ফেব্রুয়ারির শীতের সকাল। আটলান্টার সকাল আজ প্রচন্ড ঠান্ডা আর মেঘলা আকাশের জগাখিচুড়ি। এমনি সকালগুলোকে বিরক্তিকর আর চিরতার জলের মতো তেতো মনে হয় আমার। চিরতা কোথা থেকে পেলাম এ যুগে? না, না --ওটা সে--ই যুগে আমার ছোটবেলার সকালের সঙ্গী ছিল। যখন একবাড়ি লোকের Wellness প্রজেক্টের একমাত্র গিনিপিগ ছিলাম আমি। যাইহোক, সে গল্প পরে হবে 'খন। ওয়েদার রিপোর্ট দেখে নিলাম। দুপুর থেকে শুরু হবে বৃষ্টি। তাই দেরি না করে মন্দির দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, আমি gym কে মন্দির বলি। সুস্বাস্থ্য আর মানসিক ভারসাম্য, এই অতি প্রয়োজনীয় দু'টো জিনিসের জন্য অদম্য উৎসাহ আর চেষ্টা যেখানে চলে --- চেনা-অচেনা সেই লোকেদের একাগ্রতার সামনে Gym কে আমার কাছে মন্দির ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
বাড়াবাড়িটা সবার জন্য সমান না হলেও বিদেশের ব্যস্ত জীবনে আমাদের সকলেরই চোখ থাকে কোনো অনুষ্ঠান কিংবা কোনো আনন্দ করার সুযোগের পথে। আজ Gym এর ইন্ডোর walk trail এর দেয়ালে লেগেছে বিশাল বড় সাইন। আর এতে ততোধিক বড় করে লিখা "LOVE LANE",এর পাশে পুরো দেয়াল জুড়ে অসংখ্য লাল, গোলাপি, বেগুনি রঙের হার্ট। সবই কাগজের। তবে সত্যিকারের হার্টকে ছুঁয়ে যাবার মতো করে সাজানো। ভ্যালেন্টাইন্স ডে যে দোর গোড়ায় ! ভালো লাগলো দেখে এই খুশির চেষ্টাকে। বাইরের আকাশ যেমনই অন্ধকার হোক, মনের আকাশে তখন যেনো দেখলাম "মেঘের কোলে রোদ হেসেছে!"
সকাল সকাল চলে গেছিলাম বলে ওয়াক ট্রেইলে আমি ছাড়া আর কেউ নেই তখনও। বেশ লাগছিলো একা জগিং করতে। কিন্তু নিচের বাস্কেট বলের ছ'টি কোর্টেই খেলা চলছে তখন পুরোদমে। বিশাল হলের ভেতর এতগুলো বলের শব্দে মনে হচ্ছিলো ঐতিহাসিক কোনো যুদ্ধের দামামা। একটা ভরপুর পরিবেশ। কয়েকটা ল্যাপ শেষ করতেই একসময় মনে হলো নিচের ফ্লোরের বলের আওয়াজ হঠাৎ কমে গিয়েছে। রেলিঙের পাশ ধরে হাঁটা শুরু করলাম, যদিও চোখ আমার তখন নিচের ফ্লোরে। দেখলাম খুব কম বয়সী একটি couple এর মধ্যে কোনো ব্যাপারে কথা কাটাকাটি চলছে। একটি বছর তিনেকের ফুটফুটে মেয়ে,ওদেরই মেয়ে হবে হয়তো, ভয়ে ভয়ে একবার মহিলাটির পাশে যাচ্ছে আবার দৌড়ে যাচ্ছে লোকটির পাশে। যারা এখানে খেলছিল, পারিবারিক ঝামেলা দেখে ওদের প্রাইভেসির কথা ভেবে হল ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মিনিট দশেক পর একসময় দেখলাম মহিলাটি মেয়েটিকে কোলে নিয়ে জোর পায়ে বেরিয়ে গেলো হল থেকে LOVE LANE এর চমকদার সাইনের পাশ ধরে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো ছোট্ট মেয়েটির কান্নামাখা করুণ মুখটি মনে করে।
আরও কিছুক্ষণের মধ্যে ওয়াক ট্রেইলে বেশ কয়েকজন চলে এসেছে। আর বাস্কেট বলের কোর্টগুলোতেও সবাই ফিরে এসেছে। আবার জমজমাটি হাওয়া।
ছয় বছর ধরে একই gym এ যেতে যেতে আমার পরিচিতের সংখ্যা এখন প্রচুর। সবার সাথে তো সবসময় কথা হয় না। কিন্তু ওই অল্প দেখাতেই ভালো থাকার একটা আশ্বাস পাই। বেশ অনেকগুলো সপ্তাহ মিস্টার আর মিসেস কিম কে দেখিনি। অনেক বয়স ওদের। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিলো ওদের কথা। আজ বহুদিন পর আবার ওদের সাথে দেখা ! দৌড়ে গেলাম কথা বলতে। কিন্তু মিস্টার কিম কেমন অচেনার মতো তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। পরে জানলাম স্ট্রোক হয়ে হাসপাতালে ছিলেন কিছুদিন। আর সেই থেকে অনেক কিছুই ভুলে গেছেন।
হলের দরজায় ঢুকেই কোট, জ্যাকেট ইত্যাদি রাখার জায়গা। লাইন করে ঝুলছে অনেকগুলো শীতের জামাকাপড়। ওখানেই একটি খালি হ্যাঙ্গারে নিজের জ্যাকেট ঝুলিয়ে রেখে মিসেস কিম হাঁটা শুরু করে দিয়েছেন। দেখলাম অনেকক্ষণ ধরে মিস্টার কিম নিজের জ্যাকেটটি হাতে নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে ঝোলানো জ্যাকেটগুলো শুধু দেখে যাচ্ছেন। বেশ অনেকটা সময় পরে ওয়াইফের জ্যাকেটটি খুঁজে পেয়ে ঠিক তার পাশে নিজের জ্যাকেটটি রাখলেন। চোখে মুখে তার এক তৃপ্তির হাসি। মিসেস কিম সেটি দেখলেন। চোখ দু'টো তার জলে ভরে গেলো। পাশে এসে হাসব্যান্ডের হাতখানি ধরে ওয়াক ট্রেইলের LOVE LANE ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলেন।
একটা ভালোলাগার অনুভূতিতে যেন মনটি ছেঁয়ে গেলো আমার। সাথে চলার শেষ পুরস্কারের মতো যেন ঝলমল করতে লাগলো ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র জন্য সাজানো দেয়ালের নানা রঙের হার্টগুলো।
জবা চৌধুরী, আটলান্টা
১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ইং