমন রক্ষিত হবে তেমনি পর্যটনের মাধ্যমে খুলে যেতে পারে সম্ভাবনাময় আয়ের পথ।
সরেজমিনে গিয়ে জানাযায়,বর্তমানে মঘিয়া জমিদারের শেষ বংশধর হিসাবে টিকে আছে কচুয়া সরকারি সিএস পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুব্রত রায় চৌধুরী ও তার ভাই নূপুর রায় চৌধুরী।তবে মন্দিরটি সার্বজনীন হয়ে উঠলেও কয়েক বছর আগেও ছিলনা কোন কমিটি।আজ থেকে ৩ বছর আগে সুব্রত রায় চৌধুরী ও এলাকা বাসির যৌথ উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল মন্দির কমিটি।তার পরের বছরই নতুন কমিটির উদ্যোগে কিছুটা জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।বর্তমানেও প্রতিবছর এখানে পূজা অর্চনা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও কবি গান অনুষ্ঠিত হয়।তবে সর্বশেষ জমিদার শিশির রায় চৌধুরী এই বংশের সন্তান থাকার সময় পর্যন্ত এখানে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান ছিল।জমজমাট চৈত্র, বৈশাখী মেলা এই মন্দিরকে ঘিরেই হত বলে জানা যায়।স্বাধীনতার পরে আর তেমন অবস্থা আর চোখে পরেনি বলে অনেক বয়স্করা জানিয়েছেন।
মূলত জমিদার প্রথা বিলোপের পর হতে তাদের আর্থিক সংকট ঘনীভূত হয়।একে একে আর্থিক দৈন্যতা বর্তমানে এমন পর্যায়ে যে,জমিদার বংশের উত্তরসূরী হয়েও শিক্ষকতা, কৃষিসহ সাধারণ পেশায় কাজ করে তারা জীবন ধারণ করছেন।এই যখন অবস্থা তখন তাদের পক্ষে প্রাচীন স্থাপত্যসমূহ সংস্কার বা সংরক্ষণ করা অনেকটা অসম্ভব।
কচুয়া উপজেলার বিগত আমলের বিদায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা সুজিৎ দেবনাথ ও জীনাত মহল গণমাধ্যমে দেওয়া স্বাক্ষাতে বলেছিলেন,ইতিহাস ঐতিহ্যবাহিত নিদর্শন সংরক্ষণ করা দরকার।তাদের মতে এটি সংরক্ষণ করে পর্যটন উপযোগী করলে একদিকে যেমন এলাকার আয় বাড়বে।অপরদিকে দর্শনার্থীরা অতীত সম্পর্কে জানতে পারবে।তবে তারা দুজনেরই স্বল্প সময় দায়িত্ব পালন করায় এ বিষয়ে কোন আলোর মুখ দেখা যায়নি।পরবর্তীতে আরো ২ জন নির্বাহী কর্মকর্তা যোগদান করলেও তাদেরও এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোন কাজ করতে দেখা যায়নি।
এমন অবস্থায় স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বী সহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ বলছে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃতাছমিনা খাতুন সহ বিভিন্ন মহলের সহায়তায় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ হস্তক্ষেপ করলেই এটি হতে পারে সম্ভাবনাময় পর্যটনখাত ও সনাতন সম্প্রদায়ের অন্যতম পীঠস্থান।
আরশিকথা বাংলাদেশ সংবাদ
৩ মে, ২০২৩