শ্রদ্ধেয় স্যার,
সালাম জানবেন। আশাকরি ভালো আছেন। আপনি আমাকে হয়তো চিনতে পারছেন না। কারণ, প্রেরকের নাম ঠিকানা যা দিয়েছি সেটা সম্পূর্ণ ভুয়া। এখন নিশ্চয়ই চিঠির শেষ অংশে গেছেন। ইতি কে? তা দেখার জন্য… লাভ হবে না স্যার। লিখি নি ওখানেও। এরকম অধৈর্য্য তো আপনি কখনো ছিলেন না স্যার। ধৈর্য্য ধরে চিঠিটা পড়ুন না। আমি আপনার একজন ছাত্র। অনেক অনেক বছর আগে আপনার কাছ থেকেই শিখেছিলাম ইংরেজির টেনস্ আর ভয়েস।
ডাক্তার আসার আগে রোগীটি মারা গেল এটা জানি কোন টেন্স, স্যার? নিশ্চয়ই বেতটা খুঁজছেন আমাকে মারার জন্য। স্যার, এখন না বাচ্চাদের মারা নিষেধ। আইনে নেই। আর বেআইনি কাজ যে আপনি করতে পারেন না তা আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি।
জানেন স্যার, আপনার বাসায় প্রাইভেট যারা পড়তো, তাদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে নিয়মিত। আপনি কত প্রশংসা করতেন সবার কাছে। লজ্জ্বা পেতাম স্যার। কারণ, আমি টেন্স আর ভয়েস ভালোবেসে আপনার বাসায় ঠিকঠাক মতো যেতাম না। যেতাম লিমার কারণে। হ্যাঁ স্যার। আপনার মেয়ে লিমা। স্যার, আমাকে ফরিদ ভেবে ভুল করবেন না। ও তো একটা বোকা। স্যারের মেয়েকে কেউ সরাসরি প্রেমপত্র দেয়? ওকে শুধু কি আপনি মেরেছিলেন? আমিও মেরেছিলাম। চোখ বরাবর এক ঘুষি। মনে আছে স্যার, পরদিন আপনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ মারলাম তোর পিঠে, চোখে কালশিটে কিভাবে পড়লো রে হারামজাদা”
ও মাথা নিচু করে ছিল। স্যার, লিমার সাথে সম্পর্কটা ছিল আমার। আপনি কবুতরগুলোকে ছাদে খাবার দিতে গেলেই আমরা চিঠি আদান-প্রদান করতাম। সত্যিই ভালোবেসেছিলাম লিমাকে। আপনি তো কিছু বিচার বিবেচনা না করেই “ভালো” ছেলে দেখে দিয়ে দিলেন বিয়ে। তাও আবার বাল্য বিবাহ। আজকের দিন হলে স্যার আপনি নির্ঘাত জেলে যেতেন।
আর একটা কথা বলি আপনাকে। সিগারেট খাওয়া ভালো না বলেই আপনি সিগারেটে যে টানটা দিতেন, আমরা কিন্তু উল্টোটা বুঝতাম। আপনার প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়েই আমার শুরু। আর থামি নি। এই যে দেখুন স্যার, লিখছি আর সিগারেট টানছি।
লিমার কথা আর লিখবো না। জানি, আপনার চোখের কোণে জল জমেছে। ও চলে যাওয়ার তো বছর দুয়েক হলো। বাচ্চাটা নাকি আপনাদের কাছেই থাকে। খালাম্মা পারবেন ওকে মানুষ করে তুলতে। অনেক স্নেহ করতেন আমাকে। সেই দুধ পুলি পিঠা। স্যার, প্রেমপত্র লেখা ফরিদ হারামজাদা ছিল না। আসল হারামজাদা আপনার জামাইটা। গেল বছর বিয়ে করেছে। বাচ্চাটার শুনেছি কোনো খোঁজ নেয় না। এত কিছু জানি দেখে অবাক হচ্ছেন? লিমার লাশের পাশে সেদিন আমিও ছিলাম। আপনি চিনতে পারেন নি আমায়।
আপনার শেখানো ইংরেজির বদৌলতেই ঠেলেঠুলে এসএসসিটা পাশ করেছিলাম। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। অনার্স মাস্টার্স যদিও বাংলায় করেছি, তবুও ওই জ্ঞানই আমার ভিত্তি। স্যার, পরিবারকে একটু বেশি সময় দিতে হতো। লিমা খুব আক্ষেপ করতো জানেন। বলতো, আমার বাবা তো সব ছাত্রের বাবা। আর আমার শিক্ষক। এই যে আমার মতো যাদের পড়ালেন, জীবন গড়ে দিলেন, কজন খোঁজ রাখছে আপনার? লিমার স্মৃতিচিহ্নটাকে সময় দিন এবার। ওর কাছেও আপনি কাটখোট্টা শিক্ষক হয়ে থাকলে লিমা কিন্তু আপনাকে একদম ক্ষমা করবে না। স্যার, কাল আপনি লিমার শেষ স্মৃতিচিহ্নটা পর্যন্ত বেচতে গিয়েছেন গহনার দোকানে। জানি, বাচ্চাটা আসার পরে হাতে গোনা কয়েকটা টাকা দিয়ে আর চলছে না। খালাম্মার সব গয়না তো বেঁচা শেষ। ওটা না বেচলে হতো না? হয়তো হতো না।
কাল আপনি যখন দোকান থেকে বেরিয়ে রুমাল দিয়ে চোখ মুছছিলেন, আমি পেছনেই ছিলাম। আমিও কেঁদেছিলাম স্যার। লিমার জন্য। আমাদের লিমা।আমার লিমা।
আর এক লাইনও লেখা অসম্ভব। এত বড় চিঠিটা লেখার কারণ শেষে এসে বলি, গহনার দোকান থেকে লিমার হাতের স্বর্নের চুড়িটা আমি ছাড়িয়েছি। ওটাকে অন্য কারোর অলঙ্কার হতে দেব না। লিমার সন্তানটাও তো মেয়ে, তাই না স্যার? ওকে এটা দেবেন। ওর মায়ের স্মৃতিচিহ্ন।
একটু কষ্ট করে দোকানে গিয়ে চুড়িটা নিয়ে আসবেন। ওটা দোকানেই রাখা আছে।
একটা শেষ অনুরোধ করি স্যার, মেয়েটার নাম রিনু রাখবেন। আমার আর লিমার শখ ছিল আমাদের সন্তান হলে আমরা নাম রাখবো রিনু।
আমাকে খুঁজতে হবে না স্যার। আমি ছায়ার মতো আছি আপনাদের সাথে।
ইতি-
আপনার একজন ছাত্র কিংবা একজন সন্তান
মনদীপ ঘরাই,বাংলাদেশ
১৫ই জানুয়ারি ২০১৯ইং
মনদীপ ঘরাই,বাংলাদেশ
১৫ই জানুয়ারি ২০১৯ইং